মৃদু সৌরভের মতো ভালো লাগা

ভালো লাগা হয়তো আছে, কিন্তু মুখ ফুটে তা আর বলা হয় না। মডেল: রাজন ও তূর্যি। ছবি: কবির হোসেন
ভালো লাগা হয়তো আছে, কিন্তু মুখ ফুটে তা আর বলা হয় না। মডেল: রাজন ও তূর্যি। ছবি: কবির হোসেন

এ যুগে লোকে নাকি আর সেভাবে প্রেমে পড়ে না। প্রেমে পড়া বলতে প্রেমে ‘পড়া’ই বোঝানো হচ্ছে। মানে পতন। কথাটা বলেছেন এ কালের জনপ্রিয় দার্শনিক স্লাভোই জিজেক। তাঁর মতে, একটা মেয়ে ও ছেলে যখন দৈবচক্রে মুখোমুখি হয়ে বিদ্যুৎতাড়িতের মতো বুঝতে পারে, আরে, এর জন্যই তো এতকাল অপেক্ষায় ছিলাম—তখন সেটাকে বলতে হবে প্রেমে পড়া। তখন দুজনেরই সাজানো জগৎ ওলট-পালট হয়ে যায়, গৌণ হয়ে যায় বন্ধু-বান্ধবের আড্ডা, অফিস-পেশা, সমাজ-সামাজিকতা। প্রেমে পড়া মানুষের জগৎ ভেতর থেকে বদলে যায়। এ জন্য সব ভাষাতেই প্রেম হওয়ার ব্যাপারটাকে ‘প্রেমে পড়া’ বলে। ইংরেজিতে যেমন বলে, ফল ইন লাভ। 

