মুক্তির আনন্দ

৮ সেপ্টেম্বর ২০১৪, প্রথম আলো
৮ সেপ্টেম্বর ২০১৪, প্রথম আলো

শুরুতে শেষের গল্প।
দিনটি ছিল এ বছরের ৮ সেপ্টেম্বর। চট্টগ্রামের নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল-২-এর ভারপ্রাপ্ত বিচারক মো. জাকির হোসেন নির্দেশ দিলেন জসিম উদ্দিন আজ থেকে ‘মুক্ত’। দুই অক্ষরের শব্দটি যেন পাল্টে দিল জসিমের জীবন। কাঠগড়ায় থাকা জসিম ঝরঝর করে কেঁদে দিলেন। এর আগেও কেঁদেছেন তিনি। কিন্তু সেই কান্না ছিল বিনা দোষে কারাবাসের। আর এই কান্না আনন্দের, মুক্তির আনন্দের। কে এই জসিম? কেনই বা তাঁর মুক্তির কথা?
পাঠক এবার একটু পেছনে যেতে হবে।
জসিম উদ্দিন নামের এক হাজতি থাকতেন চট্টগ্রাম কেন্দ্রীয় কারাগারের মেঘনা ভবনে। তিনি জানতেন না কী তাঁর অপরাধ। তাঁর কান্না দেখে অন্য বন্দীদেরও চোখের পানি এসে যেত।
ওখানে থাকা রবিউল ইসলাম নামের এক হাজতি বিষয়টি ১ সেপ্টেম্বর চট্টগ্রাম কেন্দ্রীয় কারাগারের জ্যেষ্ঠ তত্ত্বাবধায়ক মো. ছগির মিয়াকে জানান। আদালতে হাজিরা দিতে গেলে বিষয়টি এক পুলিশসদস্যকেও জানান ওই হাজতি।
পরদিন দুপুরে চট্টগ্রাম আদালতে যাই হিমাদ্রী হত্যা মামলার শুনানি ও সন্ত্রাসী বাবরের মামলা নিয়ে প্রতিবেদন তৈরির জন্য। সেদিন ওই পুলিশসদস্যের কাছ থেকে জসিমের কারাভোগের ঘটনা প্রথম জানতে পারি। তখনই কারা তত্ত্বাবধায়ক ছগির মিয়ার সঙ্গে ফোনে যোগাযোগ করি। তিনিও জানালেন, জসিম নামের লোহাগাড়ার এক ব্যক্তির নামের মিল থাকায় কারাভোগ করছেন।
ফোনের লাইন কেটে দিয়ে মোটরসাইকেল নিয়ে আদালত থেকে কারাগারে যাই। কারা রেজিস্টারে থাকা জসিমের নাম-ঠিকানা সংগ্রহ করি। জানতে পারি মামলার ধার্য দিন থাকায় জসিমকে আদালতে পাঠানো হয়েছে। তাঁর স্ত্রী নাসিমা আক্তারের মুঠোফোন নম্বরও সংগ্রহ করি। কারাগার থেকে বের হয়ে নাসিমা আক্তারকে ফোন করি। কাঁদতে কাঁদতে তিনিও বললেন, তাঁর স্বামীকে পুলিশ ধরে নিয়ে গেছে। তাঁর এক আত্মীয় জামিনের চেষ্টা করছেন।
কারাগার থেকে মামলা নম্বর নিয়ে আবার ফিরে আসি আদালত ভবনে। ভবনের নিচতলায় জেলা হাজতখানার হাবিলদার আবদুর রবকে জিজ্ঞেস করি, লোহাগাড়া থানার নারী নির্যাতন মামলায় জসিম নামের কোনো আসামি হাজতখানায় আছেন কি না। উত্তরে পুলিশ জানায়, জসিম হাজতখানায় আছেন। সেখানে গিয়ে দেখলাম, পরনে চেক শার্ট ও লুঙ্গি। হাতে হাতকড়া। চোখে আতঙ্ক। নাম জানতে চাইলে হু হু করে কেঁদে উঠেছিলেন চল্লিশোর্ধ্ব জসিম উদ্দিন। বললেন, তাঁর বিরুদ্ধে থানায় কোনো মামলা নেই। বাড়িতে চার ছেলেমেয়ে ও স্ত্রী না খেয়ে আছেন। কারণ, তিনি গাড়ি (সিএনজিচালিত অটোরিকশা) চালালে ঘরে বাজার-সদাই হয়। নইলে না খেয়ে থাকতে হয়।
এসব কথা বলতে না-বলতে আবারও কাঁদতে শুরু করেন জসিম। দুই-তিন মিনিট পর কান্না থামে। বুকে চাপা কষ্ট নিয়ে বলতে থাকেন, ‘আমি জেলে। কীভাবে মুক্তি পাব? ঘরে টাকাপয়সা নেই। পুলিশ আমার মতো গরিবকে কেন ধরে জেলে ঢুকিয়েছে?’
কীভাবে কারাগারে এলেন সেই ঘটনার বর্ণনা দিয়ে জসিম জানালেন, তিনি চট্টগ্রামের লোহাগাড়া উপজেলার দরবেশহাট এলাকার আবুল হোসেনের ছেলে। একই উপজেলার পারভীন আক্তার নামের এক নারী গত বছরের সেপ্টেম্বরে তাঁর স্বামী মৃত আবুল কাশেমের ছেলে জসীম উদ্দিনের বিরুদ্ধে আদালতে যৌতুকের মামলা করেন। আদালত পারভীনের স্বামী জসীম উদ্দিনের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেন।
কিন্তু ৩১ আগস্ট পুলিশ পারভীনের স্বামীর বদলে তাঁকেই গ্রেপ্তার করে আদালতে পাঠান। আদালত তাঁকে কারাগারে পাঠানোর নির্দেশ দেন। সেদিন থেকে শুরু হলো কারাজীবন।
এরই মধ্যে মামলার বাদী পারভীন আক্তারের সঙ্গে যোগাযোগ করি। তিনি জানান, তাঁর স্বামী জসীম উদ্দিন তো এলাকায় ঘোরাফেরা করছেন। পুলিশ অন্য জসীমকে ধরেছে।
গত ৮ সেপ্টেম্বর ‘পুলিশের ভুলে কারাবাস’ শিরোনামে প্রথম আলো তে জসিমের ছবিসহ প্রতিবেদন ছাপা হয়। ওই দিনই নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল-২-এর ভারপ্রাপ্ত বিচারক মো. জাকির হোসেন প্রথম আলো তে প্রকাশিত প্রতিবেদনের সত্যতা পেয়ে জসিমকে মুক্তির নির্দেশ দেন।
আদেশ শোনার পর আসামির কাঠগড়ায় থাকা জসিম কান্নায় ভেঙে পড়েন। আদালতের কার্যক্রম শেষ হওয়ার পর বারান্দায় এসে জসিম আমাকে জড়িয়ে ধরেন। বলতে থাকেন, ‘ প্রথম আলো আমাকে মুক্তির ব্যবস্থা করেছে। আল্লাহর কাছে দোয়া করি প্রথম আলো র জন্য।’ তখন জসিমের স্ত্রী নাসিমাও আনন্দে কাঁদছিলেন। তিনি প্রথম আলো কে ধন্যবাদ জানান। শুধু জসিম ও তাঁর স্ত্রীই নন, অনেক পাঠকও অফিসে ফোন করে আমাদের ধন্যবাদ জানিয়েছেন।
গাজী ফিরোজ: নিজস্ব প্রতিবেদক, চট্টগ্রাম