সুলতান সুলেমানের দেশে

ইস্তাম্বুলে হাজিয়া সোফিয়া
ইস্তাম্বুলে হাজিয়া সোফিয়া

‘সুলতান সুলেমান’ টিভি সিরিয়ালের কারণে তুরস্কের বিভিন্ন শহর আমাদের কাছে এখন বেশ চেনা চেনাই লাগে। বিশেষ করে ইস্তাম্বুল। সেই ইস্তাম্বুলে অনেক বছর ধরে বসবাস করছেন আমাদের আত্মীয় সৈকত ও তাঁর স্ত্রী সৌতী। গত বছরের শেষ নাগাদ পরিকল্পনা হলো ছুটিতে সেখানে ঘুরতে যাওয়ার। এবারও সঙ্গী স্ত্রী আইরিন।

সৈকত তুর্কি ভাষা বলতে পারেন ভালোই। তাই আমাদের ভাষাগত সমস্যায় পড়তে হয়নি। তুরস্কে যাওয়ার আগে একগাদা গরম কাপড় কেনা হয়েছিল। কিন্তু ইস্তাম্বুল গিয়ে দেখলাম শীত মোটামুটি সহনীয়। খোঁজ নিয়ে জানা গেল বুরসা শহরে নাকি বরফ পড়া শুরু হয়েছে। চট করেই সিদ্ধান্ত হলো বুরসা যাওয়ার। ইস্তাম্বুলের পাশের শহর বুরসা।

একদল পর্যটকের সঙ্গে বাসে চেপে আমরা বুরসা গেলাম বরফের খোঁজে। বুরসার কাছাকাছি যেতেই রাস্তার দুই পাশে দেখা মিলল বরফের। ছোপ ছোপ বরফ। বাস যত এগোয় বরফ তত বাড়ে। বাস থামল একটা পার্কে। সেখানে অল্প বরফ দেখে মন কিছুটা দমে গেল। ঝিরিঝিরি বৃষ্টির মধ্যে দেখা গেল রংধনু। বাস আবার চলতে শুরু করল। ট্যুর গাইড বললেন, ‘আমরা বরফের রাজ্যে প্রবেশ করতে যাচ্ছি। কয়েক মিনিট পর যে রাস্তায় বাস ঢুকল, সেটার দুই পাশ বরফে সাদা হয়ে আছে। রাস্তার পাশেই একটা হোটেলে দুপুরের খাবার খেতে নামলাম আমরা। খাবার শেষ করে বাসে যে-ই না উঠব, তখনই শুরু হলো তুষারপাত। আনন্দে ফটাফট ছবি তুলতে লাগলাম। কিছুক্ষণ পর আবার বাসে চেপে বসলাম।

আন্তালিয়া জাদুঘর
আন্তালিয়া জাদুঘর

পরদিন ইস্তাম্বুলে ঘুরে দেখলাম বিখ্যাত ব্লু মসজিদ, হাজিয়া সোফিয়া, ইস্তাম্বুল বিশ্ববিদ্যালয়। বিশ্বের বিভিন্ন স্থান থেকে আসা শত শত পর্যটক খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখছেন এসব স্থাপনা। প্রতিটি মসজিদ আলাদা গম্বুজশৈলীর কারণে বিখ্যাত। রাতের বেলা আলোর খেলা এসব মসজিদের চারদিকে। তোপকাপি প্রাসাদের কথা আলাদাভাবে বলতে হয়। রাজকীয় এই প্রাসাদ ইস্তাম্বুলের ঐতিহাসিক এলাকার অন্তর্ভুক্ত, যা ১৯৮৫ সালে ইউনেসকো কর্তৃক বিশ্ব ঐতিহ্যবাহী স্থান হিসেবে ঘোষিত হয়েছে।

