ক্যানসার চিকিৎসা কি সঠিকভাবে চলছে?

ক্যানসারের সামাজিক পরিচিতি হচ্ছে, এটি একধরনের দূরারোগ্য ব্যাধি। কথাটি বহুলাংশে সত্যি নয়। বর্তমানে চিকিৎসার মাধ্যমে বেশ কিছু ক্যানসার নিরাময়যোগ্য। নিয়মিত গবেষণালব্ধ ফলাফলের কারণে ক্যানসার রোগীরা নতুন করে আশাবাদী হয়ে উঠতে পারেন। স্তনের ক্যানসার, ওভারির ক্যানসার, বৃহদন্ত্রের ক্যানসার, থাইরয়েড ক্যানসার—এ ধরনের অনেক নিরাময়যোগ্য ক্যানসারের নাম উল্লেখ করা যাবে।

পরিবারের কোনো সদস্যের ক্যানসার ধরা পড়েছে এমন সংবাদ পরিবারটির ভবিষ্যৎকে লন্ডভন্ড করে দিতে পারে। রাতারাতি পরিবারটিকে তাদের জীবন পরিকল্পনা পাল্টাতে হয়। চিকিৎসক যদি এমন মুহূর্তে পরিবারের সদস্যদের ওই ক্যানসার রোগীর সম্ভাব্য চিকিৎসার ফলাফল সম্পর্কে অবহিত করেন, তাহলে পরিবারটি এ ব্যাপারে সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে সক্ষম হবে। বেশির ভাগ ক্যানসারের চিকিৎসা ব্যয়বহুল। রোগীর বয়স ও মানসিক অবস্থা জেনে বিভিন্ন প্রক্রিয়ায় রোগীকেও তার রোগ সম্পর্কে অবহিত করতে হবে। ক্যানসার চিকিৎসায় চিকিৎসকের পরিকল্পনা সর্বশেষ সিদ্ধান্ত হতে পারে না। রোগীর আর্থসামাজিক অবস্থা, তার বয়স এ ধরনের বস্তুগত বিষয়ের সঙ্গে চিকিৎসকের পরিকল্পনাকে খাপ খাওয়াতে হবে।

যেমন একটি পরিবারের কর্তাব্যক্তির ক্যানসার ধরা পড়ল। আদর্শিক চিকিৎসায় তাঁর জমানো টাকা শেষ করে এক টুকরো জমিও তাঁকে বিক্রি করতে হবে। চিকিৎসা ব্যয় মেটাতে গেলে পরিবারের ছেলেমেয়েদের ভবিষ্যৎ লেখাপড়া ও দৈনন্দিন ব্যয় মেটানোর ক্ষমতাও অবশিষ্ট থাকবে না। কিন্তু চিকিৎসায় রোগও ভালো হবে না। এমন পরিস্থিতিতে পরিবারের সদস্যরা কী সিদ্ধান্ত নেবেন?

শুধু এই প্রশ্নটির উত্তর খুঁজতে গেলে পরিবারের সদস্যদের একমত হওয়া কঠিন। এমন পরিস্থিতিতে চিকিৎসক পরিবারটিকে সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে সাহায্য করবেন। ক্যানসার চিকিৎসায় কিছু মাপকাঠি সম্পর্কে রোগী ও তার পরিবারকে জানাতে হবে। নিরাময়যোগ্য ক্যানসার বলতে কী বোঝায়? ক্যানসারের ক্ষেত্রে নিরাময় বলতে বোঝায়, রোগী কমপক্ষে পাঁচ বছর রোগমুক্ত থাকবেন।

ক্যানসার চিকিৎসার আদর্শগত ধরন ও গাইডলাইন কী? একজন রোগীকে একজন চিকিৎসকই সব সিদ্ধান্ত নেবেন নাকি একটি মেডিকেল বোর্ডের মাধ্যমে চিকিৎসার সিদ্ধান্ত গৃহীত হবে। ধরা যাক একজনের কোলন ক্যানসার ধরা পড়েছে। তিনি উন্নত চিকিৎসার জন্য মুম্বাই টাটা মেমোরিয়াল হাসপাতালে গেলেন। রোগনির্ণয় সঠিক হয়ে থাকলে তাঁর জন্য একটি মেডিকেল বোর্ড গঠিত হবে। রোগের বর্তমান অবস্থার ওপর ভিত্তি করে চিকিৎসা নির্ধারিত হবে। এই মেডিকেল বোর্ডকে সাধারণত টিউমার বোর্ড বলা হয়। এখানে সার্জন, মেডিকেল অনকোলজিস্ট, রেডিয়েশন অনকোলজিস্ট প্রয়োজনে প্যাথলজিস্ট থাকবেন। রোগের চিকিৎসার প্রথম পদক্ষেপ কী হবে, অপারেশন নাকি কেমোথেরাপি ওষুধ দিয়ে ক্যানসার চিকিৎসা, নাকি রেডিওথেরাপি (সেঁক) দেওয়া হবে, সেটি ঠিক করা হবে। এটি ক্যানসারের মানসম্মত আধুনিক চিকিৎসার স্বরূপ।

চিকিৎসায় সিদ্ধান্ত নিতে গেলে কয়েকটি প্রশ্ন এসে দাঁড়ায়। কে আগে চিকিৎসা শুরু করবেন। যেমন কোলন ক্যানসার প্রাথমিক পর্যায়ে। সার্জন বললেন শুধু অপারেশনই যথেষ্ট, অনকোলজিস্ট বললেন অপারেশনের পর স্টেজিং অনুযায়ী কেমোথেরাপি বা রেডিওথেরাপি (সেঁক) লাগতে পারে।

আবার ধরা যাক, আরেকজন রোগীর কোলন ক্যানসার ইতিমধ্যে ছড়িয়ে গেছে। টিউমার বোর্ডের আলোচনার জেরে অনকোলজিস্ট বলবেন এই রোগীকে আগে কেমোথেরাপি বা কেমোরেডিও থেরাপি দিয়ে পরে অপারেশন করতে হবে। আবার অন্য কিছু ক্যানসার আছে, যেখানে অনকোলজিস্ট বলবেন এই রোগীর অপারেশন লাগবে না। কেমোরেডিও থেরাপি দিলেই হবে। সার্জন বললেন, না, এ রোগীর অপারেশনই লাগবে। রোগী কোথায় যাবে? দুই ধরনের বিশেষজ্ঞ দুই রকমের মতামত দিচ্ছেন। কিন্তু এই বিশেষজ্ঞরা টিউমার বোর্ডে বসে এ রকম দ্বিধাবিভক্ত চিকিৎসার পরামর্শ দিতে পারবেন না। তাঁদের ঐকমত্যে পৌঁছাতে হবে।

আমাদের দেশে রোগী হয় সার্জনের চেম্বারে যাবেন অথবা অনকোলজিস্টের চেম্বারে যাবেন কিংবা সরকারি হাসপাতালের বহির্বিভাগে পৌঁছালেন। ক্যানসারের আধুনিক ও সর্বসম্মত চিকিৎসা টিউমার বোর্ডের সুযোগ থেকে অধিকাংশ রোগী বঞ্চিত হন।

দেশের ক্যানসার চিকিৎসাপদ্ধতির আধুনিকায়ন হওয়া জরুরি হয়ে পড়েছে। নতুবা রোগী সুচিকিৎসার ফলাফল লাভে ব্যর্থ হবেন।

লেখক: অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান, সাউদার্ন মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল, চট্টগ্রাম