তুমি আর নেই সে তুমি...

>‘তুমি আর নেই সে তুমি’ কিংবদন্তি শিল্পী শচীন দেববর্মনের সৃষ্ট খুব জনপ্রিয় একটি গানের কলি। হালের হলিউডের সঙ্গে এর বেশ মিল আছে। গত ১০ বছরে হলিউডের হালচাল এতটাই বদলে গেছে যে বলতেই হচ্ছে—‘তুমি আর নেই সে তুমি...’। এই পরিবর্তন কতটা ভালো বা খারাপ, সেই মূল্যায়ন এখনই করা হয়তো সম্ভব হবে না। কিন্তু পরিবর্তিত বিষয়গুলো সাদাচোখেই ধরা পড়ে বেশ। লিখেছেন অর্ণব সান্যাল
টার্মিনেটর ছবিতে পুরোনো আরনল্ড
টার্মিনেটর ছবিতে পুরোনো আরনল্ড

কম্পিউটার বনাম মানুষ

কম্পিউটারে সৃষ্ট গ্রাফিকসের ব্যবহার হলিউডের সিনেমায় নতুন নয়। কিন্তু এর ব্যবহারের মাত্রায় নতুনত্ব এনেছে চলতি দশক। দ্য আইরিশম্যান ছবিতে রবার্ট ডি নিরোকে বার্ধক্য থেকে ফের তারুণ্যে পৌঁছে দিচ্ছে কম্পিউটার। ‘লোগান’ চরিত্রের হিউ জ্যাকম্যানও পেয়েছিলেন তারুণ্যের ছোঁয়া। ক্যাপ্টেন মার্ভেল-এ মিলছে তরুণ স্যামুয়েল এল জ্যাকসনকে। কম যান না আরনল্ড শোয়ার্জেনেগারও। সত্তরোর্ধ্ব এই অভিনেতা দর্শকদের সামনে হাজির হচ্ছেন ৩৫ বছর আগের সুষমায়। গত এক দশকে প্রযুক্তির অভিনব উন্নতিতে এই অসাধ্য সাধন সম্ভব হয়েছে। আশঙ্কা হলো, কবে জানি শিল্পীদের বাদ দিয়ে শুধু কম্পিউটারেই সিনেমা বানানো শুরু হয়ে যায়!

সিনেমা হলের জায়গায় স্ট্রিমিং

বিনোদনজগতের সময়কাল এখন দুই ভাগে ভাগ হয়ে গেছে। একটি হচ্ছে এই ধরাধামে নেটফ্লিক্স আসার আগে, আরেকটি পরে। ২০১০ সালের আগে নেটফ্লিক্স চালু হয়নি। গত দশকজুড়ে ছবি দেখার মাধ্যমটাই বদলে দিয়েছে নেটফ্লিক্স। হলিউডে হলে গিয়ে সিনেমা দেখার সংস্কৃতিই এখন হুমকিতে পড়েছে। নেটফ্লিক্সের অস্কার জয়ের পর অনলাইন ভিডিও স্ট্রিমিংয়ের গ্রহণযোগ্যতা আরও বেড়ে গেছে। নেটফ্লিক্সের প্রতিযোগী হতে বাজারে নেমেছে আমাজন, ডিজনি, অ্যাপল, এইচবিওসহ বিভিন্ন মহারথী। সারা বিশ্বে স্ট্রিমিং–সেবার গ্রাহক ৭০ কোটির বেশি। এখন বছরে ১০ হাজার কোটি (১০০ বিলিয়ন) ডলারের বেশি নগদ অর্থ বিনিয়োগ করা হচ্ছে স্ট্রিমিং ব্যবসায়। এই ভিডিও স্ট্রিমিংকে কেন্দ্র করে গত পাঁচ বছরে কনটেন্ট নির্মাণ ও বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের নানামাত্রিক অধিগ্রহণে খরচ হয়েছে কমপক্ষে ৬৫ হাজার কোটি ডলার। অবশ্য বিরোধীপক্ষও কম শক্তিশালী নয়। কিছুদিন আগ পর্যন্ত অস্কারে অস্পৃশ্য ছিল স্ট্রিমিং প্ল্যাটফর্মে মুক্তি পাওয়া চলচ্চিত্র। অস্কার কর্তৃপক্ষ পরে মেনে নিলেও কান আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসব কর্তৃপক্ষ এখনো পাত্তা দিচ্ছে না।

সুপারহিরো ছবি অ্যাভেঞ্জার্স: এন্ডগেম-এর পোস্টার
সুপারহিরো ছবি অ্যাভেঞ্জার্স: এন্ডগেম-এর পোস্টার

