আম্মার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিই

মা বেগম জীবুন্নেছার সঙ্গে মেয়ে তাসলিমা আখতার। ছবি: সংগৃহীত
মা বেগম জীবুন্নেছার সঙ্গে মেয়ে তাসলিমা আখতার। ছবি: সংগৃহীত
>

আগামীকাল মা দিবস। পাঠকদের জন্য মায়ের কথাই লিখেছেন, আলোকচিত্রী তাসলিমা আখতার।

সব সময় পর্দার আড়ালে থাকা একজন ছিলেন; আমার জীবনে অনেক ঘটনার নেপথ্যে। তাঁর সঙ্গে মতের অনেক অমিল থাকলেও তাঁর কাছে যে ঋণ, তা পরিশোধের নয়। তাঁর মতো মানুষের কাছে দায়ও আছে মেলা। সেই দায় থেকেই লিখছি। প্রিয় সেই মানুষ, সেই নারীর সঙ্গে জড়িয়ে আছে আমার জীবন, পৃথিবীতে আলো-বাতাসের স্বাদ-যন্ত্রণা নেওয়াসহ জীবনের নানা অভিজ্ঞতা। তাঁর নাড়িছেঁড়া অংশ আমি। তিনি আমার জন্মদাত্রী মা বেগম জীবুন্নেছা। তাঁর সাত-সাতটা সন্তানের জন্মের পর আমার জন্ম। তাঁর হাত ধরেই হাঁটতে শেখা, দুনিয়াকে প্রথম চেনা।

বেগম জীবুন্নেছা ১৯৩৫ নোয়াখালী জেলার রামনাথপুর গ্রামে জন্ম নেন। বড় হন গ্রামেই। খুব অল্প বয়সে তাঁর বাবা মৌলভি জালাল আহমেদ মারা যান এবং মা ফয়জুন্নেছার বিয়ে হয়ে যায় অন্য জায়গায়। তিনি বড় হন গ্রামে চাচা-ফুফুদের কাছে। পড়াশোনা বেশি হলে পাঁচ ক্লাস। তাঁর কাছে গল্প শুনেছি, বিয়ে হয় ১৬ বছর বয়সে ১০ বছর বেশি বয়সী আমার বাবা সামসুল হুদার সঙ্গে। ওই সময়ে বিয়ের জন্য ১৬ বছরকে অনেক বেশি বয়স ধরা হতো।

বেগম জীবুন্নেছাকে ‘আম্মা’ বলেই ডাকতাম। গত ৮ মার্চ ছিল নারী দিবস আর ৯ মার্চ আম্মার দ্বিতীয় মৃত্যুবার্ষিকী। এক অনুষ্ঠানে মা নিয়ে বলব ঠিক করি। তখন থেকেই তাঁকে নিয়ে নতুন করে ভাবা শুরু। সেই ভাবনাগুলোই এখানে ভাগাভাগি করব।

সন্তানদের বড় করতে গিয়ে ‘মা’ আর সংসার করতে গিয়ে ‘গৃহিণী’র পরিচয় তৈরি হয়েছিল তাঁর। জানতাম, তিনি খুব খুশি হতেন সন্তানেরা কাছে থাকলে, তাদের ভালোভাবে খাওয়াতে পারলে, তাদের আবদার পূরণ করতে পারলে। কোনো বিষয়ে রাগারাগি হলে কদিন পরই যখন ক্ষুধার্ত অবস্থায় সামনে যেতাম, তিনি সব রাগ ভুলে যেতেন। স্মৃতিকাতরতায় আরও ভাবি, এর বাইরে কী ছিল তাঁর একান্ত ভালো লাগা-মন্দ লাগা বা স্বপ্ন। খুঁজি কী তাঁর বিশেষত্ব, যার মধ্যে তাঁর নিজের পরিচয় খুঁজে পাওয়া যায়? আর অস্থির-অসহায় হই যখন বুঝি, যে অবসরে আম্মা নিজের সম্ভাবনার যত্ন করতে পারতেন, তার সবটাই তাঁর সন্তান, স্বামী, সংসার কেড়ে নিয়েছিল।

মনে করার চেষ্টা করি, যদি একচিলতে অবসর জুটত, তখন নিজের জন্য কী করতেন আম্মা? হঠাৎ মনে পড়ে, তিনি বাগান করতে ভালোবাসতেন। বাড়ির আঙিনায় কিংবা ছাদজুড়ে তিনি শাকসবজি, ফলমূল ও ফুলের চাষ করতেন। মনে পড়ে, তিনি খুব ভালোবাসতেন কাঁথা সেলাই করতেও। তাঁর সেলাই করা অনেক কাঁথা এখনো আছে। একটা কাঁথা সম্ভবত ৩০ বছরের পুরোনো। একটু ফিকে কমলা রঙের পুরোনো শাড়ির নরম কাপড় দিয়ে তৈরি সেটা। ছোটবেলা ওই কাঁথা অনেক আদর-যত্নে গায়ে দিতাম। এখন সেটা অনেক ছিঁড়ে গেছে, তবু ওই সেলাই ফোঁড়ে লতা-ফুলের চিহ্নের মধ্যে মায়ের পরিচয় খুঁজি।

