ব্রডওয়ের প্রশস্ত ভুবনে

স্কুল অব রক-এর প্রদর্শনী যেমন হয়।  ছবি: সংগৃহীত
স্কুল অব রক-এর প্রদর্শনী যেমন হয়। ছবি: সংগৃহীত

সাবওয়ে থেকে উঠে ৬৫ এভিনিউ দিয়ে এগিয়ে চললাম আমরা। মনে দারুণ চাঞ্চল্য। ব্রডওয়ে শো দেখব। কতবার শুনেছি এই দীপ্যমান শো-র কথা! যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কে এসেছি আর ব্রডওয়ে শো দেখব না, তা কী করে হয়!

তবে বললেই তো আর হয় না। ব্রডওয়ে আর ম্যানহাটনজুড়ে ছড়িয়ে থাকা নাট্য মিলনায়তনগুলোর কোনো এক নাটকের টিকিট পেতে যে এত হ্যাপা পোহাতে হয়, তা তো জানা ছিল না। এতটাই জনপ্রিয় নাটকগুলো যে বহুদিন আগে টিকিট না করলে ব্রডওয়েতে নাটক দেখার স্বপ্ন পূরণ হওয়া কঠিন। দীর্ঘ সময় ব্যয় করে আমার ভাতিজি রাখি স্কুল অব রক-এর চারটি টিকিটের ব্যবস্থা করে ফেলে। একটু কম দামেই পাওয়া যায় টিকিট—প্রতিটি ৭৮ ডলার। প্রতিটি আসনই পূর্ণ হয়ে যায় এসব শো-এ। তাই টিকিট পাওয়া মানে হাতে চাঁদ পাওয়া।

শো শুরুর আগেই প্রতিটি আসনই পূর্ণ। ছবি: লেখক
শো শুরুর আগেই প্রতিটি আসনই পূর্ণ। ছবি: লেখক

বেশ একটা ঝিরঝিরে বাতাস বইছিল সেদিন। ফেব্রুয়ারির দিনগুলোয় আবহাওয়া কী আচরণ করবে, তা জেনে নিতে হয় অন্তর্জাল থেকে। আগের দিনই স্মার্ট ফোনে বা ল্যাপটপে বসে অন্তর্জালে খোঁজ নিলে জানা যায় পরদিনের আবহাওয়ার খবর। কখনো জানা যায়, শূন্যের এতটা নিচে থাকবে তাপমাত্রা, থাকবে হাওয়া, তুষারপাতও হতে পারে। মেঘময় দিনে নিজেকে সামলে রেখো। কিংবা হতে পারে, আজ উষ্ণতা ছড়াবে সূর্য, তাপমাত্রাও থাকবে শূন্যের অনেক ওপরে। সেভাবেই পরে নাও পোশাক-আশাক। সব সময় এই ভবিষ্যদ্বাণী মিলে যায় তা হয়তো নয়, কিন্তু কমবেশি মেলেও বটে।

টাইম স্কয়ার ঘুরে আমরা খুঁজছি ৫০ ও ৫১ নম্বর স্ট্রিটের মাঝে উইন্টার গার্ডেন। এখানেই স্কুল অব রক-এর প্রদর্শনী হবে। চার সদস্যের এই দলে সনকা স্কুল অব রক চলচ্চিত্রটি দেখেছে। ও আমাদের প্রাথমিক একটি ধারণা দিয়ে রাখে, তাই নাটক উপভোগ করায় একটা বাড়তি আগ্রহ তৈরি হয়।

চলতি পথেই ম্যানহাটনের ঝকঝকে তকতকে রূপ আমাদের আকৃষ্ট করে। চলমান জনস্রোত আর বিজ্ঞাপনে ঠাসা সড়কটির হৃৎস্পন্দন যেন শুনতে পাওয়া যায়। এ সড়কেই আরও কয়েকটি ব্রডওয়ে মিলনায়তন দেখি আমরা। একেক মিলনায়তনে চলছে একেক নাটকের শো। এরই মধ্যে আমরা জেনে গেছি, জনপ্রিয়তা যত দিন থাকে, তত দিন পর্যন্ত নাটকগুলো চলে। কোনো নাটক চলে বছরের পর বছর একই মিলনায়তনে।

বলে রাখি, ব্রডওয়ে কোনো একক মিলনায়তন নয়। এই বিশাল রাস্তার ওপর এবং এর আশপাশে আরও কয়েকটি সড়কে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে ব্রডওয়ের মিলনায়তনগুলো। এরই মাঝে আছে অফ ব্রডওয়ে এবং অফ অফ ব্রডওয়ে। ব্রডওয়ের নাটকের আসনসংখ্যা পাঁচ শতাধিক। অফ ব্রডওয়েতে পাঁচ শ’র নিচে। অফ অফ ব্রডওয়েতে তা এক শ’র মধ্যে। তিন ধরনের মিলনায়তন—এটা একটা পার্থক্য। আরেকটা পার্থক্য হলো, অন্য দুই ধরনের মিলনায়তনে নিরীক্ষাধর্মী নাটক চলে বেশি। এর মধ্যে কোনোটি জনপ্রিয় হয়ে উঠলে তা ঠাঁই নেয় ব্রডওয়েতে।

