মীনের সঙ্গে, মেঘের সঙ্গে

থাইল্যান্ডের কোরাল আইল্যান্ডে সি ওয়াকার। ছবি: লেখক
থাইল্যান্ডের কোরাল আইল্যান্ডে সি ওয়াকার। ছবি: লেখক

ওয়াকিং স্ট্রিট। রাত ১২টা। আমাদের ঘুমিয়ে পড়ার সময়। এ সময় জেগে ওঠে থাইল্যান্ডের এই বিখ্যাত ঠিকানা। ভিনদেশি মানুষের আড্ডা-হইচই মাতিয়ে রাখে পুরো এলাকা। রাতভর সেখানে বসে নানা আয়োজন।

ওয়াকিং স্ট্রিট নিয়ে আরও কথা হবে। এর আগে শুরু করা যাক থাইল্যান্ড ট্যুরের শুরুর গল্প। ১৩ জুলাইয়ের বিকেল চারটা। ব্যাংককের সুবর্ণভূমি এয়ারপোর্টে নামার পর আমি আর সহকর্মী নাইমুল আলম দুই ঘণ্টার মধ্যেই পৌঁছে গেলাম ১৭৫ কিলোমিটার দূরের পাতায়ায়। বাস থেকে নেমে টমটম করে চলে গেলাম হোটেল আটলান্টিস কনডো রিসোর্টে। ফ্রেশ হয়েই রাতের খাবারের জন্য দৌড়ঝাঁপ। থাইল্যান্ডে অবস্থানরত বন্ধু রকি ও তাঁর বন্ধু নিসা আকামতের সঙ্গে সেরে নিলাম খাবার। নিসা আকামত নামের মেয়েটি থাইল্যান্ডের। কখনো বাংলাদেশে আসা হয়নি তাঁর। তবে বাংলাদেশের মানুষদের প্রতি তাঁর অনেক ভালোবাসা। আমি তাঁর মোটরসাইকেলের পেছনে বসে রাতের খাবার সেরে পাতায়া বিচে নামলাম। সৈকতের পানিতে পা রেখে সবাই ডুবে গেলাম গল্পের জগতে। গল্প করতে করতে ঘড়ির কাঁটা পৌঁছাল একটার ঘরে। এবার দুই বন্ধুকে বিদায় দিয়ে আমি আর নাইমুল ঢুকে পড়লাম ওয়াকিং স্ট্রিটের বর্ণিল জগতে। এখানে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আসা মানুষ জড়ো হয় আনন্দ উপভোগ করতে। ঘণ্টাখানেক সেখানে এদিক-সেদিক ঘুরে আবার হোটেলে ফিরলাম। এই শহরটা যেন দিনে ঘুমায়, আর রাতে জেগে থাকে।

কোরাল আইল্যান্ড সৈকতে পর্যটকদের ভিড়। ছবি: লেখক
কোরাল আইল্যান্ড সৈকতে পর্যটকদের ভিড়। ছবি: লেখক

পরদিন ১৪ জুলাই। ২ হাজার ২০০ বাথের একটা প্যাকেজ নিলাম ‘কোরাল আইল্যান্ড’ যাওয়ার। আটটার মধ্যে সকালের নাশতা সেরে আমরা হোটেল থেকে বের হয়ে পড়লাম। টমটমে উঠে ১৫ মিনিটের মধ্যে পাতায়া সমুদ্রসৈকতে পৌঁছলাম। আমাদের জন্য স্পিডবোট প্রস্তুত ছিল। দলে ছিল ৩২ জন। দুটি স্পিডবোটে রওনা দিলাম। সমুদ্রসৈকত থেকে ১৫ কিলোমিটার দূরের পথ কোরাল আইল্যান্ড। ২০ মিনিটের মধ্যে আমরা পৌঁছলাম প্যারাসেইলিং স্পটে। আমার যখন ডাক পড়ল, এখানকার কর্মীরা আমাকে দ্রুত বেল্ট পরিয়ে দিলেন, কেউবা লাইফ জ্যাকেট।

প্যারাস্যুটে ধীরে ধীরে আকাশের পথে রওনা দিলাম। খুব ভয় হচ্ছিল আমার। শরীরও ঘামছিল। তবে কিছু দূর উঠতেই ভয় কিছুটা কমে গেল। আকাশে টুকরো টুকরো মেঘ। নিবিড় শ্যামলিমা। চোখজুড়ানো নিসর্গ। পাহাড় ছুঁয়ে মেঘমালার উড়ে চলা। পাখির মতো উড়ে বেড়ানোর অনুভূতি সত্যি অন্য রকম। সে এক অপূর্ব দৃশ্য। এবার মাটি ছোঁয়ার পালা। নেমেই বিশ্রাম নিলাম কিছুক্ষণ। খোঁজ নিয়ে দেখি, আমার সঙ্গে থাকা অনেকেই সাহস পাননি প্যারাসেইলিং ভ্রমণের।

কোরাল আইল্যান্ড সৈকতে পর্যটকদের পদচারণ। ছবি: লেখক
কোরাল আইল্যান্ড সৈকতে পর্যটকদের পদচারণ। ছবি: লেখক

