শরীরী ভাষায় যায় বোঝা

মডেল: অর্ণব। ছবি: সুমন ইউসুফ
মডেল: অর্ণব। ছবি: সুমন ইউসুফ

‘আরে রফিক সাহেব, আসুন আসুন, বসুন। কেমন আছেন?’ কথাগুলো আনিস অনেক ভালো করেই বললেন তাঁর সাবেক সহকর্মী রফিককে। কিন্তু মুখে যা-ই বলুন না কেন আনিস সাহেবের চোখ আর দেহভঙ্গিই বলে দিল তিনি খুশি হতে পারেননি রফিককে দেখে। মনে মনে ভাবছেন ‘এই ব্যাটা, আবার বুঝি টাকা ধার চাইবে...।’
আবার দেখা গেল খুব কায়দা করে সাজিয়ে কথা বলছেন একটি প্রতিষ্ঠানের বিক্রয়কর্মী। কিন্তু তাঁর মুখভঙ্গি, হাতের নড়াচড়া আমাদের জানাচ্ছে, তিনি সত্য আড়াল করতে চাইছেন।

চোখের মুখের অভিব্যক্তিই বলে দেয় আপনি আনন্দে আছেন না কষ্টে আছেন?  মডেল: অর্ণব। ছবি: সুমন ইউসুফ
চোখের মুখের অভিব্যক্তিই বলে দেয় আপনি আনন্দে আছেন না কষ্টে আছেন? মডেল: অর্ণব। ছবি: সুমন ইউসুফ

কখনো কেউ হয়তো কোনো কথাই বলছে না, একেবারে চুপ, কিন্তু দাঁড়ানোর ভঙ্গি, মুখ আর হাত-পায়ের নড়াচড়া বলে দিচ্ছে তিনি এই জায়গায় মোটেই স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করছেন না, তাড়াতাড়ি বিদায় নিতে পারলেই খুশি। এভাবে প্রত্যেক মানুষ তার উচ্চারিত শব্দের বাইরেও দেহভঙ্গি, মুখমণ্ডল আর শারীরিক নড়াচড়ার মধ্য দিয়ে তার মনোভাব জানান দেয়। অভিব্যক্তি দিয়ে বুঝিয়ে দেয় তার মনে প্রকৃতপক্ষে কী আছে, অনেক সময় চেষ্টা করেও মনের ভাব আড়াল করতে পারে না। হয়তো মুখে বলছে একটা, কিন্তু মনে বলছে তার ঠিক উল্টোটা। তার দেহের প্রতিটি নড়াচড়া, মুখের ভাব মনের কথাটি ফুটিয়ে তুলতে পারে। একেই বলে শরীরী ভাষা বা বডি ল্যাংগুয়েজ। দেহের ভাষা দিয়ে যে যোগাযোগ করা হয় সেটিকে বলা হয় নন-ভার্বাল কমিউনিকেশন বা অনুচ্চারিত যোগাযোগ।
গবেষণা বলে, মানুষের মনের ভাব প্রকাশ করার ক্ষেত্রে উচ্চারিত শব্দ আর বাক্যের ভূমিকা মাত্র ৭ শতাংশ। বাকি ৯৩ শতাংশই হচ্ছে নন-ভার্বাল কমিউনিকেশন; যার মধ্যে ৫৫ শতাংশ হচ্ছে তার দেহের ভাষা বা বডি ল্যাংগুয়েজ আর ৩৮ শতাংশ হচ্ছে স্বরভঙ্গি। শব্দের ওঠানামা, স্বর প্রক্ষেপণ আর কখন থামতে হবে আর কখন দ্রুত বলতে হবে, কখন আস্তে বলবে কখন জোরে বলবে সেগুলো! এর মানে দাঁড়ায় আমাদের মনের ভাবের বেশির ভাগ অংশই দেহের ভাষায় প্রকাশিত হয়। আমাদের আবেগ আর চিন্তা প্রকাশ পায় দেহের ভাষার মধ্য দিয়ে। প্রকাশ পায় আমাদের ব্যক্তিত্বও।
একজন মানুষ মুখে যা-ই বলুক না কেন, সে কখন মিথ্যা বলছে, কখন বিরক্ত হচ্ছে, কখন খুশি হচ্ছে, কখন ভয় পাচ্ছে, কখন সত্য গোপন করছে, কখন কিছু আড়াল করতে চাইছে, তা কিন্তু তার দেহের ভাষায় প্রকাশ পেতে পারে। বিষয়গুলো বৈজ্ঞানিকভাবে প্রমাণিত। একটু চর্চা করলে অপরের দেহের ভাষা বোঝার মতো সক্ষমতা অর্জন করা যায়। আবার পেশাগত জীবনে সফল হতে, সামাজিক আদবকেতাগুলো রপ্ত করতে দেহের ভাষা জানা এবং সে অনুযায়ী নিজের বডি ল্যাংগুয়েজে পরিবর্তন আনারও প্রয়োজন হতে পারে। করপোরেট জীবনে, সামাজিক দক্ষতা অর্জনে, অভিনয়ে, অপরাধ তদন্তে বডি ল্যাংগুয়েজ বোঝার গুরুত্ব অনেক। পাশ্চাত্যের অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ে বডি ল্যাংগুয়েজের ওপর উচ্চতর কোর্স রয়েছে আর সেসব দেশে রয়েছে পেশাদার বডি ল্যাংগুয়েজ বিশেষজ্ঞ।
দেহের কিছু বিষয় বিশ্লেষণ করলে বডি ল্যাংগুয়েজের কিছু ব্যাখ্যা পাওয়া যায়। যদিও সংস্কৃতিভেদে এই দেহভাষার আলাদা অর্থ হতে পারে।

