মন লুটেছে লটকন

যত দূর চোখ যায় লটকনের গাছ! ছবি: জুনায়েদ আজীম চৌধুরী
যত দূর চোখ যায় লটকনের গাছ! ছবি: জুনায়েদ আজীম চৌধুরী

বিশ্বকাপ ফুটবলের উত্তাপের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছিল জ্যৈষ্ঠের গরম। সে গরমে সাক্ষাৎ ঘি ঢেলে দিল ব্রাজিল-আর্জেন্টিনার বিদায়। মুখ পাংশু করে মাঝরাতে এদিক-ওদিক ঘুরছি আমরা। এরর মধ্যেই নরসিংদী থেকে ফোন দিল বন্ধু শাহেদ, ‘মামা, খেলা তো শেষ! ঢাকায় থাইকা আর কী করবি, এদিকে চলে আয়।’ মানুষ মনের দুঃখে বনে যায়, আমরা গেলাম নরসিংদী। উদ্দেশ্য একটাই, এখানে বিশাল এলাকাজুড়ে লটকনের বাগান। সেখানে থোকায় থোকায় ধরেছে লটকন। সব পেকে পেকে আমাদের অপেক্ষায় ঝুলে আছে! আমরা গেলেই টুপ টুপ করে ঝরে পড়বে!

সাতসকালে মাইক্রো হাজির, সে মাইক্রোতে গাদাগাদি করে আমরা ১১ জন ছুট লাগালাম বন্দী শহরের পালানোর পথের দিকে। পূর্বাচলের রাস্তা ধরে নরসিংদী যেতে যেতেই বেলা ১১টা। সোজা ভৈরবের রাস্তা ধরে যেতে যেতেই শাহেদ জানাল আমরা বাঁ দিকে শিবপুরের রাস্তায় ঢুকলাম। হতাশ সবাই—রাস্তাজুড়ে কাঁঠালগাছের সারি! সময়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে চাকা গড়াল, পথ ফুরাল, তবুও লটকনের দেখা নেই। চোখে উদ্বেগ নিয়ে একবার শাহেদের দিকে তাকাই, একবার মুক্তি ভাবির দিকে তাকাই—এলাকার মানুষ কি তবে ভুল জায়গায় নিয়ে এল! লটকন তো দূরের কথা, লটকনের মতো কিছুই তো নাই আশপাশে, যেদিকে তাকাই শুধু কাঁঠাল আর কাঁঠাল! অধৈর্য হয়ে কবির মুখ খুলতে গেল, তার আগেই গাড়ি মোড় নিল ডান দিকে—এটা জয়নগরের রাস্তা, সোজা বেরিয়েছে মরজাল বাজার হয়ে। বাঁক ঘুরতে না-ঘুরতেই ঝুম করে বর্ষা ভাবির চিৎকার! ড্রাইভার নগদে ব্রেক করল গাড়ি! সঙ্গে সঙ্গে বর্ষা ভাবি দরজা খুলে ভৌ-দৌড়! তাঁর দৌড়ে যাওয়া রাস্তার দিকে তাকিয়েই বুঝলাম কেন এই বিনা মেঘে বজ্রের মতো আওয়াজ!



যত দূর চোখ যায় রাস্তার দুপাশে লটকনের গাছ! থোকায় থোকায় ধারণাটা ভুল, গাছের গায়ে এক ইঞ্চি জায়গাও বাদ রাখেনি লটকনের দল, ছোট-বড় মিলিয়ে পেকে হলুদ হয়ে আছে পুরো গাছ! আর যায় কোথায়, যে যেভাবে পারল নেমে দৌড়, পেছনে থাকায় আটকা পড়লাম আমি আর আদনান। আস্তে-ধীরে নামতে নামতেই সামনের গাছতলায় অর্ধেক লটকন শেষ! সবাই মুখে পুরে চোখ বন্ধ করে আরামসে ঘুরছে। আমি দেখেশুনে সবচেয়ে বড় একটা লটকন নিয়ে নওরিনকে দিলাম, জ্যৈষ্ঠ মাসে বউকে উপহার দেওয়া প্রথম ফল। একেবারে তরতাজা।

আরও সামনে যেতে হবে, একটা পরিপূর্ণ বাগানে ঢুকতে হবে। যেমন কথা তেমন কাজ, লটকনের গাছগুলো রাস্তার পাশে এমনভাবে ঝুলে আছে, জানালা দিয়ে হাত বাড়িয়েই ধরা যায়। এক বাগানে নামলাম—ভেতরে গিয়ে আক্ষরিক অর্থেই হারিয়ে গেলাম লটকনের রাজ্যে। একজন আরেকজনকে ডেকে খুঁজে পাওয়া যায় না এমন বিশাল সে বাগান। সবাই ছবি তুলতে ব্যস্ত আর অন্যদিকে জুনায়েদ ব্যস্ত ওপর থেকে লটকন পাড়তে। দূর থেকে এক নারীর চিৎকার—এই কে ঝুলে গাছে! কাউকে বলে দিতে হয়নি, নিজেই এসে দেখে ফেললেন কে ঝুলতেছে! এই দৃশ্য দেখে সেই ভদ্রমহিলা তো হাসতে হাসতেই খুন!

পরের গল্পটা পরিপূর্ণ আতিথেয়তার, একেবারে গ্রাম্য ভালোবাসার। জানা গেল তিনি এই বাগানের মালিক। প্রতিবছর বিপুল পরিমাণ লটকন হয় এখানে। ফেরার পথে গাড়িতে তুলে দিলেন কিছু লটকন। আরাম করে এসির ভেতরে বসে লটকন খেতে খেতেই আরেকটা বাগান দেখে দাঁড়ালাম—এই বাগানের লটকনগুলো বেশ বড়! চোখ ছানাবড়া করে নেমে হাত বুলালাম লটকনের গায়ে—একটু পরেই দেখি বাগানের মালিক দাঁড়িয়ে আছেন, আমাদের সবাইকে মেহমান বানিয়ে হাত, ব্যাগ—সব ভর্তি করে উপহার দিলেন টসটসে লটকন।

ভালোবাসার হাত থেকে নিজেদের বাঁচিয়ে বাগান থেকে বের হওয়ার পথেই নজরে এল লটকন ব্যবসায়ীদের। ১০ কেজি করে একেকটা ঝুড়ি বানিয়ে তাঁরা ঢাকায় পাঠানোর জন্য প্যাকেট করছেন মিষ্টি লটকনগুলো। একেকটা ঝুড়ির দাম ৭০০ থেকে ৯০০ টাকা পর্যন্ত!

কীভাবে যাবেন
ঢাকার গুলিস্তান থেকে নরসিংদীর বাসে উঠে পাঁচদোনা মোড়ে নেমে যাবেন। সেখান থেকে একটা সিএনজিচালিত অটোরিকশা ভাড়া করে চলে যান শিবপুরের জয়নগর এলাকার লটকন বাগানে। গাছ থেকে লটকন ছেঁড়ার কোনো প্রয়োজন নেই, আশপাশে বাগানমালিক থাকলে উনি নিজ হাতেই অসংখ্য লটকন পেড়ে দেবেন। এই মাস পুরোটা থাকবে লটকন, এরপর আর পাওয়া যাবে না।