সুন্দরবনে অন্য ইতিহাসের খোঁজে

সুন্দরবনে প্রত্নতাত্বিক নিদর্শন দেখাতে যাওয়া দলের সদস্যরা
সুন্দরবনে প্রত্নতাত্বিক নিদর্শন দেখাতে যাওয়া দলের সদস্যরা

ইসমে আজমের সঙ্গে পরিচয়ের সূত্র সুন্দরবনের বাঘ। বনে বাঘ গণনা ও সংরক্ষণ করে এমন একটি বেসরকারি সংস্থায় কাজ করেন তিনি। পরিচিতরা তাঁকে ঋজু নামে চেনেন। মাস তিনেক আগে একদিন ফোন পেলাম ঋজুর। কথায় কথায় এই তরুণ যা বললেন, তা শুনে রীতিমতো পিলে চমকে গেল। সুন্দরবনে তিনি বাঘ ছাড়াও অন্য এক রহস্যের খোঁজ পেয়েছেন।

কী সেই রহস্য? বিস্তারিত জানতে চাইলাম। ইসমে আজমের কথা শুনলাম। মনের ভেতর বিশ্বাস-অবিশ্বাসের দোলাচল। সুন্দরবনের ভেতর তিনি নাকি প্রাচীন বন্দর, ভবনের ধ্বংসাবশেষ, হরেক রকম মাটির পাত্র, টেরাকোটা, চুড়িসহ নানা প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন খুঁজে পেয়েছেন। সুন্দরবনের বিভিন্ন অংশে পাড় ভাঙন শুরু হওয়ায় এসব স্থাপনা বেরিয়ে আসছে বলে জানালেন তিনি।

দিনের পর দিন ঋজুর সঙ্গে তাঁর আবিষ্কার নিয়ে কথা চলল। তিনিও একের পর প্রত্নবস্তুর তথ্য, বিশ্লেষণ ও ছবি পাঠাতে থাকেন। আর আমি সেসব যাচাই করতে ইন্টারনেট ঘাঁটতে থাকি, কখনো লাইব্রেরিতে গিয়ে বই-পুস্তক জোগাড় করি। পাতার পর পাতা পড়ি। এসব বইয়ের মধ্যে সতীশচন্দ্র মিত্রের যশোহর-খুলনার ইতিহাস, এ এফ এম আব্দুল জলীলের সুন্দরবনের ইতিহাসসহ নানা বইয়ে সুন্দরবনের বসতি থাকার কথা উল্লেখ রয়েছে। এই তথ্য আবার ঋজুকে জানাই। জার্মানি ও যুক্তরাষ্ট্রের দুটি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আসা এক গবেষক দল আগেই জানিয়েছে, সুন্দরবনে ৩০০ বছর আগে লবণশিল্পের কারখানা পাওয়া গেছে। যশোরের রাজা প্রতাপাদিত্যের আমলে সুন্দরবন এলাকায় দুর্গ, মন্দিরসহ নানা অবকাঠামো গড়ে তোলা হয়েছিল।

ঋজু খবর দেন, যেসব স্থাপনা ও প্রত্নবস্তু খুঁজে পেয়েছেন তিনি, সেগুলো এক থেকে দুই হাজার বছর আগের। আর তাঁর খুঁজে পাওয়া স্থাপনাগুলো দু-তিন বছর ধরে দেখা যাচ্ছে। এর আগে ওই স্থাপনাগুলো সুন্দরবনের মাটির নিচে চাপা পড়ে ছিল। বেশ কয়েকটি এলাকায় বনের পাড় ভাঙা শুরু হওয়ায় তা বের হতে শুরু করেছে। ঋজু সেখানে যেতে অনুরোধ করেন।

সুন্দরবনে পাওয়া মৃৎপাত্রসহ বিভিন্ন প্রত্নবস্তুর সামনে ইসমে আজম
সুন্দরবনে পাওয়া মৃৎপাত্রসহ বিভিন্ন প্রত্নবস্তুর সামনে ইসমে আজম

অনুসন্ধানের প্রস্তুতি
ঋজুর প্রস্তাবের বিষয়টি নিয়ে প্রথম আলোর বার্তা বিভাগের সংবাদ ব্যবস্থাপকদের সঙ্গে কথা বলি। তাঁদের পরামর্শে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক সুফি মোস্তাফিজুর রহমানকে বিষয়টি জানাই। তাঁকে সুন্দরবনের ওই স্থানগুলো নিয়ে আমাদের অনুসন্ধানে সঙ্গী হওয়ার অনুরোধ করি। বিক্রমপুরে অতীশ দীপঙ্করের জন্মস্থানসহ নানা কাজে ব্যস্ত। তারপরও এক ফাঁকে আমাদের সঙ্গে সুন্দরবনে যাওয়ার জন্য সম্মত হলেন। অনুসন্ধানী দলে আরও যোগ হলেন কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের শিক্ষক মো. সোহরাব উদ্দিন, প্রথম আলোর সাতক্ষীরা প্রতিনিধি কল্যাণ ব্যানার্জি ও যশোরের আলোকচিত্রী এহসান-উদ-দৌলা।

পা বাড়ালাম সুন্দরবনে
২৩ জানুয়ারি ২০১৮। প্রত্নতাত্ত্বিক এবং আমরা কজন মিলে রওনা হলাম সুন্দরবনের উদ্দেশে। বন বিভাগের খুলনা অঞ্চলের বন সংরক্ষক আমীর হোসেন চৌধুরীর সঙ্গে বিষয়টি নিয়ে কথা বললাম। আমরা সুন্দরবনের যে জায়গাগুলোতে যাব, তিনি ওই স্থানগুলোতে যাওয়ার ব্যাপারে পরামর্শ ও সহযোগিতার হাত বাড়ালেন।
২৪ জানুয়ারি ভোর ছয়টা। ভাটার সময়। ছোট্ট একটি স্পিডবোটে আমাদের দলটি সুন্দরবনের দিকে যাত্রা শুরু করল। দলে আছেন দুজন বনরক্ষী।