সুলতান সুলেমানের রাজত্বের কেন্দ্রস্থল এই প্রাসাদ ঐতিহাসিকভাবে বিখ্যাত। এখানে রয়েছে ১৪০০ সালের বিখ্যাত কাপালি কারশি বাজার। বাজারে ঢুকতেই ছোট্ট একটি দোকানে সুলতান সুলেমান আর হুররাম সুলতানের পোশাকের মতো পোশাক পরে ছবি তোলার আয়োজন। খানদানি পোশাক, আংটি, তরবারি নিয়ে কিছু ছবি তুললাম আমরা। পোশাক পরে ছবি তুলতে বাংলাদেশের টাকায় সাড়ে ৪ হাজার টাকা লাগে এখানে।

পরের গন্তব্য বসফরাস প্রণালি। এর একদিকে এশিয়া, অন্যদিকে ইউরোপ। দুই দিনে ইস্তাম্বুল ঘুরে দেখা শেষ। এখন আমাদের গন্তব্য প্রিন্সেস আইল্যান্ড। জাহাজের টিকিট করে ছাদে উঠলাম আমরা। কী অদ্ভুত নীল পানি। জাহাজ থেকে দেখা যায় ইস্তাম্বুল শহর। জাহাজের ছাদে খাবার ছিটিয়ে দিচ্ছেন পর্যটকেরা। শত শত পাখি হাত থেকে খাবার ছোঁ মেরে নিয়ে যাচ্ছে। সে এক দারুণ দৃশ্য। দুই ঘণ্টার পথ পেরিয়ে আমরা এলাম কাঙ্ক্ষিত দ্বীপে। এই দ্বীপের প্রতিটি বাড়ি যেন একেকটা রাজপ্রাসাদ। বাড়ির সামনে বড় উঠান। গাছে আঙুর ধরে আছে।

পার্জ
পার্জ

তুরস্কের আরেক শহর আন্তালিয়া। অনেকে একে আনাতলিয়াও বলে। এখানে দেখার মতো দুটো ঝরনা আছে। কুরসুনলু আর দুদেন ঝরনা। দুটোই একই পথে। দুদেন ঝরনাটা সবচেয়ে বড়। পানি পড়ার শব্দ যেমন পাওয়া গেল তেমনি পানি বয়ে যাওয়ার কলকল শব্দও কানে আসবে। আনাতলিয়ার পুরোনো শহরে রাতে না গেলে বোঝাই যেত না কত সুন্দর আয়োজন। এখানে পুরোনো ভবন আছে কয়েকটি। সেগুলোয় আলোর উপস্থাপনা সত্যিই দেখার মতো। এই শহরের চারদিকে নীল পাহাড়। রাস্তার পাশে বড় বড় কমলা, বেদানা, মাল্টা আর টমেটোর খেত। রাস্তার পাশে গাছে গাছে থোকায় থোকায় ধরে আছে ফল। দেখতে ভালোই লাগছে।

এখানকার ভূমধ্যসাগরের নীল পানি দেখে মুগ্ধ না হয়ে উপায় নেই। রাশিয়া থেকে সবচেয়ে বেশি পর্যটক আসে এখানকার সমুদ্রসৈকতে। বড় বড় হোটেলের রয়েছে নিজস্ব সৈকত। আনাতলিয়ার জাদুঘর অনেক সমৃদ্ধ। ভাস্কর্যগুলো এতটাই নিখুঁত যে মনে হবে জীবন্ত মানুষ দাঁড়িয়ে আছে। স্থাপনাও চমৎকার। তুরস্কের অন্যতম বড় এই জাদুঘরের বিশেষত্বই এখানে। এখানে প্রবেশের পর ছবি তোলা হলো বেশ কিছু। তবে ক্যামেরার ফ্লাশলাইট ব্যবহার করা যায় না।

আন্তালিয়ায় ভূমধ্যসাগরের অপার সৌন্দর্য। ছবি: লেখক
আন্তালিয়ায় ভূমধ্যসাগরের অপার সৌন্দর্য। ছবি: লেখক

জাদুঘর থেকে বেরিয়ে কিছুদূর গেলেই পাহাড় থেকে দেখা যায় নিচের নীল সমুদ্রসৈকত। সেখানে পাহাড়ের ওপর ছোট ছোট খাবারের দোকান। এমনি একটি পাহাড় থেকে দেখা যায় গভীর এক খাদ। খাদের দিকে একবার তাকিয়েই চোখ ফেরাই দিগন্তরেখায়।