তা, এ যুগে লোকে আর প্রেমে পড়ে না কেন? কারণ, সবার মধ্যে নাকি এখন একটা প্রেম-ভীতি ভর করেছে। আমরা প্রেমে পড়তে ভয় পাই। ওই যে পতনের বেদনা, সাজানো জগৎটা লন্ডভন্ড হয়ে যাওয়ার ঝক্কি—আমরা সতর্ক আধুনিকেরা আর সেটা পোহাতে রাজি নই। ঠিক যেমন করে আমরা মিষ্টি খেতে চাই চিনি ছাড়া, দুধ খেতে চাই ননি ছাড়া, ঠিক তেমনি আমরা পতনের আঘাতহীন নিরাপদ প্রেম প্রত্যাশা করি। এ কারণে জিজেক মনে করেন, একালে সম্পর্কই হয় কেবল, প্রেম আর হয় না।
ফরাসি দার্শনিক জাঁক দেরিদার কাছে এক সুন্দরী সাক্ষাৎকারগ্রহীতা যখন জানতে চেয়েছিলেন, প্রেম ব্যাপারটাকে তিনি কীভাবে দেখেন? দেরিদা কৌতুকচ্ছলে বলেছিলেন, ‘আমি কি প্রেম শুনলাম, নাকি মৃত্যু?’
দেরিদার ঠাট্টা তবু নেওয়া যায়, জিজেকের কথাটা মানা যায় না কিছুতেই। দেখেশুনে মনে হয়, আগের যেকোনো সময়ের চেয়ে একালে মানুষ প্রেমে আরও বেশি বেশি করে পড়ছে, পড়তে পারছে, পড়ার উপযুক্ত পরিস্থিতির মধ্যে সারাক্ষণই বিরাজ করছে। একালে বিদ্যায়তন আর কর্মক্ষেত্রেই শুধু নারী ও পুরুষকে কাছাকাছি এনে দেয়নি, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম দুনিয়ার সব মানুষকে যেন পাশাপাশি এক টেবিলে বসিয়ে দিয়েছে, মাউসের এক-ক্লিক দূরে বড় গা ঘেঁষাঘেঁষি করে আছি আমরা। একালে সম্পর্ক তৈরি হওয়ার চেয়েও দ্রুতবেগে প্রেম হয়ে যেতে পারে, হয়ে যায়।
এ কারণে যে বাঁধভাঙা প্রেমের অনুপস্থিতিতে জিজেক হা-হুতাশ করছেন, আমাদের বরং সেটার ব্যাপারে সতর্ক থাকতে হয়। সামাজিক মানুষ সদা সতর্কই থাকেন। জগতের ভারসাম্যে তিনি টোকা দিতে চান না। ঘরে-না-থাকা-উচাটন-মন নিয়ে তিনি ঘুরে বেড়ান বটে, তবে সারাক্ষণই বিড়বিড় করে বলেন, ডু আই ডেয়ার ডিস্টার্ব দ্য ইউনিভার্স?
তবু, মেপে চলা এই সতর্ক সামাজিক জীবনে কোনো ফাঁকে কোনো খোলা জানালা দিয়ে ঢুকে পড়তে পারে দুপুরের রোদ। একটা মৃদু অচেনা সৌরভে ভরে যেতে পারে আপনার অভ্যস্ত ঘরদোর, অগোছালো ইনবক্স।
ভালো লাগার রসায়ন বড় জটিল। সেটা আজও কেউ ভেদ করতে পারেনি। হতে পারে, একই লিফটে কিছুক্ষণ পাশাপাশি উঠতে পারার মতো সূক্ষ্ম অনির্দেশ্য সাফল্যের মৌতাত আপনাকে ঘিরে রাখে। হতে পারে ভোরবেলা একই বাসের জন্য একই সারিতে অপেক্ষা করার মতো পৌনঃপুনিকতাপ্রত্যাশী হয়ে উঠেছেন আপনি। এর বেশি কিছু আপনি আকাঙ্ক্ষা করেন না। আপনি ওখানেই থামতে চান। জগৎকে বিরক্ত করার কোনো বাসনা আপনার নেই।
ঠিক যেমন ‘জন্ম হয় না মৃত্যু হয় না’ কবিতায় সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় লিখেছেন, আমার ভালোবাসার কোনো জন্ম হয় না/মৃত্যু হয় না—/কেননা আমি অন্য রকম ভালোবাসার হীরের গয়না/শরীরে নিয়ে জন্মেছিলাম।/আমার কেউ নাম রাখেনি, তিনটে-চারটে ছদ্মনামে/আমার ভ্রমণ মর্ত্যধামে।’
হতে পারে, এসব ভালো লাগার মধ্যে রক্তে ডোপামিনের প্রবাহ বেড়ে যাওয়া নেই, নেই নাম-না-জানা এনজাইমের ছোটাছুটি। মগজের কোনো অংশের কার্যক্রম এতে বিপর্যস্ত হয় না। এর কোনো নামই আপনি দিতে পারছেন না। চাইলে দিন শেষে জামায় লেগে থাকা ধুলার মতো অনায়াসে আপনি সেটাকে ঝেড়ে ফেলে দিতে পারেন। কিন্তু দিচ্ছেন না। অতি যত্নে আপনি তা ভাঁজ করে দেরাজে তুলে রাখছেন।
আপনি জানেন, জিজেক কথিত আবেগের তীব্রতা এখানে নেই। নেই প্রবাদবাক্যের কথিত ছেঁড়া মানচিত্রের বাকি অর্ধেক খোঁজা। খুঁজে কিছু পাওয়াও যাবে না। কিংবা হুইটম্যানের মতো আপনি কখনো বলে উঠবেন না, ‘আমি তোমার জন্য সবকিছু বাজি ধরেছি।’
তরুণ রবীন্দ্রনাথের মতো আপনি সারাক্ষণই গুনগুন করেন, ‘যদি তোমার নদীকূলে/ভুলিয়া ঢেউ তুলে,/আমার তরীখানি বাহিব না।’
তবু প্রকাশহীন এসব ভালো লাগাও আপনাকে কোথাও পৌঁছে দেয়। এগুলো গন্তব্যহীন নয়। সম্পর্কের একমুখী বুনোটে এগুলো জরির সূক্ষ্ম কারুকাজ মাত্র, এগুলো না থাকলে জীবন বরং একরঙা পরিধেয় হয়ে থাকত।