এখানে ছিলেন রবীন্দ্রনাথ

কুষ্টিয়ার শিলাইদহের এই বাড়িতেই কবির অনেকগুলো বছর কেটেছে। ছবি: তৌহিদী হাসান
কুষ্টিয়ার শিলাইদহের এই বাড়িতেই কবির অনেকগুলো বছর কেটেছে। ছবি: তৌহিদী হাসান

হাইওয়ে থেকে যে রাস্তা ঢুকে এঁকেবেঁকে চলে গেল অনেক দূর, সেটাই একসময় পৌঁছে দিল রবীন্দ্রনাথের কুঠিবাড়িতে। শিলাইদহ এখনো তার বুকে লালন করছে রবীন্দ্রনাথকে। এখানেই জীবনের অনন্য সময় কাটিয়েছেন রবীন্দ্রনাথ। কলকাতার কাঠখোট্টা জীবন থেকে বেরিয়ে যে বিশাল পৃথিবীর স্পর্শ পেয়েছিলেন কবি, তার একটি অংশের নাম শিলাইদহ। এই যে এই ভবনে, ভবনের সামনে-পেছনে যা দেখছি, তাতে মিশে রয়েছেন রবীন্দ্রনাথ।

এই শিলাইদহ কিংবা শাহজাদপুর কি পতিসরে কবি যেন নিজেকে নতুনভাবে চিনেছেন। তাঁর স্মৃতিময় বাড়িটি দেখতে দেখতে ছিন্নপত্রের সঙ্গে মিলিয়ে নিয়ে দেখলাম কবিকে।

১৮৯১ সালে তিনি শিলাইদহে যখন এসেছেন, তখন শুনেছেন পৃথিবীর ডাক। তিনি লিখছেন, ‘অনেক দিন পরে আবার এই বড় পৃথিবীটার সঙ্গে যেন দেখা-সাক্ষাৎ হল। সেও বললে, “এই-যে”। আমিও বললুম,

“এই যে”।’ কলকাতার যান্ত্রিক জীবন থেকে এই নির্জন চরে এসে এই ছিল কবির অনুভব। আচ্ছা, এই যে এখন এখানে এত মানুষের আনাগোনা, রবীন্দ্রনাথের কালে কি তা ছিল? নদীর পারে বালুর চর এখনো ধু ধু করে, এখনো তাতে ছোট ছোট বনঝাউ দেখা যায় কদাচিৎ। রবীন্দ্রনাথ নদীর দুই ধারে স্নানরত মেয়েদের দেখেছেন, ভেজা কাপড়ে এক-মাথা ঘোমটা টেনে জলের কলসি নিয়ে ডান হাত দুলিয়ে ঘরের দিকে ধাবমান মেয়েদের দেখেছেন, এখন ঠিক সে রকমটা খুব বেশি চোখে পড়ে না। মনে পড়ে যায় ‘শিশুতীর্থ’ কবিতার সেই পঙ্‌ক্তিটার কথা, ‘বধূরা নদী থেকে ঘট ভ’রে যায় ছায়াপথ দিয়ে’। এ-ও কি শিলাইদহর কাছে পদ্মা নামের বোটে বসে লেখা? উত্তর মেলে না। আর ওই দেখার চোখটার কথা না বললেই নয়। বাঁ কাখে কলসি নিয়ে চলা মেয়েটির ডান হাত যে দুলতে থাকে, পড়ার পর থেকেই যেন তা চোখের ওপর ভাসতে থাকে।

কবির ব্যবহৃত বজরার আদলে তৈরি করা এটি
কবির ব্যবহৃত বজরার আদলে তৈরি করা এটি

শিলাইদহ জমিদারবাড়ির আশপাশে এখন জনবসতি ঘন হয়েছে। কবি যখন এখানে ছিলেন, তখন কিন্তু এত বাড়িঘর গড়ে ওঠেনি। কলকাতা থেকে শিলাইদহে এলেই তাঁর মনে হতো, ‘এখানে মানুষ কম, পৃথিবী বেশি।’ তাঁর মনে হতো, ‘চারিদিকে এমন সব জিনিস দেখা যায়, যা আজ তৈরি করে কাল মেরামত করে পরশুদিন বিক্রি করে ফেলবার নয়, যা মানুষের জন্মমৃত্যু ক্রিয়াকলাপের মধ্যে চিরদিন অটলভাবে দাঁড়িয়ে আছে, প্রতিদিন সমানভাবে যাতায়াত করছে এবং চিরকাল অবিশ্রান্তভাবে প্রবাহিত হচ্ছে।’

গ্রীষ্মের এই কালবৈশাখী আর দাবদাহের সময় বোঝা সম্ভব নয়, ১৮৯২ সালের জানুয়ারি মাসে এই শিলাইদহে কেন রবীন্দ্রনাথ প্রকৃতির মধ্যে শীত আর বসন্তের যুগলবন্দী দেখেছিলেন। সে ছিল পূর্ণিমা রাত। রবীন্দ্রনাথ লিখছেন, ‘ঠিক আমার বাঁ দিকের খোলা জানলার উপরেই একটা মস্ত চাঁদ উঠে আমার মুখের দিকে তাকিয়ে আছে; বোধ হয় দেখছে আমি চিঠিতে তার সম্বন্ধে কোনো নিন্দে করছি কি না। সে হয়তো মনে করে তার জ্যোৎস্নার চেয়ে তার কলঙ্কের কথা নিয়েই পৃথিবীর লোকে বেশি কানাকানি করে।’