বিভিন্ন ভাষায় নাটকটির কাহিনি সংক্ষেপ
বিভিন্ন ভাষায় নাটকটির কাহিনি সংক্ষেপ

দুটোর সময় ছিল প্রদর্শনী। ১০ মিনিট আগে হাঁপাতে হাঁপাতে সেখানে পোঁছে দেখি সবাই ঢুকে গেছে এরই মধ্যে। টিকিট পরীক্ষা করে আমাদের ঢুকিয়ে দেওয়া হলো হলে। একজন বৃদ্ধা হাসিমুখে এগিয়ে এলেন। আমাদের টিকিটগুলো হাতে নিয়ে তাঁর পেছনে পেছনে যেতে বললেন। তিনি দেখিয়ে দিলেন আসন। মঞ্চের ওপর তখন জ্বলজ্বল করছে ‘স্কুল অব রক’ শিরোনামটি।

শো শুরু হওয়ার আগে মজার ভঙ্গিতে একটি কণ্ঠস্বর ভেসে আসে। টেলিফোনে যেন ভিডিও করা না হয় এবং টেলিফোনটি যেন বন্ধ রাখা হয়, সে কথাই বলা হলো তাতে। এরপর পর্দা উঠল।

পরের ঘটনা বর্ণনা করা কঠিন। এই প্রথম বুঝতে শুরু করলাম পেশাদারি নাট্যচর্চার মানে। দৃশ্য পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে অবলীলায় বদলে যেতে থাকল মঞ্চ, শিল্পীরা পূর্ণ শক্তি ও মেধার সঙ্গে চমকপ্রদ অভিনয় করে মাতিয়ে দিলেন দর্শকদের। নাটকটি আসলে সংগীতময়। এক ব্যর্থ রকশিল্পী বন্ধু ও বন্ধুপত্নীর বাড়িতে থাকে, মাস শেষে টাকা দিতে পারে না। বন্ধুপত্নীর অনুযোগ গায়ে মাখে না সে, কিন্তু বুঝতে পারে এভাবে থাকা চলবে না। এ সময় ঘটে এক অভূতপূর্ণ ঘটনা। বন্ধুর অবর্তমানে বন্ধুর কাছে আসা একটা টেলিফোন কলে সে জানতে পারে, একটি স্কুলে একজন বিকল্প শিক্ষক দরকার। সপ্তাহে ৯৫০ ডলারে তিনি কি কাজটি করবেন? হাতে চাঁদ পান রকশিল্পী। তিনি বন্ধুর ছদ্মবেশে যোগ দেন স্কুলে। এরপর ঘটতে থাকে একের পর এক কিংকর্তব্যবিমূঢ় করে দেওয়া ঘটনা। স্কুলের প্রচলিত আইন ভেঙে এই ছদ্ম শিক্ষক এমন এক জায়গায় নিয়ে যায় শিশুদের আত্মবিশ্বাস যে একটি গানের প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়ে তারা জয় করে নেয় সেরা পুরস্কারটি।  বড়দের পাশাপাশি সমানে সমানে অভিনয় করেছে শিশুরা। সংলাপ ও কণ্ঠসংগীতে তুখোড় সবাই। আকর্ষণীয় দৃশ্যের পর দর্শকদের করতালি যেন থামতেই চায় না।

নিউইয়র্কে গিয়ে কে আর ব্রডওয়ে শো মিস করতে চায়!
নিউইয়র্কে গিয়ে কে আর ব্রডওয়ে শো মিস করতে চায়!

নাটক শেষ হওয়ার পর কিছুক্ষণ আমরা স্তব্ধ হয়ে বসে থাকি। কী করে এতটা নিখুঁত হয় পরিবেশনা, কীভাবে লাফিয়ে দাপিয়ে টেবিলের ওপর উঠে পরক্ষণেই পপাত ধরণীতল হয়ে আবার স্প্রিংয়ের মতো লাফিয়ে উঠে কণ্ঠের দোলায় সচল রাখা যায় পুরো পারফরম্যান্স, তা না দেখলে বিশ্বাস করা যায় না। মনে হলো, এ শুধু থিয়েটারি মুনশিয়ানাই নয়, খেলোয়াড়ি দক্ষতা আর প্রাণপ্রাচুর্য না থাকলে এ ধরনের পেশাদারি মনোভাব গড়ে ওঠে না।

উইন্টার গার্ডেন থেকে বেরিয়ে অনেকের মতো আমরাও ছবি তুলি। বোঝা যায়, এখানে পা পড়েছে, অনেকের জন্যই তা এক অনন্য অভিজ্ঞতা। ঘুরতে আসা পর্যটকদের পাশাপাশি নিউইয়র্কবাসীও একবার ব্রডওয়ে শো দেখার জন্য উদগ্রীব থাকেন। কেনই বা থাকবেন না? শিল্পের উৎকর্ষের প্রতি এই নিষ্ঠা তো সহজে সবখানে মেলে না!