সুপারহিরোরাই সব

গত ১০ বছরে হলিউড তথা বিশ্বের নানা প্রান্তের বিভিন্ন সিনেমা হলে রাজত্ব করেছে সুপারহিরোরা। গেল শতাব্দীতে কমিকস বেশ সাড়া জাগিয়েছিল সব বয়সী মানুষের মধ্যে। কমিকসের সেই হিরোরা এবার দেখা দিয়েছে বড় পর্দায়। এক্স-মেন, সুপারম্যান, স্পাইার-ম্যান, ব্যাটম্যান, আয়রনম্যান, ওয়ান্ডার ওম্যান—কমিক–জগতের কোনো অতিমানবই রুপালি পর্দায় হাজির হতে বাকি রাখেননি। এসেছে খলনায়ক ‘জোকার’ও। মার্ভেল থেকে সনি—সব প্রযোজনা প্রতিষ্ঠানই সুপারহিরোদের পেছনে প্রবল উৎসাহে কাঁড়ি কাঁড়ি অর্থ বিনিয়োগ করেছে। তবে সবচেয়ে বেশি ব্যবসা করেছে কিংবদন্তি স্ট্যান লির সৃষ্ট সুপারহিরো ও হিরোইনরা। চলতি বছর অ্যাভেঞ্জার্স: এন্ডগেম ২৮০ কোটি ডলারেরও বেশি আয় করেছে। মার্ভেল স্টুডিওর এই ছবি সর্বকালের সবচেয়ে বেশি আয় করা চলচ্চিত্রে পরিণত হয়েছে। এ থেকেই বোঝা যায়, এই পৃথিবীর বিনোদনজগতে সুপারহিরোরা কতটা দোর্দণ্ড প্রতাপশালী।

ডিজনি–যুগ শুরু

চলচ্চিত্র ঐতিহাসিকেরা একদিন ২০১০-এর দশককে ‘ডিজনির দশক’ বলে অভিহিত করবেন। গত ১০টি বছরে সম্পূর্ণ নতুন চেহারায় আবির্ভূত হয়েছে ডিজনি। একদিকে নিজেদের ক্ল্যাসিক কার্টুন চরিত্রগুলোকে বড় পর্দায় তুলে ধরেছে ডিজনি (যেমন: মেলেফিসেন্ট, আলাদিন, ডামবো, দ্য জাঙ্গল বুক)। অন্যদিকে স্টার ওয়ারস ও মার্ভেল ফ্র্যাঞ্চাইজির মারদাঙ্গা অ্যাকশনের ছবিগুলোর ওপরও ডিজনি অধিকার প্রতিষ্ঠা করেছে। হিসাবে দেখা গেছে, গত ১০ বছরের মধ্যে ৮টি বছরের সর্বোচ্চ আয় করা চলচ্চিত্র ছিল ডিজনির। স্ট্রিমিং ব্যবসায় নেমেও কিস্তিমাত করেছে ‘ডিজনি প্লাস’। এক দিনেই এক কোটি গ্রাহক পেয়েছে ডিজনির স্ট্রিমিং সাইট। আবার হলিউডের অন্যতম নামী প্রযোজনা প্রতিষ্ঠান টুয়েন্টিথ সেঞ্চুরি ফক্স অধিগ্রহণও সেরে ফেলেছে ডিজনি।

ওয়ান্ডার ওম্যান ছবির নির্মাতা পেটি জেনকিনস ও অভিনেত্রী গ্যাল গাদত
ওয়ান্ডার ওম্যান ছবির নির্মাতা পেটি জেনকিনস ও অভিনেত্রী গ্যাল গাদত

