করোনা থেকে মুক্তি পেলাম যেভাবে...

প্রথম যখন জানতে পারলাম যে কোভিড-১৯–কে ‘প্যানডেমিক’ হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে, আন্দাজ করতে পেরেছিলাম যে বাংলাদেশেও একসময় ভাইরাসটির সংক্রমণ হবেই। কিন্তু আমি এবং আমার পুরো পরিবারও যে এই ভাইরাসে আক্রান্ত হব, এটা কখনো ভাবিনি।

আমার বাসা মিরপুর-১–এর আনসার ক্যাম্পে। রাস্তা পার হলেই টোলারবাগ, যেখানে ঢাকার প্রথম কোভিড-১৯–এ আক্রান্ত রোগীর মৃত্যু হয়। এমনিতেই আমরা বেশ সাবধানতার সঙ্গে চলাচল করতাম, প্রয়োজন ছাড়া বের হতাম না একদমই। তারপর যখনই শুনলাম যে টোলারবাগে কোভিড-১৯–এ আক্রান্ত হয়ে একজন মারা গেছেন, আমরা আরও সাবধান হয়ে যাই।

ঈদ পর্যন্ত আমরা কোনো সমস্যা ছাড়াই পার করে দিলাম। কিন্তু গত ২৭ মে, অর্থাৎ ঈদের তৃতীয় দিন রাতে আম্মার জ্বর আসে, সঙ্গে হালকা কাশি। আমরা সবাই ভাবলাম, আগের দিন আম্মা অনেক কাপড়চোপড় ধুয়েছেন, তাই হয়তো ঠান্ডা লেগেছে, যেটা মাঝেমধ্যেই আম্মার হয়। তাই আমরা খুব বেশি চিন্তা করলাম না। পরের দিন থেকে জ্বর চলে গেলে আমরা আরও নিশ্চিত হই যে করোনা নয়, আম্মার হয়তো ঠান্ডাই লেগেছে। কিন্তু আমরা চিন্তিত হই পরদিন, যেদিন থেকে আম্মার ডায়রিয়ার লক্ষণ দেখা দেয়। পুরোপুরি ডায়রিয়ার মতো না হলেও আম্মার দিনে দু-তিনবার পাতলা পায়খানা হতে লাগল। সঙ্গে ছিলো বমিভাব এবং স্বাদ ও গন্ধ চলে যাওয়া। আমরা যেহেতু জানতাম যে এগুলো সবই কোভিড-১৯–এ আক্রান্ত হওয়ার লক্ষণ, তাই তাৎক্ষণিকভাবে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) ফিভার ক্লিনিকে কোভিড-১৯ পরীক্ষার জন্য অ্যাপয়েন্টমেন্ট নেওয়ার চেষ্টা করতে থাকি। অনেক চেষ্টার পর আমরা সিরিয়াল পাই ১ জুনের।

বিএসএমএমইউ-এর বেতার ভবনের সামনে কোভিড-১৯ পরীক্ষা করানোর জন্য লাইনে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছে মানুষ। ছবি : লেখক
বিএসএমএমইউ-এর বেতার ভবনের সামনে কোভিড-১৯ পরীক্ষা করানোর জন্য লাইনে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছে মানুষ। ছবি : লেখক

সেদিন রাতেই পরীক্ষার রিপোর্ট আসে যে আম্মা কোভিড-১৯ পজিটিভ। ওই মুহূর্তটাই বোধ হয় ছিল সবচেয়ে কঠিন। আম্মাকে প্রয়োজনীয় সব জিনিসপত্র দিয়ে আলাদা রুমে আইসোলেশনে পাঠিয়ে দেওয়া, পুরো বাসা নতুন করে আবার জীবাণুমুক্ত করা, আমার ও বাবার রুম আলাদা করা—এই কাজগুলো করার সময় মনে হচ্ছিল যে এগুলো সবই কল্পনা, বাস্তব নয়।

