কেন পড়ি রাশিফল?

কমবেশি সবার মধ্যেই রাশিফল নিয়ে একধরনের আগ্রহ ও কৌতূহল কাজ করে। মডেল: মোহিনী, ছবি: সুমন ইউসুফ
কমবেশি সবার মধ্যেই রাশিফল নিয়ে একধরনের আগ্রহ ও কৌতূহল কাজ করে। মডেল: মোহিনী, ছবি: সুমন ইউসুফ

‘আপনি নিজেই আপনার ভাগ্য নিয়ন্ত্রণ করতে পারেন শতকরা ৯০ থেকে ৯৬ ভাগ। বাকিটা আমরা ফেট বা নিয়তি বলতে পারি। ভাগ্য অনেক সময় অনির্দিষ্ট কারণে আপনা থেকেও গতিপথ বদলাতে পারে। এখানে রাশিচক্রে আমি ‘নিউমারলজি’ বা ‘সংখ্যা-জ্যোতিষ’ পদ্ধতি প্রয়োগ করেছি।’ প্রথম আলোর শনিবারের ক্রোড়পত্র ছুটির দিনে-তে কাওসার আহমেদ চৌধুরীর ‘আপনার রাশি’ শিরোনামের সাপ্তাহিক রাশিফলের নিচে এ কথাটা লেখা থাকে।

পরিশ্রম, মেধা, মনন, জ্ঞান, চেষ্টা, উদ্যোগ—এসব দিয়েই মানুষ তার ভাগ্য গড়ে তোলে। সফল হয়ে ওঠে। আবার কোনো ঘটনা-দুর্ঘটনায়, নিজের গাফিলতি কিংবা ভুল সিদ্ধান্তের কারণে ব্যর্থও হয় মানুষ। বৃশ্চিক বা তুলা রাশির জাতক-জাতিকা সব সময় সফল হবে কিংবা অন্য কোনো রাশি সব সময় ব্যর্থ হবে—এমন কিছুর বৈজ্ঞানিক ভিত্তি নেই। গ্রহ-নক্ষত্র-চন্দ্র-সূর্য কিংবা সংখ্যার ভিত্তিতেও যে জীবনের সাফল্য-ব্যর্থতা নির্ভর করে, তারও তেমন কোনো বৈজ্ঞানিক ভিত্তি নেই। তারপরও মানুষ রাশিচক্র, রাশিফল বেশ আগ্রহ নিয়েই পড়ে। দৈনিক রাশিফল, সাপ্তাহিক রাশিফল এমনকি বার্ষিক রাশিফলেও প্রবল আগ্রহ মানুষের।

কোনো কারণে কোনো সপ্তাহে যদি কাওসার আহমেদ চৌধুরীর ‘আপনার রাশি’ প্রকাশিত না হয়, তবে প্রথম আলো অফিসে অসংখ্য ফোন, ই-মেইল আসে। রাশিফলের এই জনপ্রিয়তা কেন? যেখানে মানুষ এর ওপর পুরোপুরি আস্থাশীল নয়।

যুক্তরাষ্ট্রের উইসকনসিন বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোবিজ্ঞানী ড. মার্গারেট হ্যামিলটন গবেষণা থেকে বলেছেন, সংবাদপত্রে প্রকাশিত ৭০ শতাংশ রাশিফলে থাকে ইতিবাচক কথা, যা সংবাদপত্রের অন্যান্য খবরে থাকে না। রাশিফল পড়ে পাঠক তার নিত্যকার জীবনের অনিশ্চয়তা, উদ্বেগ থেকে একধরনের মুক্তি পায়।