নারীই ভবিষ্যৎ

বর্ণবাদের পাশাপাশি গত ১০ বছরে হলিউডে ‘হ্যাশট্যাগ মিটু’ ও ‘টাইমস আপ’ আন্দোলনও হয়েছে। অভিনেত্রী ও নারী চলচ্চিত্রকর্মীরা নিপীড়নের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়েছেন। যৌন হেনস্তা করে প্রভাবশালী প্রযোজক হার্ভি ওয়েইনস্টেইনকে কারাগারেও যেতে হয়েছে। এটি নিঃসন্দেহে নারীশিল্পীদের বিশাল বিজয়। শুধু যৌন হেনস্তাই নয়, হলিউডে মজুরিবৈষম্য ও প্রাতিষ্ঠানিকভাবে পুরুষদের বেশি প্রাধান্য দেওয়ার বিরুদ্ধেও এই দশকে সোচ্চার হয়েছেন নারীরা। এই সবকিছুর ফল হিসেবে অ্যাকশননির্ভর চলচ্চিত্রের প্রধান চরিত্রের নারীদের দেখা মিলছে। লুসি, স্টার ওয়ারস: দ্য ফোর্স অ্যাওয়াকেনস, দ্য হাঙ্গার গেমস—এসব ছবিতে অভিনেত্রীরাই ছিলেন প্রধান চরিত্রে। ওয়ান্ডার ওম্যান দিয়ে সুপারহিরোদের জগতেও পা রেখেছেন নারীরা। শুধু কেন্দ্রীয় চরিত্রে নারীশিল্পী নয়, পরিচালকের আসনেও বসেছেন নারী নির্মাতা। প্যাটি জেনকিনস পরিচালিত গ্যাল গাদতের ছবির আকাশচুম্বী সাফল্য দেখিয়ে দিয়েছে, নারীরাই হলিউডের ভবিষ্যৎ।

হলিউডে চলে আসা বর্ণবাদকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে ইতিহাস গড়েছে ব্ল্যাক প্যান্থার
হলিউডে চলে আসা বর্ণবাদকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে ইতিহাস গড়েছে ব্ল্যাক প্যান্থার

বর্ণবাদে প্রতিবাদ

সাধারণত হলিউডে প্রতিবাদ-বিক্ষোভ খুব একটা চোখে পড়ে না। অন্তত ইন্ডাস্ট্রিজুড়ে তো নয়ই। কিন্তু বর্ণবাদের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ এ ক্ষেত্রে ভিন্নমাত্রা দিয়েছে। এই প্রতিবাদ পৌঁছে গিয়েছিল অস্কারের মঞ্চেও, অশ্বেতাঙ্গ শিল্পীরা নিজেদের অধিকার আদায়ে সোচ্চার হয়েছিলেন। এর ফলও আশাপ্রদ। এখন হলিউডে কৃষ্ণাঙ্গ সুপারহিরোকে নিয়েও ছবি তৈরি হচ্ছে। ব্ল্যাক প্যান্থার ও স্পাইডার-ম্যান: ইনটু দ্য স্পাইডার ভার্স এরউজ্জ্বল উদাহরণ। বিষয় হিসেবে বর্ণবাদ নিয়েও সরাসরি চলচ্চিত্র তৈরি হচ্ছে।

কনজুরিং ছবির দৃশ্য
কনজুরিং ছবির দৃশ্য

ভূতের রাজা দিল বর

এই শতাব্দীর শুরুর বছরগুলোতে ভূত খুব একটা সুবিধা করতে পারেনি। ভৌতিক ছবিগুলো প্রায়ই বক্স অফিসে মুখ থুবড়ে পড়েছিল। কিন্তু ২০১০-এর দশকে তার ব্যতিক্রম ঘটেছে। এই ১০ বছরে হলিউডে ভৌতিক ঘরানার ছবির পুনরুত্থান ঘটেছে বললেও অত্যুক্তি হবে না। দ্য কনজুরিং সিনিস্টার এতই জনপ্রিয় হয়েছে যে এগুলোর সিকুয়েলও মুক্তি পেয়েছে। ইটহ্যালোউইন-এর মতো পুরোনো সিরিজের ছবিগুলোর নতুন পর্বও ভালো ব্যবসা করেছে। সব মিলিয়ে এই ১০ বছরে ‘ভূতেদের’ আয়রোজগার মন্দ নয়।

দুনিয়ার দিন শেষ?

২০১০-এর দশকে হলিউডের অনেকগুলো ছবিতে দুনিয়ার শেষ দেখে ফেলা হয়েছে। ম্যাড ম্যাক্স: ফিউরি রোড, আফটার আর্থ, অবলিভিওন, এলিসিয়াম, ইন্টারস্টেলার, প্যাসেঞ্জারস, এলিয়েন: কভেন্যান্ট—ছবিতে বর্তমান পৃথিবীকে পরিত্যক্ত ঘোষণা করা হয়েছে। দেখানো হয়েছে মানবকুলের ধ্বংসাত্মক পরিণতি। কিছু চলচ্চিত্রে আবার অন্য সৌরজগতের নতুন কোনো গ্রহে উপনিবেশ স্থাপনের স্বপ্নও দেখানো হয়েছে। বিশ্বকে নিয়ে এমন ভাবনা অবশ্য নতুন নয়। তবে গত ১০ বছরে এর প্রাবল্য দেখা গেছে।

তথ্যসূত্র: দ্য ইকোনমিস্ট, বিবিসি, সিএনবিসি, ভালচার ও আইএমডিবি