চোখের মুখের অভিব্যক্তিই বলে দেয় আপনি আনন্দে আছেন না কষ্টে আছেন?  মডেল: অর্ণব। ছবি: সুমন ইউসুফ
চোখের মুখের অভিব্যক্তিই বলে দেয় আপনি আনন্দে আছেন না কষ্টে আছেন? মডেল: অর্ণব। ছবি: সুমন ইউসুফ

দেহভঙ্গি (পসচার)
একটি অফিসে একজন এমনভাবে দাঁড়িয়ে আছেন আর তাঁর আশপাশে কজন জড়ো হয়ে আছেন। যিনি দাঁড়িয়ে আছেন তাঁর ভঙ্গি দেখেই বোঝা যাবে তিনি অফিসের হর্তাকর্তা কেউ একজন। হয়তো তাঁর কোমরে হাত, দুপা একটু ছড়ানো বা পকেটে হাত ঢোকানো আর শরীরটা একটু কাত করা—পুরো আত্মবিশ্বাসী; আর বাকিরা কেউ পেটের ওপর দুই হাত বা পেছনে দুই হাত দিয়ে একটু ঘাড় নিচু করে দাঁড়িয়ে রয়েছে—মানে বিনয়ী। কারও হাঁটা, দাঁড়ানো বা বসা দেখে তার মনের ভাব অনেকটাই বোঝা যায়। চেয়ারের কোনায় বসে কথা শুনছেন বা বলছেন—এর অর্থ হচ্ছে আপনি সামনের ব্যক্তি বা আলোচনার বিষয়ে মোটেই আগ্রহী নন। আপনি আপনার সামনের ব্যক্তির দিকে ঝুঁকে বসে কথা বলছেন বা শুনছেন, তার অর্থ হচ্ছে আপনি সামনের ব্যক্তি বা আলোচনার বিষয়ে দারুণ আগ্রহী।

অঙ্গভঙ্গি (জেসচার)
প্রত্যেকের শরীরের বিভিন্ন অঙ্গের নড়াচড়া, এমনকি মুখভঙ্গি তার মনের ভাব প্রকাশ করতে সাহায্য করে। যেমন পায়ের ওপর পা দিয়ে, গালে হাত দিয়ে বসে থেকে এক পা আস্তে আস্তে নাড়ানোতে বোঝা যায় তিনি অধৈর্য হয়ে গেছেন আর একঘেয়েমি বোধ করছেন। প্যান্ট বা জ্যাকেটের দুই পকেটে হাত দিয়ে কাঁধ দুটো একটু উঁচু করে হাঁটছেন তার অর্থ হচ্ছে ব্যক্তিটি আশপাশের পরিবেশকে থোড়াই কেয়ার করছেন বা মোটেই পছন্দ করছেন না এবং ব্যক্তিত্বের দিক দিয়ে তিনি খানিকটা গোপনীয়তাপ্রিয় এবং জটিল।

হাবভাব (অ্যাপিয়ারেন্স)
কথা বলতে বলতে ‘ইয়ে’, ‘হাম’, ‘উমম্’ বলছেন, বারবার চারপাশ তাকাচ্ছেন; তার অর্থ হচ্ছে তিনি কিছু মিথ্যা বলছেন বা সত্য আড়াল করছেন বা তিনি চাচ্ছেন না আপনার সঙ্গে বেশিক্ষণ কথা বলতে। হাবভাবের আরেকটি অংশ হচ্ছে তার পোশাক, জুতা, ঘড়ি , পকেটের কলম, হাতের ব্যাগ ইত্যাদি। এগুলোকে যদি ঠিকমতো বিশ্লেষণ করা যায় তবে সহজেই কারও ব্যক্তিত্ব আর মনের ভাব বোঝা যায়। যেমনটা পারতেন শার্লক হোমস।