দেখতে দেখতে ডাক পড়ল নৌকার মাঝির (বোটচালক)। উঠে পড়লাম নৌকায়। কিছু দূর গিয়ে নৌকা থামল ছোটখাটো দোতলা এক লঞ্চের পাশে। এখান থেকে করা যায় সি ওয়াক। সাগরতলের জগৎ দেখতে প্রায় পাঁচ মিটার নিচে আমরা সাতজন একসঙ্গে নেমে পড়লাম। একজন ডুবুরি এসে আমাদের এক এক করে ছবি তুলতে লাগলেন। আরেকজন এসে আমাদের হাতে মাছের খাবার দিলেন। ইশারায় আমাদের দেখিয়ে দিলেন খাবারগুলো ছিটানোর জন্য। খাবার দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে একঝাঁক মাছ আমাদের ঘিরে ধরল। আমরা মাছগুলো স্পর্শ করার চেষ্টা করলাম। দুজন ডুবুরি আমাদের হাত ধরে আরেক জায়গায় নিয়ে গেলেন। পানির গভীরে স্বচ্ছ পানি, সাদা বালু, রঙিন মাছ ও প্রবাল দেখলাম। প্রায় ২০ মিনিট মাছের জগতে কাটল সময়। সে এক অন্য রকম রোমাঞ্চ।

পাতায়া সৈকতে খাবার বিক্রি করছেন এক নারী। ছবি: লেখক
পাতায়া সৈকতে খাবার বিক্রি করছেন এক নারী। ছবি: লেখক

এরপর মূল গন্তব্য কোরাল আইল্যান্ডের দিকে রওনা দিলাম। অদ্ভুত সুন্দর পরিবেশ। নির্জন এলোমেলো বাতাস, স্বচ্ছ নীল পানি পর্যটকদের যেন হাতছানি দিয়ে ডাকছে। স্বাতন্ত্র্যের কারণে বিখ্যাত কোরাল আইল্যান্ড দ্বীপে প্রতিবছরেই হাজারো পর্যটক বেড়াতে আসেন। জীববৈচিত্র্যে ভরা এই দ্বীপে প্রকৃতি যেন সৌন্দর্যের পসরা খুলে বসে আছে।

কোরাল আইল্যান্ড সমুদ্রসৈকতে পর্যটকদের ব্যানানা রাইডিং। ছবি: লেখক
কোরাল আইল্যান্ড সমুদ্রসৈকতে পর্যটকদের ব্যানানা রাইডিং। ছবি: লেখক

কোরাল আইল্যান্ডে নেমে তার নৈসর্গিক সৌন্দর্য দেখে পর্যটকেরা আত্মহারা হয়ে ওঠেন। অনেকে নেমেই দৌড় শুরু করেন। বড় ঢেউগুলো সৈকতের পাড়ে আছড়ে পড়ছিল। এ এক অপরূপ দৃশ্য! নীল আকাশ, নীল জলের সঙ্গে গাঢ় সবুজ গাছ, প্রকৃতির সৌন্দর্য—সবকিছু উজাড় করে দিয়েছে দ্বীপটিকে। ক্লান্তিহীনভাবে আমরাও সি বিচের এক প্রান্ত থেকে অপর প্রান্ত হেঁটে বেড়াচ্ছি। দেখছি চোখ ভরে। পর্যটকেরা নিশ্চিন্ত মনে ঘুরছেন, আনন্দ করছেন।

কোরাল আইল্যান্ড সমুদ্রে স্নোরকেলিং রাইডিং করছেন পর্যটকেরা। ছবি: লেখক
কোরাল আইল্যান্ড সমুদ্রে স্নোরকেলিং রাইডিং করছেন পর্যটকেরা। ছবি: লেখক

তারপর দুপুরের খাওয়ার জন্য গেলাম ভারতীয় রেস্তোরাঁয়। চার রকম তরকারি দিয়ে আমাদের খাওয়ানো হলো। খাওয়ার পর আমাদের নেওয়া হলো স্নোরক্লিং রাইড করতে। সেখানে আমাদের পরিয়ে দেওয়া হলো লাইফ জ্যাকেট আর সাঁতার চশমা। আমরা সবাই আবার সাগরে নেমে পড়লাম বিভিন্ন রঙের মাছ ও প্রবাল দেখতে। এ সময় কেউ কেউ ভুলে পান করে ফেলে সমুদ্রের লোনা পানি। আবার কেউ ভাসতে থাকে। এভাবে আমরা ১৫ থেকে ২০ মিনিট প্রবাল আর মাছ দেখলাম।

কোরাল আইল্যান্ডে স্নোরকেলিং রাইডিং করছেন পর্যটকেরা। ছবি: লেখক
কোরাল আইল্যান্ডে স্নোরকেলিং রাইডিং করছেন পর্যটকেরা। ছবি: লেখক

এবার চলে এলাম পাতায়ায়। আমাদের সবার হাতে একটি করে সিডি দেওয়া হলো। সিডিতে সারা দিন যা যা করলাম, তার ছবি ও ভিডিও রয়েছে।

১৬ জুলাই ফিরলাম ব্যাংককে। ব্যাংককের মাদামতুসো জাদুঘরে আরেক অনুভূতি। জাদুঘরে ঢুকেই দেখা হয়ে গেল মহাত্মা গান্ধী থেকে পুতিন, ওবামা। শাহরুখ খান থেকে ক্রিস্টিয়ানো রোনালদো। তবে কেউ-ই আসল নন, তাঁদের সৃষ্টি মোমে।

পাতায়ায় প্যারাসেইলিং করছেন পর্যটকেরা। ছবি: লেখক
পাতায়ায় প্যারাসেইলিং করছেন পর্যটকেরা। ছবি: লেখক

ব্যাংককে দুদিন কাটিয়ে এবার দেশে ফেরার পালা। ১৭ জুলাইয়ের বেলা আড়াইটা। আমরা ধরলাম দেশে ফেরার বিমান।

পাঁচ দিনের থাইল্যান্ড ভ্রমণের টুকরো টুকরো রঙিন স্মৃতি মনের মধ্যে ছবি হয়ে থাকবে সারা জীবন। ভিডিও ফিল্ম আকারে বেজে যাবে আজীবন।