কলকাতায় যা খুবই স্বাভাবিক, এই শিলাইদহে তা একেবারেই অস্বাভাবিক। পড়ার মধ্যে কবি বিমল আনন্দ পেতেন। কিন্তু শিলাইদহে এসে ‘এলিমেন্টস্‌ অব পলিটিকস’ এবং ‘প্রবলেমস অব দ্য ফ্যুচার’ পড়তে পড়তে নিজেই অবাক হয়েছেন। বইগুলো পড়ছেন অথচ তা মনে ধরছে না। দুঃখ করে বলছেন, ‘এখানে পড়বার উপযোগী রচনা আমি প্রায় খুঁজে পাইনে, এক বৈষ্ণব কবিদের ছোটো ছোটো পদ ছাড়া’। ১৮৯২-এর এপ্রিলে তিনি যখন এই চিঠি লিখছেন, তখন তাঁর চোখের সামনে ‘যারা জল তুলছে, স্নান করছে, নৌকা বাচ্ছে, গোরু চরাচ্ছে, মেঠো পথ দিয়ে আসছে যাচ্ছে, তারা যেন যথেষ্ট জীবন্ত সত্য নয়।’ এ কথা পড়ে একটু ধাক্কা লাগে মনে। কিন্তু পরের কথাগুলোর দিকে তাকালে বোঝা যায়, শিলাইদহের এই প্রকৃতি তাঁকে কী অমূল্য উপহার দিয়েছে: ‘অন্য জায়গার মানুষরা ভিড় করে, তারা সামনে উপস্থিত হলে চিন্তার ব্যাঘাত করে, তাদের অস্তিত্বই যেন কুনুই দিয়ে ঠেলা দেয়, তারা প্রত্যেকে এক-একটি পজিটিভ মানুষ। এখানকার এরা সম্মুখে আনাগোনা চলাবলা কাজকর্ম করছে, কিন্তু মনকে ঠেলা দিয়ে যাচ্ছে না। কৌতূহলে সামনে দাঁড়িয়ে দেখছে, কিন্তু সেই সরল কৌতূহল ভিড় করে গায়ের উপর এসে পড়ছে না।’

শিলাইদহে এখনো ঝোড়ো হাওয়া বয়। সে রকম ঝড়জল মনে করিয়ে দেয়, একদিন শিলাইদহের পদ্মায় রবীন্দ্রনাথও যমরাজের সঙ্গে যুঝেছিলেন। তাঁর কাছে নদীকে মনে হয়েছিল ‘যেন লেজ-দোলানো কেশর-ফোলানো তাজা বুনো ঘোড়ার মতো।’ প্রবল ঝড় নিয়ে সেদিন, ১৮৯২ সালের ২১ জুলাই মাঝিরা বলছিল, নতুন বর্ষায় পদ্মার খুব ধার হয়েছে।’ রবীন্দ্রনাথ মেনে নিয়েছেন তা, বলছেন, ‘ধার কথাটা ঠিক। তীব্র স্রোত যেন চকচকে খড়্গের মতো, পাৎলা ইস্পাতের মতো একেবারে কেটে চলে যায়।’ তারপর তিনি সেই ঝড়ের বর্ণনা দিচ্ছেন, ‘কাল যে কাণ্ডটি হয়েছিল সে কিছু গুরুতর বটে। কাল যমরাজের সঙ্গে একরকম হাউ ড্যু ডু করে আসা গেছে। মৃত্যু যে ঠিক আমাদের “নেকস্ট-ডোর নেবার” তা এরকম ঘটনা না হলে সহজে মনে হয় না।’

বাড়ির ভেতরের আসবাব
বাড়ির ভেতরের আসবাব

শিলাইদহে এলে সঙ্গে যদি থাকে তাঁর চিঠির সংকলন ছিন্নপত্র, তাহলে আপনারও মনে হবে কোনো একদিন এইখানে রবীন্দ্রনাথ ছিলেন, আপনিও তাঁর অনুভবের কথাগুলো পড়তে পারবেন সেইখানে বসে, যেখানে একদিন প্রতিদিন ছিল রবীন্দ্রনাথের উপস্থিতি।

১৮৯১ থেকে ১৯০০ সাল পর্যন্ত রবীন্দ্রনাথ স্থায়ীভাবে বসবাস করেছিলেন পূর্ববঙ্গে। এ সময় তিনি দুহাতে লিখেছেন। অসংখ্য ছোট গল্প, সোনার তরী, চিত্রা কাব্যগ্রন্থের অনেক কবিতাও এখানে লেখা। শিলাইদহের এই জমিদারবাড়িটির আসবাবপত্র এখনো রবীন্দ্রস্মৃতিকে ফিরিয়ে আনে।