দক্ষিণ ইথিওপিয়ার পথে পথে

ঘুরতে ঘুরতে ইচ্ছে হয় পাহাড়ি প্রকৃতির মধ্যে হারিয়ে যেতে। ছবি: লেখক
ঘুরতে ঘুরতে ইচ্ছে হয় পাহাড়ি প্রকৃতির মধ্যে হারিয়ে যেতে। ছবি: লেখক

সে কী চমৎকার পাহাড়ি উপত্যকা—প্রকৃতির সঙ্গে নিজেকে হারানোর মুহূর্ত; তবু পথে যেতে যেতে স্থানীয় মানুষের জীবনযাত্রা দেখে মনের কোণে মেঘ জমে উঠত। তাই ইথিওপিয়ার দক্ষিণাঞ্চল মনের ভেতর বেশ দাগ কেটে গেছে। প্রায় শুকনো নদী থেকে হলুদ প্লাস্টিকের বোতলে করে পানি তুলে আনার দৃশ্য, পথের পাশে দাঁড়িয়ে প্রচণ্ড রোদে কয়লা বিক্রি, পাহাড় থেকে শুকনো খড়ি বয়ে আনা সেই পাহাড়ি মা আর ছোট মেয়েটির চাহনি—সবই এখন ভেসে আসছে দুচোখের পাতাজুড়ে। জীবনের ভিন্নতা মানুষে মানুষে, কিন্তু কোথাও যেন একই সুরে গাথা এই জীবন।

১৪ মে। ইথিওপিয়ার রাজধানী আদ্দিস আবাবার ভোরের পাখির ডাকে চোখ খুলল। চোখ মেলেই দেখি সকাল ছয়টা। আরবা মিঞ্চের দিকে যাত্রীবাহী বাস ততক্ষণে ছেড়ে গেছে। হা–হুতাশ না করে একটা ভিন্নধর্মী অ্যাডভেঞ্চারের চিন্তা করলাম। হাত-মুখ ধুয়ে একটা লোকাল বাসে রওনা দিলাম ‘মিস্ট্রিজ অব সাউথ ইথিওপিয়া’খ্যাত আরবা মিঞ্চের দিকে। বাসটি আরামদায়ক না হলেও খুব একটা খারাপ ছিল না। ভিনদেশি দেখে যাত্রীরা খুব যত্ন করে বসাল। পাশের আসনে বসলেন তরুণ এক ইথিওপীয় চিকিৎসক। হাসিমুখেই জানতে চাইলেন বাংলাদেশের কথা। তাঁর পাশে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সদ্য পাস করা এক ছাত্র। প্রায় ৮ ঘণ্টা পথ চলতে চলতে অনেক কথা হলো।

দক্ষিণ ইথিওপিয়ায় লেখক
দক্ষিণ ইথিওপিয়ায় লেখক

বাস বদলাতে হলো। আবারও পাঁচ ঘণ্টার পথ। দুর্গম পথ পাড়ি দিয়ে যেতে হবে আরবা মিঞ্চ শহরে। বাসে পরিচয় হলো যুক্তরাষ্ট্র থেকে আসা ফেইথের সঙ্গে। পিস অ্যান্ড কোর নামে এক সংস্থার স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে এই নারী এসেছিলেন দক্ষিণ ইথিওপিয়ায়, এই পাহাড়ি উপত্যকার গ্রামের মানুষের জন্য কাজ করছেন।

রাত নয়টায় পৌঁছালাম আরবা মিঞ্চে। শহরটাকে আমার খুবই আপন মনে হলো। এই শহরের গল্প আমার জানা লোলার জন্য। সে আমার বন্ধু। তার বাসাতেই থাকার ব্যবস্থা হয়েছে। যদিও লোলা এখন দক্ষিণ কোরিয়ায়। তার ভাই ভেলাই আর বোন জেনেট আমাকে অভ্যর্থনা জানাল।

ঘরটা যেন প্রকৃতিরই অংশ
ঘরটা যেন প্রকৃতিরই অংশ

আমার আসা উপলক্ষে বাসায় ইথিওপিয়ার জনপ্রিয় ‘বুনা তেতু পার্টি’ হলো। বুনা মানে কফি পান করা। কফির বীজকে ধুয়ে, পুড়িয়ে, পিষে পাউডার করে সেটাকে কয়লার ছোট্ট চুলার মধ্যে একটা মাটির পাত্র বসিয়ে কফির পাউডার ঢেলে পানি দিয়ে কফি বানানো হয়। ওই বানানো মুহূর্তটি খুবই চমৎকার। শুধু তা-ই নয়, এক ধরনের লম্বা পাতা ঘাস কেটে তারা ডাইনিং হল রুমে সেটা ছিটিয়ে দিয়ে তার ওপর বসে কফি বানায়। পান করলাম ইথিওপিয়া ও পৃথিবী বিখ্যাত সেই কফি। চমৎকার স্বাদ। এককথায় এ যেন কফিপূজা।

