মাটির ঘরে দেশি ঘ্রাণ

ইট-কংক্রিটের শহরে দমটা আটকে আসছিল। ইচ্ছে করছিল, দেয়ালচিত্রের সুবোধের মতো পালিয়ে যাই। এমন কোথাও, যেখানে কৃত্রিমতা নয়, স্বাগত জানাবে প্রকৃতি। শুনলাম, একটা জায়গা আছে, নাম ‘মাটির ঘর’। আধুনিকতার ছোঁয়ায় যখন গ্রামে আর মাটির ঘরের তেমন দেখা মেলে না, তখন এমন নাম শুনে কৌতূহল জাগল। জায়গাটাও ঢাকা থেকে কাছেই, গাজীপুরের কালীগঞ্জে।

তো ছুটির দিনে ছুটলাম সেই মাটির ঘরের দিকে। ঢাকা থেকে ৩০০ ফুট দিয়ে কাঞ্চন ব্রিজের আগে হাতের বাঁয়ে মোড় নিয়ে আমাদের গাড়ি ছুটে চলল। সোজা ১৫-২০ মিনিট পথ পাড়ি দিয়ে পৌঁছে গেলাম গন্তব্যে। গাছগাছালিঘেরা প্রকৃতি যেন আমাদের অপেক্ষায় ছিল। সাদরে আমন্ত্রণ জানাল। গাছের সুশীতল ছায়ায় বসে প্রাণটা জুড়িয়ে গেল।

‘মাটির ঘর’ রেস্তোরাঁর অবস্থান গাজীপুরের কালীগঞ্জে।
‘মাটির ঘর’ রেস্তোরাঁর অবস্থান গাজীপুরের কালীগঞ্জে।

এরপর সেই মাটির ঘরে প্রবেশ। এটি রেস্তোরাঁ, একেবারে পরিবেশবান্ধব। বসার ব্যবস্থা কাঠের গুঁড়ির ওপর। টেবিল বানানো মোটা গাছ লম্বালম্বি চিরে। টেবিলে টেবিলে রাখা মাটির জগভর্তি পানি আর মাটির গ্লাস। ঘরে যেন পর্যাপ্ত আলো আসে এবং সেই আলো যাতে ভালো করে খেলে যায়, সে আয়োজন করা হয়েছে সযত্নে। মুহূর্তের মধ্যেই কেমন যেন একটা ফ্ল্যাশব্যাক হলো! মন চলে গেল শৈশবের স্মৃতিতে, মাটির ঘরে।

রেস্তোরাঁর ভেতরে বসার ব্যবস্থা কাঠের গুঁড়ির ওপর। টেবিল বানানো মোটা গাছ লম্বালম্বি চিরে।
রেস্তোরাঁর ভেতরে বসার ব্যবস্থা কাঠের গুঁড়ির ওপর। টেবিল বানানো মোটা গাছ লম্বালম্বি চিরে।

নামটা ‘মাটির ঘর’ কেন?
স্বত্বাধিকারী জাকারিয়া আকন্দ বিপ্লবকে সামনে পেয়ে প্রশ্নটা করার লোভ সামলাতে পারলাম না। জানালেন, ছোটবেলা থেকেই মাটির ঘরের প্রতি তাঁর একটা অন্য রকম টান। সে টানেই ২০১৫ সালের জানুয়ারি থেকে মাটি দিয়ে ঘর বানানোর কাজ শুরু করেন তিনি। আশপাশের লোকজন ভেবেছিলেন, পাগলামি। কিছুদিন পরই থেমে যাবেন। তবে তিনি থামেননি। বরং তত দিনে লোকমুখে ‘মাটির ঘর’ নামটা ছড়িয়ে পড়ে। ফিউশনধর্মী নকশায় মাটি দিয়ে বানানো ঘরটির নাম রাখেন তিনি ‘মাটির ঘর’।

রেস্তোরাঁ প্রাঙ্গণের চিত্র।
রেস্তোরাঁ প্রাঙ্গণের চিত্র।

এই রেস্তোরাঁর বিশেষত্ব কী? মানুষ এখানে কেন আসবে?