মাথার নড়াচড়া
কথা বলার সময় মাথা নিচু করে রাখছেন তার অর্থ হচ্ছে তিনি উচ্চপদস্থ কারও সঙ্গে কথা বলছেন বা সত্য গোপন করছেন, মাথা ডান বা বাঁ দিকে ঘুরিয়ে কথা বলছেন তার অর্থ তিনি কাউকে তাচ্ছিল্য করছেন বা মিথ্যে বলছেন আর মাথা উঁচু করে কথা বলার অর্থ তিনি প্রতিবাদ করছেন বা আগ্রাসী মনোভাব দেখাচ্ছেন। বসে বসে মাথা এদিক-ওদিক করছেন, এর অর্থ তিনি অধের্য হয়ে আছেন, বিরক্তিবোধ করছেন।

হাতের নড়াচড়া ও অবস্থান
হাত কচলানো, এক হাত দিয়ে আরেক হাত ঢেকে রাখা অর্থ তার কাছে গোপন করার মতো কিছু আছে বা তিনি মিথ্যা বলছেন। দুই হাত আড়াআড়ি করে বুক আর পেটের মাঝখানে ক্রস করে রেখেছেন অর্থ হচ্ছে তিনি খানিকটা রক্ষণাত্মক ভঙ্গিতে আছেন, যেকোনো যুক্তিতর্কের জন্য প্রস্তুত। দুই হাত বাড়িয়ে বা দুই হাতের মাঝে অনেকটা জায়গা খালি রেখে কথা বলছেন অর্থ হচ্ছে তিনি সত্য বলছেন বা তিনি বন্ধুবৎসল, আপনার উপস্থিতিকে সম্ভাষণ করছেন। কথা বলতে বলতে কানে হাত দেওয়া, ঘাড় চুলকানো, ঠোঁট বা মুখ ঢাকা অর্থ তিনি কিছু গোপন করতে চাচ্ছেন, মিথ্যা বলছেন বা নিজের দুর্বলতা বা কোনো অপরাধ ঢাকতে চাচ্ছেন। মাথার পেছনে দুই হাতের ওপর ভর দিয়ে চেয়ারে বসে দুলতে থাকার অর্থ তিনি অনেক আত্মবিশ্বাসী। আপনি কথা বলছেন আর সামনের শ্রোতা তর্জনী দিয়ে চোখ কচলাচ্ছে—এর অর্থ হচ্ছে আপনার কথা উনি ঠিক বুঝছেন না। হাতের তালু ওপরে রাখার অর্থ তিনি ইতিবাচক আর মুঠো করে রাখা বা তালু নিচে রাখার অর্থ হচ্ছে তিনি খানিকটা নেতিবাচক।

চোখ
‘চোখ যে মনের কথা বলে’—গানটির মতো চোখ সত্যিই মনের ভাব প্রকাশ করতে পারে। চোখের ভাষা বোঝার জন্য আলাদা একটি বিষয়ও রয়েছে যাকে বলা হয় ‘অকুলেসিক্স’। চোখে চোখ রেখে কথা বলতে পারছেন না অর্থ হচ্ছে তিনি মিথ্যা বলছেন, আরেক দিকে তাকিয়ে কথা বলছেন অর্থ হচ্ছে তিনি যে বিষয়টি নিয়ে কথা বলছেন তিনি বিষয়টি মেনে নিতে পারছেন না বা স্বীকার করছেন না। চোখ ওপর দিকে উল্টিয়ে কথা বলার মানে মিথ্যা বলা। আবার চোখে চোখ রাখছেন ঠিকই কিন্তু চোখের মণি দুটো স্ফীত তার মানে তিনি আপনার সঙ্গে হৃদ্য হতে পারছেন না। খুব তীক্ষ্ণ করে কারও চোখের দিকে তাকানোর অর্থ আপনি তাকে অবজ্ঞা করছেন বা হুমকি দিচ্ছেন।

মুখের ভঙ্গি দেখে বোঝা যাবে আপনার মনের অবস্থা। মডেল : নির্ঝর
মুখের ভঙ্গি দেখে বোঝা যাবে আপনার মনের অবস্থা। মডেল : নির্ঝর

