একটি দুর্গম পথ চলার গল্প

ছেলে আদিতের সঙ্গে মা ফারহানা এ রহমান। ছবি: সংগৃহীত
ছেলে আদিতের সঙ্গে মা ফারহানা এ রহমান। ছবি: সংগৃহীত

অটিজম এখনকার সময়ের বহুল আলোচিত একটি শব্দ। এ শব্দটি আমার জীবনের সঙ্গে শাব্দিক অর্থে নয়, প্রকৃত অর্থেই জড়িয়ে আছে বহু বছর ধরে। ঠিক ১৯ বছর আগে প্রথম শুনেছি অটিজম শব্দটি। যেদিন চিকিৎসক বলেছিলেন, আদিত অটিজমে আক্রান্ত শিশু। এর মানে বোঝার কোনো পথ সে সময় ছিল না। এরপর সমাজ এবং জীবন আমাকে একটু একটু করে জানিয়েছে এর মানে।
আমি যেহেতু ২০ বছর বয়সী আদিতের মা, তাই আজকে প্রাপ্তবয়স্ক আদিতের পারিপার্শ্বিকতা ও প্রাসঙ্গিক কিছু কথা বলব। আদিত আর আমি একা নই কিন্তু নিঃসঙ্গ। এভাবেই এই লম্বা সময় পাড়ি দিয়েছি। আদিত কথা বলে মনোভাব প্রকাশ করতে পারে, নিজের দৈনন্দিন সব কাজ নিজেই করে। সে রকম কিছুই করে দিতে হয় না। মোবাইল ফোনের সব ফিচার ওর মুখস্থ, আলাদা করে কখনো শিখাইনি। কম্পিউটার দিয়ে গ্রাফিকস বা ডকুমেন্ট কম্পোজ, কোনো ব্যাপার না। ও আমার ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানেই কাজ করে।
তাহলে প্রশ্ন আসতেই পারে সমস্যা কোথায়? বাইরে থেকে দেখা অটিজম আর এর ভেতরে বসবাস করা—দুটো ভিন্ন ব্যাপার। এবার ভেতরের কিছু কথা বলি যা খালি চোখে দেখা যায় না। অটিস্টিক মানুষেরা আমাদের মতোই। ওদের জীবন নিয়ে ভাবার ক্ষমতা আছে। অধিকারও আছে। তবে ওদের সম্ভাবনা শৃঙ্খলিত। মনে করার কোনো কারণ নেই যে ওরা তার কিছু বুঝতে পারে না। ওদের সম্পর্কে যেকোনো নেতিবাচক আচরণে ওরা ভীষণভাবেই কষ্ট পায়। পার্থক্য হলো সেই আচরণের জবাবে ওরা যা-ই করুক নিতান্তই পাগলামি আর অস্বাভাবিকতা। বাবা-মা ছাড়া ওদের সহমর্মী কেউ নেই। ওদের কোনো বন্ধু নেই। আত্মীয়স্বজনদের কাছে বারবার ফোন করা খুব অন্যায় বলে ধরা হয়। ‘কেন এত বার ফোন করবে, ওর তো গুছিয়ে কথা বলার ক্ষমতা নেই।’ তাই বলে কি ওর কথা বলতে চাওয়ার ক্ষমতাও নেই। এই সমস্যার সমাধান হলো সেই মানুষের নম্বরটা ব্লক করা বা ফোন না ধরা।
ওপর দিয়ে কিন্তু ওই আত্মীয়ের ভালোবাসার কোনো শেষ নেই। আমি বলছি না বারবার ফোন এলে বিরক্ত হওয়ার কিছু নেই। এই সমস্যা অনেকভাবেই সমাধান করা যায়। কিন্তু আমরা খুব কাছের মানুষেরা আদিতদের ওইটুকু বোঝার সময় দিতে চাই না। সমাজ যতই অটিস্টিক বাচ্চাদের সহমর্মিতার জন্য সহমর্মিতার কথা বলুক না কেন। এখনো দাওয়াত দেওয়ার সময় বারবার করে বলবে, আপনার মেয়েকে অবশ্যই নিয়ে আসবেন। ওই সম্পূর্ণ আলাপচারিতায় আমার ছেলে যেন একটি অদৃশ্য চরিত্র। হয়তো আমার ছেলে ওই দাওয়াতে যাওয়ার জন্য ২ সপ্তাহ ধরে প্রস্তুতি নিয়ে বসে আছে। কী করার আছে মা-বাবা হিসেবে এই পরিস্থিতিতে?
বিয়েবাড়িতে অনেক সময় এমন কথাও বলতে শুনেছি, একটি অটিজমে আক্রান্ত মেয়ে যার বউ সাজার খুব শখ, কিন্তু তাকে বউয়ের কাছে যেতে দেওয়া হবে না। এমন মানুষের উপস্থিতি নতুন বউয়ের জন্য নাকি অমঙ্গল বয়ে আনতে পারে। আসলেই কি তাই? আমরা নিজেকে কি প্রশ্ন করেছি, কাল আমার এ রকম বাচ্চা হতে পারে কি না? আজ পর্যন্ত অটিজমের কোনো কারণ খুঁজে পাওয়া যায়নি। আসলে কাল কোনো বাচ্চা অটিজম নিয়ে জন্মালে অবাক হওয়ারও কিছু নেই।
আদিতরাও প্রতিনিয়ত স্বপ্ন দেখে, ওদের অনেকেরই বিশেষ ক্ষমতা আছে। আবার অনেকেরই তেমন কোনো কিছু করার ক্ষমতা নেই। অটিজমের কথা এলেই আইনস্টাইনের কথা আসে, তাঁর সফলতা নিয়ে আমরা কথা বলি, কিন্তু তাঁর জীবনেও অনেক সমস্যা ছিল, অটিজমে আক্রান্ত একজন মানুষ হিসেবে। আমরা কখনো আইনস্টাইনের মা-বাবার পথচলা নিয়ে কথা বলি না। অটিজম একটি দুর্গম পথ চলার গল্প; যেখানে সফলতা বাড়তি পাওয়া। পথ চলাটাই খুব কঠিন।