মায়ের মন কি বুঝি?

মায়ের হাসিমুখ দেখতে সন্তান হিসেবে তাঁর মনটা বুঝে িনন। ছবি: অধুনা
মায়ের হাসিমুখ দেখতে সন্তান হিসেবে তাঁর মনটা বুঝে িনন। ছবি: অধুনা

সকাল থেকেই নাফিস সাহেবের (ছদ্মনাম) বাসায় রান্নাবান্নার মহা তোড়জোড়। নানা পদের ভর্তা, মাছ, মাংস রান্না হচ্ছে। দুপুরবেলা মেহমানেরা খাবেন। তবে তাঁরা কোনো সাধারণ মেহমান নন, তাঁরা নাফিস সাহেবের আম্মার মেহমান, মানে আম্মার বান্ধবী। নাফিস সাহেবের আম্মা প্রতিদিন সকালে ধানমন্ডি লেকের পাড়ে হাঁটতে যান। সেখানে তাঁর সমবয়সী কয়েকজন বান্ধবী হয়েছেন, যাঁদের সঙ্গে তিনি গল্পগুজব করেন, ঘুরে বেড়ান। নাফিস সাহেব বললেন, ‘আম্মার খুব ইচ্ছা তিনি তাঁর বান্ধবীদের দাওয়াত করে খাওয়াবেন, বাসায় বসে আড্ডা দেবেন, আজ তাঁর সেই ইচ্ছা পূরণ হচ্ছে। তিনি খুব খুশি।’

নাফিস সাহেবের আম্মার মতো আমাদের প্রত্যেকের মায়ের মনেই হয়তো এ রকম ছোটখাটো ইচ্ছা, শখ, আহ্লাদ বা স্বপ্ন থাকে, যা নিত্যদিনের সংসার, সন্তান, দায়িত্ব, কর্তব্য আর অভাব-অভিযোগের নিচে চাপা পড়ে যায়। সংসারের সব ঝামেলা সামাল দিতে গিয়ে বাংলাদেশের মায়েরা একেকজন যেন সর্বংসহা ধরিত্রীর মতো হয়ে ওঠেন। অথচ এসবের বাইরে তাঁরও যে একটা মন আছে, সেই মনেরও যে কিছু চাওয়া-পাওয়া থাকতে পারে, তা আমরা কয়জন মনে রাখি? মা যে শুধু স্নেহ বিলানোর মেশিন নন, বরং তিনিও রক্তমাংসের একজন মানুষ, তাঁর আশা, আকাঙ্ক্ষা, ভালো লাগা, মন্দ লাগার বিষয় নিয়ে আমরা কয়জন সেভাবে ভাবি?

‘আমার মা সেদিন কথায় কথায় বলছিলেন, ছোটবেলা থেকে তাজমহলের এত গল্প শুনেছি, একবার তাজমহলটা দেখলাম না, আমরা সব ভাইবোনেরা মিলে তাই ঠিক করেছি, মাকে তাজমহল দেখাতে নিয়ে যাব।’ বলছিলেন খিলগাঁওয়ের শারমিন। ‘সারা জীবন মা আমাদের শখ পূরণ করেন, আমাদের মনের খোঁজখবর রাখেন, আমাদের উচিত তাঁর প্রতিদান দেওয়া। যতটা সম্ভব মায়ের মনের খোঁজখবর রাখা।’

সব সময় মায়েরা যে মুখ ফুটে নিজের ইচ্ছার কথা বলেন, তা-ও নয়, অনেক সময় সন্তানের সেটা হৃদয় দিয়ে বুঝে নিতে হয়, যেমন মা বুঝে নেন সন্তানের কোনটা পছন্দ, কোনটা অপছন্দ, তেমনি সন্তানদেরও বুঝতে হয় মায়ের মনের কথা। আর সেটা বোঝা যেকোনো সংবেদনশীল সন্তানের পক্ষে খুব সহজেই সম্ভব।

কোনো মা হয়তো বাগান করা পছন্দ করেন। তাঁকে কিছু গাছের চারা উপহার দেওয়া যায়। কোনো মা হয়তো আত্মীয়স্বজনের সঙ্গে সময় কাটাতে ভালোবাসেন, মায়ের মন ভালো করার জন্য তাঁকে সে রকম সময় কাটানোর সুযোগ করে দিতে পারেন সন্তানেরা।
‘গ্রামের গরিব আত্মীয়দের দান-খয়রাত করতে পারলে আমার মায়ের মনে খুব আনন্দ হয়।’ বলছিলেন হাতিরপুলের বাসিন্দা মিজানুর রহমান।
কোনো মা গ্রামে থাকতে ভালোবাসেন, কোনো মা হয়তো ঘুরে বেড়াতে পছন্দ করেন। কোনো মায়ের আজীবন শখ হয়তো একটা সোনার বালা বানানো, সংসারের টানাপোড়েনে যে শখটি পূরণ হয়নি। সামর্থ্য থাকলে মায়ের সেই শখটা পূরণ করেই দেখুন না, মায়ের হাসিমুখ কীভাবে আপনাকে উজ্জীবিত করে। আসলে, সন্তানের আনন্দ যেমন মাকে আনন্দিত করে, মায়ের আনন্দও তেমনি সন্তানের মন ভরিয়ে দিতে পারে।

আচ্ছা, এত দেওয়া-নেওয়ার কথা না হয় বাদই দিলাম। আপনি যখন দূর থেকে ফোন করে মায়ের খবর নেন, মায়ের সঙ্গে দুটো ভালো-মন্দ কথা বলেন, তখন তাঁর মনটা কেমন খুশি হয়ে ওঠে, বুঝতে পারেন তো? আর কিছু না হোক, মায়ের মন ভালো রাখতে, হাতের কাজটা কয়েক মিনিটের জন্য সরিয়ে রেখে, মায়ের সঙ্গে একটু কথা তো বলতেই পারি আমরা! মুখে না বললেও ছোট ছোট কাজ দিয়ে বুঝিয়ে দিতে পারি, মা, আসলেই তোমাকে ভালোবাসি। তোমার মনের যত্ন নিই, যেভাবে তুমি যত্ন নিয়েছ আমার।

লেখক: সাংবাদিক ও সাহিত্যিক