মুখভঙ্গি (ফেশিয়াল এক্সপ্রেশন)
কেউ কেউ কথা বলার সময় বারবার মুখ দিয়ে বিভিন্ন অঙ্গভঙ্গি করছেন—ওপরের ঠোঁট আর নাকের মাঝখানটা ওঠানামা করছে বা কথার মাঝখানে মুখ ভ্যাংচানোর মতো করছেন, এর অর্থ হচ্ছে তিনি পরিস্থিতি মেনে নিতে পারছেন না, বিরক্ত হচ্ছেন, তাচ্ছিল্য করছেন এবং ব্যক্তিত্বের দিক থেকে তিনি আত্মপ্রেমী, নিজেকে একটু বড় মনে করেন—অথচ তার ব্যক্তিত্বের গুণগতমান বেশ নিচুতে। তিনি হয়তো ভাবছেন সবাই তাকে পছন্দ করছে আসলে বিষয়টা এর উল্টো! কপাল কুঁচকে থাকা, ভুরু দুটো ওপরে তুলে রাখা বিরক্তির বহিঃপ্রকাশ।

স্পর্শ
স্পর্শ করে এবং কতটুকু চাপ দিয়ে আপনি আরেকজনকে স্পর্শ করছেন তার মধ্য দিয়ে আরেকজনের প্রতি আপনার স্নেহ, ভালোবাসা, রাগ বা ঘৃণা প্রকাশ পেতে পারে। করমর্দন করে কেউ আপনার হাতকে নামিয়ে দিতে চাচ্ছেন, এর মানে তিনি আপনার ওপর নিজের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে চান। আর তিনি যদি করমর্দনের সময় নিজের হাতকে নিচে নামিয়ে দিতে থাকেন—তার মানে তিনি আপনার দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হতে চান। দুজনই শক্ত করে করমর্দন মানে সমানে সমান, আর কোনোমতে হাত ছুঁয়ে যাওয়া অর্থ দুর্বল ব্যক্তিত্ব বা তাচ্ছিল্য। এক হাত পকেটে রেখে করমর্দনের অর্থ আপনি কিছু গোপন রাখতে চান।

দূরত্ব ব্যবধান
দুজন মানুষ যখন নিজেদের মধ্যে সর্বোচ্চ দেড় ফুট জায়গা রেখে দাঁড়ান বা কথা বলেন তার অর্থ হচ্ছে তারা খুবই অন্তরঙ্গ। যদি তাদের মধ্যে দেড় থেকে ৪ ফুট দূরত্ব থাকে তবে তারা ব্যক্তিগতভাবে বেশ ভালো বন্ধু। যদি দূরত্ব রাখেন ৪ থেকে ১২ ফুট তবে তারা সামাজিকতা বজায় রাখছেন—সামাজিকভাবে তারা খানিকটা পরিচিত। আর এর চেয়ে বেশি দূরত্বকে বলা হয় পাবলিক জোন অর্থাৎ তাদের মধ্যে পরিচয় না-ও থাকতে পারে।

কথা বলার ভঙ্গি, শব্দের ওঠানামা
কীভাবে কথা বলছেন, জোরে না আস্তে, তার ওপর নির্ভর করে আপনি কি উত্তেজিত না শান্ত, অস্থির না ধীর-স্থির। কথা বলার সময় বিরতি না দিলে আপনি খোলা মনের, আর বিরতি দিয়ে দিয়ে বলতে থাকলে আপনি যথেষ্ট জটিল। আপনি কথা বলার সময় হাত নাড়তে থাকলে বোঝা যায় আপনি যা বলছেন তা আপনি বিশ্বাস করেন, আর হাত একদম স্থির রাখার অর্থ আপনি খানিকটা দ্বিধাগ্রস্ত। বারবার ঢোঁক গেলার অর্থ মিথ্যা বলা।
কেউ যদি দেহের ভাষার আদবকেতাগুলো রপ্ত করতে পারেন তবে তিনি পেশাজীবনে হতে পারেন সফল, হতে পারেন জনপ্রিয়। আবার অপরের দেহের ভাষা বোঝার সক্ষমতা যদি রপ্ত করতে পারেন, তবে বেশির ভাগ সময়ই আরেকজনের মনোভাব আঁচ করতে পারবেন—যা কখনো কখনো প্রয়োজনীয় আর উপকারী। তবে দেহের ভাষা সব সময় যে সত্যিটা জানান দেয় তা কিন্তু নয়, ব্যতিক্রমও হতে পারে। এ কারণে সামান্য জেনে কারও দেহের ভাষার ব্যাখ্যা করে তাকে মূল্যায়ন করতে গেলে ভুলও হতে পারে।

সহযোগী অধ্যাপক, জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটউট, ঢাকা