পরবর্তী কয়েকটা দিন বেশ কঠিনই ছিল আমাদের জন্য। রান্নাবান্না ও ঘরের সব কাজ করা যে কত কঠিন, তা আমি, বাবা ও ভাই হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছিলাম। আম্মা একা সারা দিনে যে কাজগুলো করে ফেলতেন, আমরা তিনজন মিলে সেগুলো করতে একপ্রকার হিমশিমই খেতে লাগলাম। তবে আমাদের এর থেকেও বড় যে সমস্যা প্রকট হয়ে দেখা দিল, তা হলো দুশ্চিন্তা। প্রতিনিয়ত বাসার সবাই তটস্থ হয়ে থাকতাম, এই বুঝি আম্মার শ্বাসকষ্ট দেখা দিল, এই বুঝি ডায়াবেটিস এদিক–সেদিক হয়ে গেল। মধ্যবিত্ত পরিবার হওয়ায় হুট করে প্রায় তিন হাজার টাকা খরচ করে অক্সিমিটার কেনা আমাদের জন্য সহজ ছিল না, তাই জরুরি অ্যাম্বুলেন্স–সেবা আর অক্সিজেন সিলিন্ডার সরবরাহকারীদের ফোন নম্বর সংগ্রহে রাখা ছাড়া আর কিছু করা সম্ভব হয়নি আমাদের পক্ষে। আস্তে আস্তে দিন গড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে আম্মার শরীর একটু একটু করে ভালো হতে লাগায় সবার দুশ্চিন্তা কমে আসে। তবে এ ক্ষেত্রে আমারও বিশেষ ভূমিকা আছে বলে আমার দৃঢ় বিশ্বাস। বাসার কেউ হতাশ হয়ে পড়লেই ‘এই নগন্য ভাইরাস নিয়ে চিন্তা করতেসে... হে হে হে’—এ ধরনের একটা উপহাস করে সবার মধ্যে অতিরিক্ত সাহস এনে দেওয়ার কৃতিত্বটা আমাকে দিতেই হবে (তবে ভাইরাসটি কিন্তু মোটেই নগণ্য নয়!)।

ইতিমধ্যে আমরা সবাই টেস্ট করাই এবং সবারই নেগেটিভ আসে। এবং দিন গড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে আম্মাও সুস্থ হতে থাকেন। দুই সপ্তাহ পর যখন আমরা সবাই আশা করছিলাম, এবার টেস্ট করলে আম্মার রেজাল্ট নেগেটিভ আসবে এবং আমরা আবার স্বাভাবিক জীবনে ফিরে যেতে পারব, তখনই আবার আরেকটা ধাক্কা আসে। ১৫ জুন রাত থেকে আমার বড় ভাইয়ের প্রবল জ্বর আসে, সঙ্গে কাশি। ১৭ জুন ভাইয়া ও আম্মা একসঙ্গে টেস্ট করিয়ে আসেন এবং রাতে রেজাল্ট আসে, আম্মা কোভিড-১৯ নেগেটিভ, কিন্তু ভাইয়া পজিটিভ।

শেষ হইয়াও হইল না শেষ! আবার সেই পুরোনো ঘটনার পুনরাবৃত্তি, আম্মাকে আইসোলেশন থেকে বের করে এবার ভাইয়াকে আলাদা রুমে আইসোলেশনে পাঠিয়ে দেওয়া, পুরো বাসা জীবাণুমুক্ত করা এবং রুম বদল করা; যা আবার আমার কাছে মনে হতে লাগল অবাস্তব কোনো ঘটনা। দুই দিন পর, ২০ জুন আমার আর বাবারও কোভিড-১৯ পজিটিভ আসে। তিন দিনেই পাশার দান উল্টে গিয়ে আম্মার জায়গায় আইসোলেশনে চলে আসি আমরা তিনজন এবং বাইরে থেকে যান আম্মা। কয়েক দিন আগেও আমরা তিনজন যে কাজ করছিলাম, হুট করেই তিনজনের জায়গায় সেসব কাজের ভার পড়ে আম্মার ওপর, যিনি মাত্র করোনা থেকে সেরে উঠেছেন। এ ছাড়া আমাদের কারও কিছু করারও ছিল না। কারণ, আমরা কেউই নিশ্চিত ছিলাম না, এই ভাইরাসে দ্বিতীয়বার কেউ সংক্রমিত হয় কি না। ফলে আম্মা যেন আবার সংক্রমিত না হন, সেদিকেই মনোযোগ ছিল আমাদের।

তো, আবার আমাদের সেই আগের রুটিনে চলে যাওয়া। এবার একটু ভিন্ন, আগে আমরা তিনজন রান্নাবান্না করতাম এবং আম্মাকে প্রয়োজনীয় সব জিনিস রুমের বাইরে দিয়ে যেতাম। এবার আম্মা একাই সব রান্নাবান্না করে আমাদের রুমের সামনে দিয়ে যেতে লাগলেন।