এক নিভৃত গ্রামে
এক নিভৃত গ্রামে

ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর মানুষের গ্রামে

দুই দিন পর আরেক অভিযাত্রা। বের হলাম খুবই দুর্গম এক গ্রামে। ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর মানুষ থাকে এখানে। আরব মিঞ্চ থেকে কনসটে গিয়ে থামলাম। যেতে যেতে পথে কোনো সুন্দর পাহাড়ি দৃশ্য বা গ্রাম দেখলেই আমরা দাঁড়িয়ে যেতাম। স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলত জেনেট। তারপর আমাকে বুঝিয়ে দিত। পাহাড়ি প্রকৃতির মধ্যে ওদের জীবন খুবই কঠিন। তবু তাদের বেঁচে থাকার শুদ্ধতা অপূর্ব। পাহাড়ের কোলে ফসল ফলানো, গবাদিপশু লালন-পালন, মেয়েরা পাহাড় থেকে মাথায় করে কাঠখড়ি বয়ে আনে, দূরের কোনো শুকিয়ে যাওয়া নদী থেকে একটুখানি পানি হলুদ প্লাস্টিক বোতলে করে বয়ে আনার সেই দৃশ্য যেন বেঁচে থাকার এক কঠিন জীবনকে চিনিয়ে দেয়।

পাহাড় থেকে খড়ি নিয়ে ফিরছেন দুজন
পাহাড় থেকে খড়ি নিয়ে ফিরছেন দুজন

এভাবেই আমরা দুপুরে পৌঁছালাম কনসো শহরে। এই শহরের পাহাড়ি প্রকৃতি দারুণ। দুপুরটা এখানে পার করে রওনা দিলাম কাফফা শহরের উদ্দেশে। বিকেল গড়িয়ে এল, সূর্য হেলে পড়ল, আমরা চলছি পাহাড়ের বাঁকে বাঁকে। কোথাও যেন কোনো বসতি নেই, দু-একটি গরুর পাল নিয়ে যাচ্ছে রাখাল, কেউ কেউ ছাগলের পাল নিয়ে ফিরছে পাহাড়ি কোনো সুনসান গ্রামে। পুরো যাত্রাপথে এটি খুবই সাধারণ দৃশ্য। এমন চমৎকার দৃশ্য আমার ভাবনার দিগন্তকে আরও প্রসারিত করল যেন।

সূর্য তখন ডুবুডুবু। কোনো এক পাহাড়ের কোলে, মিষ্টি নরম এক লাল-হলুদ আভা আকাশজুড়ে। ‘অপূর্ব, অপূর্ব’, বলছিলাম মনে মনে। রাত গড়িয়ে এল। পাহাড়ি জঙ্গলে সেই অ্যাডভেঞ্চার। জেনেট খুবই দ্রুত গাড়ি চালিয়ে যাচ্ছে। কোনো প্রাণীর আক্রমণ হতে পারে বেশি রাত হলে। পাহাড় পেরিয়ে কী গহিন জঙ্গল। জেনেট আমাকে বারবার বলছে ভয় পেয়ো না। ওই জঙ্গলে খুবই সরু একটা রাস্তা আমরা পার হচ্ছি, যেন আমাজনের জঙ্গলকে হার মানিয়েছে। প্রায় ২৫ মিনিট এভাবেই পার হতে হয়েছিল।

সাপ্তাহিক বাজার
সাপ্তাহিক বাজার


ঘুম ভাঙল পাহাড়ি শহরে

জেনেট এসে আমাকে বলল তাড়াতাড়ি তৈরি হয়ে নিতে। তার ডাকেই ঘুম ভাঙল সেই পাহাড়ি কাফফা শহরে। বৃহস্পতিবার ইথিওপিয়ার ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর মানুষের হাটবার। ভাষা ও নিরাপত্তার জন্য আগে থেকেই আমাদের একজন গাইড ঠিক করা ছিল। সকালে আমরা বের হলাম। গন্তব্য বাজার। একে একে বহুদূর হতে পাহাড়ি জঙ্গল বেয়ে বিভিন্ন এলাকা থেকে বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মানুষ আসতে শুরু করল।

এভাবেই প্রতি বৃহস্পতিবার তারা সমবেত হয়। তরুণ-তরুণীদের দেখা যায় বেশি। হাতে বানানো ঐতিহ্যবাহী জিনিসপত্র নিয়ে আসে বিক্রির জন্য। বিক্রি করতে পারলে যাওয়ার সময় কিছু খাবার কিনে নিয়ে যায়। সপ্তাহে এই এক দিনই তাদের আনন্দের দিন।

সেখানে গিয়ে তাদের জীবনযাত্রা সম্পর্কে জানলাম। জলহনি নামে এক নারী আমাকে তাঁর হাতে নকশা করা টুপি উপহার দিলেন। সারা দিন তাঁদের সঙ্গে কাটিয়ে রওনা হলাম আবার কনসোর উদ্দেশ্যে। পরের দিন জেনেট আমাকে নামিয়ে কংস থেকে আরবা মিঞ্চ রওনা হলো। আমি ভোররাতে বাসে করে রওনা হলাম কেনিয়ার উদ্দেশে। এ যাত্রা আমাকে অনেক কিছু শিখিয়েছে। অনেক ভালোবাসা দিয়েছে।

বাজারে যাচ্ছেন স্থানীয় দুই নারী
বাজারে যাচ্ছেন স্থানীয় দুই নারী


লেখক: পর্যটক