রিকশাচিত্রে জীবনের রং

সাজানোর সময় রঙিন নকশার পণ্যের সঙ্গে দেশি পণ্যই মানাবে
সাজানোর সময় রঙিন নকশার পণ্যের সঙ্গে দেশি পণ্যই মানাবে

রঙিন এক দেশ। সেখানে মানুষেরাও রঙিন। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় অস্ট্রেলীয় শিক্ষক ব্রায়ান শুসমিথ বলেছিলেন বাংলাদেশ সম্পর্কে। তিনি নাকি খুব কম দেশেই এত রঙের ব্যবহার দেখেছেন। কথাটা মিথ্যে নয়। যাতায়াতের বাহন রিকশার কথাই ধরা যাক। খেয়াল করলে দেখবেন চোখ সরানো যায় না, এমনই তার নকশা। রঙিন নকশার এই ছোঁয়া চলে এসেছে আমাদের ঘরের মধ্যেও। বেশ কয়েক বছর ধরেই ঘর সাজানোর বিভিন্ন জিনিসের ওপর রিকশার নকশা ফুটিয়ে তোলা হচ্ছে। ব্যতিক্রম পছন্দ করেন এমন অনেকেই এসব জিনিসের মাধ্যমে ঘর সাজাচ্ছেন ও ব্যবহার করছেন। দেশীয় ছোঁয়া তো পাওয়া যায়-ই, ভিন্নতাও চলে আসে অন্দরসাজে।

রিকশা ও লোকজ নকশা উঠে এসেছে অন্দরসাজের বিভিন্ন পণ্যে। ছবি: নকশা
রিকশা ও লোকজ নকশা উঠে এসেছে অন্দরসাজের বিভিন্ন পণ্যে। ছবি: নকশা

রিকশা পেইন্টের বাইরে লোকজ মোটিফেও নকশা করা হচ্ছে। গ্রাম-বাংলার বিভিন্ন গল্প, মিথ, প্রচলিত কাহিনিও তাতে ফুটে উঠছে। বিয়ের সময় সুটকেসের বদলে অনেক কনেই এখন ট্রাঙ্ক বা কাঠের বাক্সে করে কাপড় নিয়ে যাচ্ছেন। ট্রাঙ্কের ওপর ফুটিয়ে তুলছেন এসব নকশা। ঘর সাজানোর বিভিন্ন জিনিসের ওপরও যে এ ধরনের নকশা করা যায়, এ ধারণাটা প্রথম পাওয়া যায় যাত্রার কাছ থেকেই। ১৯৯৯ সাল থেকে যাত্রার যাত্রা শুরু। প্রায় প্রথম থেকেই বিভিন্ন পণ্যের মধ্যে এই নকশা তুলে ধরেন চিত্রকরেরা। যাত্রার ডিজাইনাররা জানালেন, এ ভাবনার অনুপ্রেরণা আসে বাংলাদেশ থেকেই। এই দেশের নিজস্ব সংস্কৃতি হিসেবেই গড়ে ওঠে রিকশা পেইন্টিং। তাঁরা সেটাকে ধরে রাখতে এবং পরিচিত করাতেই এই নকশা তুলে ধরেন বিভিন্ন পণ্যের মধ্যে।

ফুলের টব, চেয়ার, টেবিল, কেটলি, টেবিল ল্যাম্প, পর্দা, বুকস্ট্যান্ড, চায়ের কাপ যেকোনো জিনিসেই এই নকশা করা যায়। বাদ যাচ্ছে না ঘরের দেয়ালও। অন্দরসজ্জায় হঠাৎ করেই যেন রঙিন নকশা কথা বলে উঠছে। এই নকশা যেটাতেই থাকুক না কেন, উপেক্ষা করা অসম্ভব। মন আপনা-আপনি ঘুরে বেড়াতে থাকবে রঙের ভুবনে।

ঢাকার বিভিন্ন দোকানে পাওয়া যাচ্ছে এ ধরনের পণ্য। যাত্রা, কে-ক্র্যাফট অন্যতম। তবে চাইলে নিজের পছন্দমতো পণ্যের ওপরও তুলির আঁচড় দিতে পারেন। পুরান ঢাকায় ঢুঁ মেরেছিলাম চিত্রকরদের খোঁজে। এক জায়গায় পাবেন না। জায়গায় জায়গায় ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছেন রিকশার নকশাকারকেরা। চকবাজারে হোসেন দালান রোডে মো. হানিফ পাপ্পুকে সবাই একনামে চেনে। যেকোনো জিনিসের ওপর তিনি ফুটিয়ে তোলেন রিকশার নকশা। ৪০ বছরের বেশি সময় ধরে এই কাজ করছেন। জিনিসভেদে দাম নির্ধারণ করা হয়। অ্যাক্রিলিক, গ্লাস পেইন্টিং, অ্যানামেল রং ব্যবহার করে থাকেন। আগা সাদেক রোডে মো. কাশেম নিজ মনে রিকশার ওপর ফুল, লতা, পাখি আঁকছিলেন। কাজের মধ্যেই কথা বললেন। জানালেন ৩৫ বছর ধরে কাজ করে যাচ্ছেন। এই পেশায় এখন আছেন হাতে গোনা কয়েকজন। অনেক রিকশার পুরোটায় এখন আর হাতে নকশা করাও হয় না। টিনের পাতের ওপর ছাপা নকশার কাজও হচ্ছে অনেক। সেগুলো রিকশার পেছনে নিচে, দুই চাকার মাঝখানে বসানো হয়। তিনি জানালেন ফরমাশ এলে বিভিন্ন জিনিসের ওপর এ ধরনের নকশা করে থাকেন।

রিকশাগুলো বেরঙের হয়ে যাচ্ছে দেখেই মনে হয় বাড়ির ভেতরটা এখন রঙিন হয়ে উঠছে। যাত্রার ডিজাইনার টিম এমনটাই মনে করে।

অনলাইনেও কিন্তু এই দেশীয় নকশার বেশ চাহিদা। ওয়ান কালচার নামের অনলাইনভিত্তিক প্রতিষ্ঠানটি শুধু রিকশা পেইন্টের ওপরই কাজ করে যাচ্ছে। প্রতিষ্ঠাতা সুমায়না আবেদীন বললেন, ‘সবাই নতুনত্ব চায়। এই আর্টে আমি অদ্ভুত সৌন্দর্য খুঁজে পাই, যা বাড়ির যেকোনো জায়গাতে উজ্জ্বলতা বাড়িয়ে দেয়। মন খারাপ থাকলেও বিভিন্ন রং এবং আর্ট দেখে মন ভালো হয়ে যায়। অনেকেই ঐতিহ্য প্রদর্শন করতে চায়, এ কারণে হয়তো অন্দরসজ্জায় এর চাহিদাও বাড়ছে।’

অন্দরসজ্জায় এই জিনিসগুলো সাজানোর সময় কোনো নিয়মনীতি নেই। তবে দেশীয় নকশার এই রঙের সঙ্গে দেশীয় পণ্যই ভালো লাগবে। ঘরের যেকোনো একটি অংশ রাঙিয়ে নিতে পারেন এই লোকজ নকশায়। চাইলে দেয়ালে এই নকশার পাশে লোকজ পেইন্ট বাঁধিয়ে রাখতে পারেন। দেয়ালের নিচে বসার বড় বড় কুশনও সাজিয়ে রাখতে পারেন। মাটির হাতি, ঘোড়া শোভা বাড়িয়ে দেবে কুশনের পাশে রাখলে।