তাদের প্রতি আমার ভালোবাসা নেই

অধ্যাপক মেহতাব খানম
অধ্যাপক মেহতাব খানম

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এডুকেশনাল অ্যান্ড কাউন্সেলিং সাইকোলজি বিভাগের অধ্যাপক মেহতাব খানম। তিনি আপনার মানসিক বিভিন্ন সমস্যার সম্ভাব্য সমাধান দেবেন। অল্প কথায় আপনার সমস্যা তুলে ধরুন।—বি. স.

সমস্যা

ছোটবেলা থেকেই আমি সিদ্ধান্ত নেওয়ার ব্যাপারে দ্বিধাদ্বন্দ্বে ভুগি, বাস্তবতার চেয়ে আবেগকে প্রাধান্য দিই। কোনো কাজ করতে গিয়ে অনেক বেশি ভাবতে থাকি, খুঁটিনাটি খোঁজার চেষ্টা করি আর তখন কোনো নেতিবাচক বিষয় চলে এলে সে কাজের ব্যাপারে আগ্রহ হারিয়ে ফেলি। এই দ্বিধা ও আত্মবিশ্বাসের অভাবে অনেক সময় সিদ্ধান্ত নেওয়ার ব্যাপারে অন্যের ওপর নির্ভর করি। এ জন্য জীবনে অনেকবার ভুল সিদ্ধান্ত নিয়েছি। এমন ভুল সিদ্ধান্তের কারণে দুটো বিয়েও করেছি (একজনের সঙ্গে বিচ্ছেদ হয়েছে)।

এখন বুঝি তাদের শুধু সহায়তা দরকার ছিল, নিজেকে যুক্ত করার প্রয়োজন ছিল না। কারণ, তাদের প্রতি আমার কোনো ভালোবাসা নেই, সহানুভূতি ছাড়া। আমি এতে নিজের ওপর বিরক্ত। কারণ, আমি যেটা চাই, সেটা করতে পারি না। যেমন এখন পর্যন্ত নিজের লক্ষ্যও নির্ধারণ করতে পারিনি। কীভাবে আমি এই সমস্যাগুলো কাটিয়ে উঠতে পারব?

নাম ও ঠিকানা প্রকাশে অনিচ্ছুক

পরামর্শ

তুমি যে দেরিতে হলেও নিজের ব্যক্তিত্বের কিছু নেতিবাচক দিক চিহ্নিত করতে পেরেছ, সে জন্য তোমার অনেক প্রশংসা করছি।

দুর্ভাগ্যবশত আমাদের পারিবারিক চর্চায় শিশুসন্তানের মধ্যে আত্মবিশ্বাস ও সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা তৈরিতে তাকে আলাদাভাবে সাহায্য করা হয় না। বরং আমরা নিজেদের সিদ্ধান্ত ওদের ওপরে চাপিয়ে দিই। শিশুদের আমরা ছোট ছোট সিদ্ধান্ত নিতে মোটেও উৎসাহিত করি না।

কেউ যদি পাঁচ বছর বয়স হওয়ার আগেই সে কী খাবে বা কোন কাপড়টি পরবে, সেই সিদ্ধান্তগুলো নেওয়ার সুযোগ পায়, তখন তার মস্তিষ্ক থেকে নিজে নিজে ভাবার ক্ষমতা তৈরি হয়। এই বয়সের মধ্যে যেহেতু ব্যক্তিত্বের কাঠামোটি তৈরি হয়, সে জন্য তার মস্তিষ্ককে উদ্দীপিত করার দায়িত্বটি চারপাশের মানুষকে নেওয়া খুব প্রয়োজন। এ ছাড়া এতে করে শিশুটির মধ্যে আত্মবিশ্বাস ও আত্মসম্মানবোধও তৈরি হয়। এভাবে বিকশিত হতে থাকলে তাকে বড় হওয়ার পর এভাবে দ্বিধাদ্বন্দ্বে ভুগতে হয় না।

তুমি যে যথেষ্ট আত্মবিশ্বাসী হতে পারছ না, তার দায় কিন্তু শুধু তোমার একার নয়। পরিবার ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের দায়িত্ব হচ্ছে শুধু লেখাপড়া শেখানো নয়, শিক্ষার্থীকে জীবন দক্ষতাসম্পন্ন একটি সুনাগরিক হিসেবে গড়ে তোলা। তোমাকে হয়তো ছোটবেলা থেকে সব কাজ সুচারু বা সুনিপুণভাবে করতে বলা হতো। ভালো কাজের জন্য খুব উৎসাহিত করা হতো না বলে নিজেকেও তুমি খুব শ্রদ্ধা করে বড় হতে পারোনি। তাই তুমি এখন কোনো কিছু ঠিকমতো করা না হলে নিজেকে গ্রহণ করতে পারছ না এবং নেতিবাচকভাবে সমালোচনা করে ফেলছ। অনেক বেশি খুঁটিনাটি খুঁজতে গিয়ে মানসিকভাবে ক্লান্তও হয়ে পড়েছ। আত্মনির্ভরশীল হতে না পারার কারণে অন্যের ওপর নির্ভর করে পরে অপরাধবোধে ভুগছ।

তুমি খুব ভালোভাবে এখন বুঝতে পারছ, যে মেয়েগুলো তোমার ওপর নির্ভর করে কিছুটা মানসিক প্রশান্তি চেয়েছিল, তাদের সঙ্গে সম্পর্কের সীমারেখাটিও লঙ্ঘিত হয়েছে, তাদের অতিরিক্ত সময় দিয়ে দেওয়ার কারণে। এভাবে হয়তো তাদের ব্যক্তিগত জীবনে তোমার প্রবেশ ঘটেছে। তুমি এখন থেকে নিজের প্রতি সম্মানটি বাড়াও। অর্থাৎ তুমি যেমন আছ বা যা-ই ভুল করেছ, তারপরও নিজেকে গ্রহণ করে নাও। আর এই ভুলগুলো তোমাকে কী কী মূল্যবান শিক্ষা দিয়েছে, সেটির ওপর বেশি মনোযোগী হও। অতীতের ভুলগুলোর জন্য নিজেকে আর ক্ষতবিক্ষত কোরো না, কেমন?