উত্তরে জাকারিয়া জানালেন, মাটির বাড়ি মানুষের মধ্যে একধরনের স্মৃতিকাতরতা তৈরি করে। কেমন যেন একটা ভালো লাগার আবেশ কাজ করে। প্রকৃতির সঙ্গে খানিকটা সময় কাটিয়ে মনটাও ভালো হয়। এই ভালো লাগাটা আরও বাড়িয়ে দিতে আগত ব্যক্তিদের জন্য আছে সুস্বাদু নানা পদের খাবার। সবই প্রাকৃতিক চাষের ফসল আর টাটকা। মাটির ঘরে বসে মাটির থালা-বাটিতে করে গ্রামীণ স্বাদের খাবার খাওয়ার আনন্দ—এই রেস্তোরাঁর অনন্য বিশেষত্ব। নাগরিক কোলাহল ছেড়ে প্রকৃতির সান্নিধ্যে হাত-পা ছড়িয়ে-ছিটিয়ে প্রিয়জনের সঙ্গে গল্প করার এমন আয়োজন কার না ভালো লাগবে!

এ বছরের পয়লা বৈশাখ রেস্তোরাঁ হিসেবে যাত্রা শুরু তাদের। মূল খাবারে থাকে দেশি লাল চালের ভাত, চিনিগুঁড়া চালের খুদের চচ্চড়ি, চাপা শুঁটকির ভর্তাসহ কয়েক পদের ভর্তা, পাঁচমিশালী সবজি, তিনপদী ডাল, মাছ, দেশি মুরগির মাংস, রাজহাঁস। খাবারের দাম বেশ কম। এ ছাড়া ফুলপিঠা, পাটিপিঠা, শামুকপিঠার পাশাপাশি থাকে দইয়ের লচি আর মৌসুমি ফলের জুস। রেস্তোরাঁটি প্রতিদিন সকাল ১০টা থেকে সন্ধ্যা ৭টা পর্যন্ত খোলা থাকে। ছুটির দিনগুলোতে ভিড় একটু বেশি থাকে, তাই তাদের ফেসবুক পেজে ঢুকে আগে থেকে বুক করে গেলে ভালো।

মাটির ঘরে বসে গ্রামীণ খাবারের স্বাদ।
মাটির ঘরে বসে গ্রামীণ খাবারের স্বাদ।

রাজধানীর একটি বেসরকারি ব্যাংকের কর্মকর্তা শায়লা পারভীন পরিবারের সদস্য ও বন্ধু-বান্ধবকে এসেছেন। মাটির ঘরে বসে গ্রামীণ খাবার খেয়ে তাঁরা সবাই খুশি বলে জানালেন।

আট বন্ধুর একটা দলের সঙ্গে দেখা। তাদের একজন উত্তরা থেকে আসা মতিউর ‘মাটির ঘর’ নিয়ে বেশ উচ্ছ্বাস দেখালেন। খাবারের পাশাপাশি প্রশংসা করলেন এমন উদ্যোগেরও। উল্লেখ্য, উত্তরা থেকে আবদুল্লাহপুর বেড়িবাঁধের রাস্তা দিয়ে উলুখোলা বাজার পর্যন্ত গিয়ে ১০ মিনিটের পথ পাড়ি দিলেই পৌঁছানো যাবে এই রেস্তোরাঁয়।

পেটভরে খেয়েদেয়ে দোলনায় দুলতে পারেন। কিংবা জিরিয়ে নিতে পারেন গাছতলায় রাখা গাছের গুঁড়িতে বসে। ঘুরতে চাইলে কাছাকাছি দূরত্বে থাকা পর্তুগিজদের বানানো সাধু নিকোলাস ও সাধু আন্তুনির গির্জায় যেতে পারেন। কাছাকাছি কোথাও হাঁটাহাঁটি করতে চাইলে চলে যেতে পারেন রেস্তোরাঁর উল্টো দিকে। সেখানে টাটকা শাকসবজি আর মৌসুমি ফল নিয়ে বসে থাকেন আশপাশের বিক্রেতারা। দেখলে না কিনে থাকা যায় না।

রেস্তোরাঁর উল্টো দিকে টাটকা সবজি আর ফল নিয়ে বসে থাকেন আশপাশের বিক্রেতারা।
রেস্তোরাঁর উল্টো দিকে টাটকা সবজি আর ফল নিয়ে বসে থাকেন আশপাশের বিক্রেতারা।

সারা দিন কাটিয়ে ফেরার সময় সঙ্গী হয় সুন্দর কিছু স্মৃতি। পেছনে পড়ে থাকে সোঁদা মাটির গন্ধমাখা ছোটবেলা!