ছোটবেলার আরও স্মৃতি ঝাপসা হয়ে সামনে আসে। আমার বয়স ১০ কিংবা ১১। তখন গ্রামের বাড়িতে, এমনকি আমাদের শহরের বাসায়ও ঘরের বিভিন্ন কোণে ছোট ছোট কাঠের ফ্রেমে, সাদা কাপড়ে লাল কিংবা সবুজ সুতায় সুই দিয়ে আম্মার হাতের কাজ। লেখা ‘ওয়েলকাম’, ‘মা ছাড়া সংসার অরণ্য’ এমনই নানা কথা, প্রবাদবাক্য। ফ্রেম, সুতার রং যতটা মনে পড়ে, সব ফ্রেমের কথা কিছুতেই মনে পড়ে না। সেগুলো কোথায় হারিয়ে গেছে আমার ভাইবোন কেউ বলতে পারবে না। কিন্তু সবাই জানে সেগুলো ছিল আম্মার করা।

আম্মা এসব ভালো লাগার যত্ন করার সময় সুযোগ কমই পেতেন। তাঁর বেশির ভাগ সময় যেত সন্তান-স্বামী আর সংসারের পেছনে। তাঁর সন্তানদের কেউ চিকিৎসক, কেউ ব্যবসায়ী, টেক্সটাইল ইঞ্জিনিয়ার, পিএইচডি ডিগ্রিধারী, রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বসহ নানা পেশায়, নানা পরিচয়ে। সন্তানদের এসব পরিচয় তৈরির পেছনে লুকিয়ে আছে মায়ের কাঠখড় পোড়ানো পরিশ্রম। একই সঙ্গে তাঁর স্বামীর ব্যবসায়ী পরিচয়ের সাফল্য তৈরি করতে গিয়েও ঘরের সব ক্লান্তিকর বোঝা তাঁকেই বইতে হয়েছে। সেসব না করতে হলে হয়তো তিনি তাঁর ‘পরিচয়’ দাঁড় করার ফুরসত পেতেন। হতেন কোনো বড় চিত্রশিল্পী, পরিবেশবিদ, ভেষজ চিকিৎসক, বিজ্ঞানী আরও বড় কিছু। কিন্তু এসব কিছুই হওয়া হয়নি তাঁর। সমাজ ইতিহাসে নাগরিক এবং ব্যক্তিসত্তা হিসেবে তাঁর নিজের কোনো আলাদা পরিচয় দাঁড়ায়নি।

মায়ের সঙ্গে মতের মিলের অভাবের কারণে প্রায়শই বিরক্ত থাকতাম, কখনো রাগ করে দেখা-সাক্ষাৎ কম করতাম। এখন সেসব রাগ কিচ্ছু নেই। বরং এখন টের পাই আম্মা জীবনে কখনো নিজের মতো চর্চার সুযোগই পাননি। আমার বাবার মত কিংবা সমাজের পুরুষতান্ত্রিক মতামত চিন্তাই আমার মা-ও ধারণ করতেন। মা একজন নারী হয়েও, সব সন্তানকে সমান সময় গর্ভে ধারণ করেও, পারিপার্শ্বিক চাপে সম্পত্তিতে ছেলেমেয়ের সমান অধিকার নিয়ে ভাবতে পারেননি। তিনি পরিবারের কোনো বড় সিদ্ধান্ত নিতেন না, নিতেন বাবা। ব্যাংকের চেক বইয়ে কীভাবে স্বাক্ষর করতে হয়, সেটাও জানতেন না তিনি। নিজের গ্রামের বাড়ি, শহরের বসতবাড়ি এবং খুব অল্প হাতে গোনা আত্মীয়স্বজনের বাড়ি ছাড়া কিছুই চিনতেন না। ঢাকা টু নোয়াখালী ছিল তাঁর বিচরণ। শেষ বয়সে হজ করতে মক্কায় যান। অথচ আমার বাবা সামসুল হুদা সারা দুনিয়ার বহু দেশে কাজে ঘুরে বেড়িয়েছেন, অভিজ্ঞতা অর্জন করেছেন। যার ছিটেফোঁটা পাননি তিনি। আম্মা গল্প করতে খুব ভালোবাসতেন। কখনো কখনো বিরক্ত হতাম। এখন আফসোসের সীমা নেই, কেন তাঁর জীবন, সেই সময়ের নারীদের সমস্যা, নারী-পুরুষ সম্পর্কের ধরন, এসব তাঁর কাছ থেকে জেনে নিইনি।

পাঠকের সঙ্গে আম্মাকে পরিচয় করিয়ে দিতে গিয়ে এ দেশের হাজারো মায়ের কথা স্মরণ করি। স্যালুট জানাই আমার মা এবং আর সব মাকে, যাঁরা প্রজাতি রক্ষার গুরুতর কাজ করে আসছেন।

সভাপ্রধান, বাংলাদেশ গার্মেন্ট শ্রমিক সংহতি ও আলোকচিত্রী