এসব ব্যাপারই আমাদের সবাইকে মানসিকভাবে প্রচণ্ড চাপে ফেলে দিতে লাগল। বিশেষ করে আমরা নিজেরা আক্রান্ত হওয়ার পর পুরো বাসার পরিবেশ প্রচণ্ড অস্বস্তিকর হয়ে দাঁড়ায়। কারণ, আমরা সবাই বুঝতে পারছিলাম যে আম্মার কোভিড-১৯ নেগেটিভ হয়ে গেলেও তাঁর এখন দরকার পর্যাপ্ত বিশ্রাম, যা তিনি নিতে পারছেন না। কিন্তু যেহেতু আম্মার তেমন কোনো জটিলতা দেখা দেয়নি, তাই আমি আর ভাইয়া ঠিকই বুঝতে পেরেছিলাম, আমাদেরও তেমন কোনো জটিলতা হওয়ার সম্ভাবনা কম। কারণ, আমাদের মধ্যে আম্মার রোগ প্রতিরোধক্ষমতাই সবচেয়ে কম, ডায়াবেটিস ও অন্য বেশ কিছু কারণে। আমরা এটাও বুঝতে পেরেছিলাম যে সুস্থ হয়ে গেলেই ঘরের অবস্থা আবার আগের মতো স্বাভাবিক হয়ে যাবে। তাই আমরা দুজনই আব্বা ও আম্মাকে যতটুকু সম্ভব মানসিকভাবে চাঙা রাখার চেষ্টা করতে রাখলাম। যার ফল হলো দারুণ। মানসিক দিক দিয়ে একটু স্বাভাবিক বোধ করার ফলেই আলাদা কোনো দুশ্চিন্তায় তাঁরা পড়ে যাননি। ফলে অন্য সমস্যাগুলো, যেমন প্রেশার, ডায়াবেটিস ইত্যাদি তাঁদের নিয়ন্ত্রণের মধ্যেই ছিল। যা আমাদের সবার জন্যই ছিল স্বস্তির।

প্রায় ১০ দিনের মধ্যে আমরা তিনজনই বেশ সুস্থ বোধ করতে লাগলাম। শুধু অল্প কাশি ছাড়া আমাদের কারোরই তেমন কোনো সমস্যা আর থাকল না। স্বাদ ও গন্ধ সাত দিনের মধ্যেই ফেরত চলে এসেছিল সবার। আমার কোভিড-১৯ পজিটিভ আসে ২০ জুন। সে হিসাবে ৪ জুলাই আমার ১৪ দিন পূর্ণ হলেও আমি ২ জুলাই টেস্ট করানোর সিদ্ধান্ত নিই। কারণ, টেস্ট করানোর দুই দিন আগে থেকে আমার শরীর খারাপ হয়ে গিয়েছিল। আব্বা এ ঝুঁকি নিতে চাইলেন না। তিনি ৪ তারিখেই টেস্ট করাতে চাইলেন। কিন্তু আমি ও ভাইয়া ভাবলাম, অন্তত আমাদের দুজনের রেজাল্টও যদি নেগেটিভ আসে, ঘরের অবস্থা অনেকটা স্বাভাবিক হবে। তাই পরিকল্পনামাফিক আমি আর ভাইয়া ২ জুলাই টেস্ট করাই এবং রাতে ফল আসে, আমরা দুজনই কোভিড-১৯ নেগেটিভ।

ফল দেখে ভাবলাম, আগেই আম্মাকে কিছু না বলে একটু মজা করি। রুমের দরজা দিয়ে উঁকি দিয়ে দেখি আম্মা ডাইনিংয়ে দাঁড়িয়ে আছেন। আমি পা টিপে টিপে তাঁর পিছে গিয়ে হাসি হাসি মুখ করে দাঁড়িয়ে গেলাম। কী মনে করে আম্মা পেছনে তাকিয়ে আমাকে দেখে আর্তনাদ করে ছিটকে দূরে সরে গেলেন! কিন্তু সঙ্গে সঙ্গেই আমার চেহারা দেখেই বুঝে ফেললেন যে আমি সুস্থ হয়ে গেছি, এবং আমাকে তখনই জড়িয়ে ধরলেন।

এক মাসেরও বেশি সময় পর মায়ের সঙ্গে সেলফি!
এক মাসেরও বেশি সময় পর মায়ের সঙ্গে সেলফি!