মেষ, বৃষ, মিথুন, সিংহ, কর্কট, কন্যা, তুলা, বৃশ্চিক, ধনু, মকর, কুম্ভ ও মীন—রাশিচক্রের এই ১২টি রাশি লেখা হয় জন্মতারিখের ওপর ভিত্তি করে। বিশ্বখ্যাত রাশিফল লেখকদের অনেকেই মনে করেন বা তাঁরা জানেন, রাশিফল হতে হবে সুলিখিত। বাংলাদেশেও তা দেখা যায়। আবার যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে রাশিফলের বয়ানেও এসেছে পরিবর্তন। ‘যাত্রা নাস্তি’, ‘সাফল্যযোগ’, এ–জাতীয় শব্দ হয়তো পঞ্জিকা বা পাঁজী ছাড়া চোখে পড়বে না। বরং সমসাময়িক বিষয়, পেশা, ঘটনা ধরে রাশির বয়ান দেখা যায়। আবার ইয়াহু হরোস্কোপ কিংবা অ্যাস্ট্রোলজি ডটকমের মতো ওয়েবসাইটের রাশিফলে পশ্চিমা বিশ্বের জীবনযাত্রার নানা বিষয়-আশয় চোখে পড়ে। যা হয়তো আমাদের বঙ্গদেশীয় কিংবা উপমহাদেশীয় জীবনযাত্রার সঙ্গে মেলে না। তবে পেশা, কর্মক্ষেত্র, প্রেম, বিয়ে, রোমাঞ্চ, বিদেশযাত্রা ইত্যাদি মানুষের সহজাত কিছু আগ্রহের বিষয়ে পূর্ব-পশ্চিম—সব দিকের রাশি লেখকেরা একই। 

‘রাশিফল এমন করেই লেখা হয়, মানুষ সেসবে নিজের মনের প্রতিধ্বনি খুঁজে পায়। সে মনে করে, “আরে, এ তো আমার কথাই বলছে।”’ এমনটা বললেন জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক আহমেদ হেলাল। মিলবে কি মিলবে না, সেটা বড় কথা নয়। প্রতিটি রাশিফলেই এমন কিছু শব্দ থাকে, যেগুলো পাঠককে আগ্রহী করে তোলে।

আহমেদ হেলাল বলেন, ‘যখন মেলে না তখন রাগ হয়, আবার যখন মেলে তখন খুশি হয়। নিজে যখন দুর্বল অবস্থানে থাকে, তখন নেতিবাচক কথা নিতে পারে একজন পাঠক। রাশিফলে দেখবেন ইতিবাচক ও নেতিবাচক—দুই দিক মিলিয়ে লেখা থাকে। আমরা এটাকে বলি নিউরো লিঙ্গুইস্টিক প্যাটার্ন (এনএলপি)।’

কোনো রাশির ক্ষেত্রে যদি টানা ইতিবাচক কথা লেখা হয়, তবে ব্যক্তি কি তা নেবেন? আহমেদ হেলালের উত্তর, ‘না। রোলার কোস্টারে চড়তে মানুষ ভয় পায়। তারপরও কেন চড়ে? যখন উত্তেজনা বেশি হয় তখন তা প্রশমিত করার জন্য এটা সে করে। ফলে শুধু ইতিবাচক বা শুধু নেতিবাচক হলে হয় না। তাই তো রাশিফল সেভাবেই লেখা হয়। সারা বিশ্বেই এমন।’ রাশিফল পড়ার মধ্যে কোনো ক্ষতি দেখেন না এই মনোরোগ বিশেষজ্ঞ। তবে বললেন, ‘এর ওপর ভিত্তি করে জীবনের বড় কোনো সিদ্ধান্ত নেওয়া থেকে বিরত থাকতে হবে।’

কেন মানুষ রাশিফল পড়ে? কাওসার আহমেদ চৌধুরী বললেন, ‘নিজেকে নতুন করে আবিষ্কার করার জন্য পড়ে।’ রাশিফলে প্রত্যেক পাঠকই তাকে খুঁজে পাওয়ার চেষ্টা করে। ইতিবাচক-নেতিবাচক যা-ই হোক, তার সঙ্গে কোথাও না কোথাও মিলে যায়। সেখান থেকেই আগ্রহ। ‘আজ আমারটা এত খারাপ লিখেছে, মুডটাই নষ্ট হয়ে গেল’, আবার ‘আজ আমার রাশি এত ভালো লিখেছে, মনটা ফুরফুরে হয়ে উঠল’—বেশির ভাগ পাঠকের কাছে এমন কথাই তো শুনি আমরা।