আমাদের চারদিকে আঁকাবাঁকা নদী আর দুই পাশে ঘন অরণ্য। এমন রহস্যঘেরা মায়াবী জগৎ ধরে আমরা চলছি। তবে নতুন কিছু উন্মোচনের রোমাঞ্চ বোধ করছিলাম ভেতরে ভেতরে। অপেক্ষা বাড়ছিল কখন দেখব ঋজুর খুঁজে পাওয়া দক্ষিণের এই উপকূলের প্রাচীন বসতি। ততক্ষণে জেনেছি সবচেয়ে বড় স্থাপনাটিতে যেতে স্পিডবোটে ঘণ্টা দেড়েক সময় লাগবে। সকাল সাড়ে সাতটা থেকে সাড়ে আটটা পর্যন্ত ওই স্থাপনাগুলো পানির ওপরে ভেসে ওঠে। ফলে যেকোনো মূল্যে আমাদের সাড়ে সাতটার মধ্যে সেখানে পৌঁছাতে হবে। সময়ের সে হিসাব করেই আমরা পা বাড়িয়েছিলাম।

প্রাচীন স্থাপনার অংশবিশেষ ঘুরে দেখছে অনুসন্ধানী দল
প্রাচীন স্থাপনার অংশবিশেষ ঘুরে দেখছে অনুসন্ধানী দল

বিকল স্পিডবোটে আধঘণ্টা
স্পিডবোটটি সময়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে এগোচ্ছিল। কিন্তু আচমকা স্পিডবোট বন্ধ হয়ে গেল। তবে ঋজু জানালেন, সুন্দরবনের হাজার বছরের পুরোনো বন্দরের কাছাকাছি পৌঁছে গেছি আমরা। কিন্তু স্পিডবোট তো এগোচ্ছে না। চালক শত চেষ্টা করেও তা সচল করতে পারছেন না। হঠাৎ খেয়াল করলাম, আমাদের সাতজনকে নিয়ে স্পিডবোটটি ভাটার টানে ভেসে ভেসে সমুদ্রের দিকে চলে যাচ্ছে। ভেতরটা ছ্যাঁৎ করে উঠল। এখন কী হবে। সবার চোখে-মুখে দুশ্চিন্তার ছাপ।
এই জায়গায় মোবাইল ফোনের নেটওয়ার্ক নেই। কয়েক শ কিলোমিটারের মধ্যে নেই কোনো জনমানুষ। তবে আছে কিছু প্রাণী। যেমন পানিতে কুমির আর ডাঙায় বাঘ! ঋজু জানালেন, বনের এই দিকের নদীতে কুমির-হাঙর আর ওপরে বেঙ্গল টাইগারের বিচরণ বেশি। খুব অসহায় বোধ হতে লাগল। আশপাশে কোনো নৌকা বা জাহাজও নেই যে চিৎকার করে খবর দেব। বনের এই অংশটি এতই দুর্গম যে কোনো নৌযান, এমনকি পারতপক্ষে ডাকাতেরাও নাকি আসে না!

ভয়ে-আতঙ্কে সবার হাত পা হিম হয়ে যাওয়ার জোগাড়। একে অপরকে সাহস দিচ্ছি, ভয়ের কিছু নেই। অতল সাগরে, মানে বঙ্গোপসাগরে আমরা ভেসে গেলেও, কেউ না কেউ আমাদের উদ্ধার করবে। কল্যাণ ব্যানার্জি অধ্যাপক সুফি মোস্তাফিজকে অভয় দিতে থাকলেন, স্যার, ভয় পাবেন না। উদ্ধারের ব্যবস্থা হবে।
ওদিকে চালক চেষ্টা চালিয়েই যাচ্ছিলেন। তাঁর নিরন্তর চেষ্টায় হঠাৎ স্পিডবোট চালু হলো। প্রায় আধা ঘণ্টা পর যেন হাঁফ ছেড়ে বাঁচলাম।

ইতিহাস দর্শন
স্পিডবোট যেখান বিকল হয়েছিল, সেখান থেকে ১০ মিনিটের মধ্যে আমরা পৌঁছালাম খেজুরদানা এলাকায়। এখানেই সেই প্রাচীন মানববসতি। হাঁটুপানিতে নেমেই টের পেলাম বঙ্গোপসাগরতীরের এই স্থানটিতে পায়ের নিচে কাদা নেই, আছে ইটের পাকা মেঝে। প্রায় এক কিলোমিটার এলাকাজুড়ে দেখতে পেলাম নানা স্থাপনা। সুফি মোস্তাফিজুর রহমান ঋজুকে জড়িয়ে ধরলেন। বললেন, ‘এ তুমি কী আবিষ্কার করলে? এখন তো বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চলের ইতিহাস নতুন করে লিখতে হবে।’
আধা ঘণ্টার মতো সময় পেলাম এগুলো দেখতে। এরপর জোয়ারের পানি আসতে থাকল। আমরা বাংলার ওই প্রাচীন বসতি থেকে ফেরার জন্য পা বাড়ালাম।

প্রথম আলোর ২৮ ফেব্রুয়ারি সংখ্যায় ঋজুর এই আবিষ্কারের কথা নিয়ে মূল প্রতিবেদন হয়েছে। যার শিরোনাম ছিল ‘সুন্দরবনে প্রাচীন মানববসতি’।