এক মাস! এক মাসের বেশি সময় পর আমি আমার মায়ের স্পর্শ পেলাম। কত দিন পর আমার এমন সুখকর অনুভূতি হলো তা ঠিক জানা নেই। এক দিন পর, ৪ জুলাই আব্বারও কোভিড-১৯ নেগেটিভ আসে। অবশেষে বাসা আবার আগের মতো স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসে। কোভিড-১৯ আমাদের ওপর ভর করেছিল এক মাসের জন্য, কিন্তু এই এক মাসই মনে হচ্ছিল যেন অনন্তকাল ধরে চলছে।

দ্রুত শারীরিক সুস্থতার জন্য আমরা সবাই প্রায় একই ধরনের পন্থা অবলম্বন করেছি। আশা করি, এত দিনে সেগুলোর বেশির ভাগই তোমরা সবাই জানো। যেহেতু জ্বর-সর্দি-কাশি—এ ধরনের উপসর্গ দেখা দেয়, তাই চিকিৎসাটা ছিল খুবই সাধারণ। দিনে যখনই পানি পান করতাম, আমরা গরম পানি খেতাম, কয়েকবার কুসুম গরম পানির সঙ্গে লবণ মিশিয়ে কুলকুচি করতাম এবং গরম পানির সঙ্গে দারুচিনি, এলাচি, লবঙ্গ ইত্যাদি গরম করে সেগুলোর ভাপ নিতাম; লেবুর শরবত, লাল চা ইত্যাদি পান করতাম। ভাপটা মূলত নেওয়া হয় ঘ্রাণ দ্রুত ফেরত আসার জন্য। অন্য কোনো কারণে কিন্তু নয়। পাশাপাশি ডাক্তারের দেওয়া ওষুধগুলো তো খেতামই। আর ডায়রিয়ার লক্ষণ থাকায় আম্মা দিনে কয়েকবার খাবার স্যালাইন পান করতেন।

এখানে একটা জিনিস সবার মনে রাখা উচিত। ইদানীং করোনাভাইরাসের কোনো উপসর্গ কারও মধ্যে দেখা দিলেই আমরা কোভিড-১৯ থেকে সুস্থ হয়েছি, এমন কোনো ব্যক্তির সঙ্গে যোগাযোগ করে তাঁর সেবন করা ওষুধগুলো সেবন করে ফেলি। যেটা সম্পূর্ণ অনুচিত। একই বাসায় থেকে সবাই কোভিড-১৯ রোগে আক্রান্ত হওয়ার পরও আমাদের কারোরই ওষুধ একই রকম ছিল না। ফলে বিশেষজ্ঞ ডাক্তারের পরামর্শ ছাড়া ওষুধ গ্রহণ করা যাবে না। এ ছাড়াও আমরা সবাই সার্বক্ষণিক মুখে মাস্ক পরে থাকতাম।

ভবনের ভেতরে এভাবেই বাঁশ দিয়ে ব্যারিকেড দেওয়া হয়েছে, যেন সবাই সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখে লাইন ধরে ডাক্তারের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে পারে।
ভবনের ভেতরে এভাবেই বাঁশ দিয়ে ব্যারিকেড দেওয়া হয়েছে, যেন সবাই সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখে লাইন ধরে ডাক্তারের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে পারে।

আমরা প্রতিবারই কোভিড-১৯ পরীক্ষা করিয়েছি বিএসএমএমইউয়ের ফিভার ক্লিনিক থেকে। এটি সরকারি এবং এর ব্যবস্থা খুবই ভালো। আমার জানামতে বাংলাদেশের আর কোনো সরকারি হাসপাতালই এক দিনের মধ্যে কোভিড-১৯–এর পরীক্ষার ফল দেয় না। প্রতিদিন সকাল ৮টা থেকে ৮টা ৩০মিনিটের মধ্যে পরের দিনের অ্যাপয়েন্টমেন্টের জন্য নিবন্ধন করা যায়। প্রচুর মানুষের চাপ থাকায় খুব দ্রুতই প্রতিটা স্লট পূরণ হয়ে যায়। ফলে দ্রুতই ফর্মটা পূরণ করতে হয়। যেদিন আমরা ঠিক করতাম পরীক্ষা করাব, তার আগের দিন সকাল আটটা থেকেই আমাদের ফোন হাতে নিয়ে প্রস্তুত থাকতে হতো, যেন ফর্ম খোলার সঙ্গে সঙ্গেই আমরা নিবন্ধন করতে পারি। ফিভার ক্লিনিকের নিবন্ধন লিংক তোমরা পাবে এখানে

সজিব-উজ-জামান
সজিব-উজ-জামান

যেহেতু আমাদের দেশে করোনা–পরিস্থিতির তেমন কোনো উন্নতি এখন পর্যন্ত হয়নি, তাই এখনো বাসায় থাকা ও সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখার কোনো বিকল্প নেই। তবে দুর্ভাগ্যবশত আক্রান্ত হয়ে গেলেও, মানসিকভাবে ভেঙে না পড়ে চিকিৎসকের পরামর্শ মেনে চললেই এই ভাইরাস থেকে আরোগ্য লাভ করা সম্ভব।