রাশিচক্রে বিশ্বাস করেন অনেক বিখ্যাত ব্যক্তিও। যুক্তরাষ্ট্রের ব্যাংকিং ও আর্থিক খাতের বিখ্যাত ব্যক্তিত্ব জে. পি মরগান (১৮৩৭-১৯১৩) যেমন বলেছেন, ‘যে কেউ মিলিয়নিয়ার হতে পারে, কিন্তু বিলিয়নিয়ার হতে গেলে আপনার একজন জ্যোতিষী দরকার।’

আবার বিজ্ঞানীদের অনেক গবেষণায় বলা হচ্ছে, রাশিচক্র আপনার জন্য খারাপই। যুক্তরাষ্ট্রের সাউথ ক্যারোলাইনা ও জন হপকিনস বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকেরা একটি গবেষণা চালান মেরিল্যান্ডে। অংশগ্রহণকারীদের বলা হয়, নিজের রাশিফল পড়ে রাতের পার্টিতে অংশগ্রহণ কিংবা নিজের বাড়ি পরিষ্কারের কাজ করতে হবে। পার্টিকে ইতিবাচক আর ঘরদোর ঝাঁট দেওয়ার কাজকে নেতিবাচক ধরা হয়। অংশগ্রহণকারীরা যে যাঁর পছন্দ বেছে নিলেন। গবেষকেরা বিস্ময়ের সঙ্গে লক্ষ করলেন, যাঁদের নেতিবাচক রাশিফল দেওয়া হয়েছিল, তাঁদের বেশির ভাগ বেছে নিলেন পার্টিতে যাওয়ার সুযোগ আর ইতিবাচক রাশিফল যাঁদের ছিল, তাঁদের পছন্দের পাল্লা ঘরদোর পরিষ্কারের দিকেই ভালো হলো।

শাকিলা জাফরের তুমুল জনপ্রিয় একটি গান রয়েছে—তুলা রাশির মেয়ে, মিথুন রাশির ছেলে, এই দুটিতে ঘর বাঁধিলে সে ঘর সুখের হয়...। একসময় এমন পাঁজী কুষ্ঠি বিচার করে হয়তো বিয়ের সম্বন্ধ পাকা হতো। কিন্তু আসলে কি তাই? সংসার সুখের হয় দুজনের ভালোবাসায়, বোঝাপড়ায়। কাওসার আহমেদ চৌধুরীও এ কথা বলেছিলেন।

তারপরও ৯০ শতাংশ প্রাপ্তবয়স্ক মানুষ নিজ নিজ রাশিটা জানেন। তাঁরা সুযোগ পেলে নাশতার টেবিলে পত্রিকার পাতায় ছাপা ‘আজকের’ বা ‘এই সপ্তাহের’ রাশিফল পড়েন। ওয়েবসাইটে দেখে নেন। অনেকের স্মার্টফোনে হরোস্কোপ অ্যাপও নামানো আছে। সেটায় আরও বিস্তারিতভাবে রাশিফল জানা যায়। কেননা নিকট কিংবা দূর—কোনো ভবিষ্যতই তো কারও জানা থাকে না। দু-চারটা কথা মিলে গেলে তো ভালোই লাগে। না মিললেই বা ক্ষতি কী। ইতি আর নেতি—জীবনের পথে দুটিই তো চলে হাত ধরাধরি করে।

বেশির ভাগ অনলাইন কিংবা মুদ্রিত পত্রিকা রাশিফলকে ‘বিনোদন’ হিসেবেই রেখেছে। সুলিখিত, রসবোধসম্পন্ন রাশিফল যেন পাঠককে আনন্দ দেয়। এই লেখার শেষটা যদি এমনভাবে লিখি, তবে কি আপনার মুখে হাসির ছটা খেলে যাবে না—মেষ থেকে মীন রাশির প্রিয় জাতক ও জাতিকা, মেঘের গোমড়া মুখ আজ দেখা যেতে পারে খানিকটা সময়ের জন্য, তবে তা দ্রুতই কেটে যাবে, রৌদ্রোজ্জ্বল হবে চারপাশ। নো চিন্তা ডু ফুর্তি, আজকের সারা দিন কাটবে আনন্দে-আনন্দে...। শুভ হোক।