পিনাকলসের ধূসর জগতে

চুনাপাথরের এই খুুদে স্তম্ভগুলোই আলাদা করে চেনায় পিনাকলস।  ছবি: লেখক
চুনাপাথরের এই খুুদে স্তম্ভগুলোই আলাদা করে চেনায় পিনাকলস। ছবি: লেখক

অস্ট্রেলিয়ার পার্থের রকিংহাম থেকে পিনাকলসের দূরত্ব ২৪৬ কিলোমিটার। মানচিত্রে দেখলাম, ভারত মহাসাগরকে পাশে রেখে রাস্তা চলে গেছে উত্তরের পথে। সময় করে মরুভূমি দেখতে যাব, পরিকল্পনাটি অস্ট্রেলিয়ায় বেড়াতে যাওয়ার আগেই। আমার পরিকল্পনার কথা জেনে ছোট ভাই শাহেদ বলল, পিনাকলস মরুভূমির গল্প।

বেলা বাড়ার আগেই, মার্চের এক সকালে গাড়ির স্টিয়ারিং ধরলাম। মসৃণ মহাসড়কের দুই পাশে লোকালয়হীন প্রকৃতি। মাঝেমধ্যে কিছু কৃষি খামার চোখে পড়ল। কখনো কখনো বিভিন্ন প্রজাতির ইউক্যালিপটাস গাছের সারি। ছবির মতো এত সুন্দর মহাসড়ক সব সময় মেলে না। গাড়ি চালানোর সময় অন্যরা গতিসীমা মেনে চলার কথাটি শুধু মনে করিয়ে দিচ্ছিল।

সি-বার্ডে বিস্ময়

কফি পানের অবসর খুঁজছিলাম। টানা দেড় ঘণ্টা পথ চলার পর সে সুযোগ হলো। ‘সি–বার্ড’ নামের রেস্তোরাঁ ও ক্যাফের পার্কিংয়ে গাড়ি রাখতে গিয়ে দেখি, পুরো জায়গাটা ফাঁকা। আমরা চারজন মিলে রেস্তোরাঁয় ঢুকে তো একেবারে থ! কেউ নেই। অনেকটা ভুতুড়ে পরিবেশ। ঝুলিয়ে রাখা ঘণ্টা বাজানোর পর এক বৃদ্ধা ভেতর থেকে বেরিয়ে এসে হাসিমুখে স্বাগত জানালেন। আমরা কফির ফরমাশ দিলাম। দেখি, একটি কাচের জারে কিছু বিস্কুট রাখা। মোড়কের গায়ে লাগানো ‘হোম মেইড’। ঘরে তৈরি বিস্কুট না খেয়ে পারা যায়! বিস্কুট নিয়ে রেস্তোরাঁর পেছনের দিকে যেতেই সবার চোখ ছানাবড়া হওয়ার জোগাড়। ছবির মতো নীল রঙের বিশাল জলরাশি আর হৃদয় ছুঁয়ে যাওয়া নোনা বাতাস।  বুঝতে বাকি রইল না রেস্তোরাঁর নাম কেন সি-বার্ড। খোলা আকাশের নিচে নীল সমুদ্রকে পাশে রেখে কফি পান করতে করতে মনে হলো, এখানেই তো সারা দিন কাটিয়ে দেওয়া যায়। কিন্তু আমাদের লক্ষ্য তো পিনাকলস মরুভূমি। দেরি না করে তাই ফের বেরিয়ে পড়া।

সাগরপাড়ের এই রেস্তোঁরার নামই ‘সি–বার্ড’
সাগরপাড়ের এই রেস্তোঁরার নামই ‘সি–বার্ড’

যেন কল্পজগতে পরিভ্রমণ

নীল জলরাশির বিস্ময় কাটতে কাটতে প্রায় সোয়া ঘণ্টা চলে গেল। নজরে পড়ল নামবাং ন্যাশনাল পার্কের সাইনবোর্ড। এই পার্কের মধ্যেই পিনাকলস মরুভূমি। ১৫ মিনিটের মতো চলার পর ডান দিকে মোড় নিয়ে মহাসড়ক ছেড়ে এগোতে থাকলাম। পার্কের দুই ধারে ক্যাকটাস আর ঝোপজাতীয় গাছে ভরা। বড় কোনো গাছ নেই। নিজেরা আলোচনা করছিলাম—এ কেমন পার্ক, যেখানে বড় গাছ নেই!

আরও কিছু দূর এগিয়ে যেতেই পিনাকলসের মূল ফটকের দেখা মিলল। টিকিট কাউন্টারের ভদ্রলোক বললেন, গাড়ি নিয়ে প্রবেশে কোনো বাধা নেই। তবে গাড়ির জন্য নির্ধারিত রাস্তার বাইরে যাওয়া যাবে না। টিকেট কেটে গাড়িসহই ঢুকে পড়লাম। একটা বাঁক পেরুতেই চোখে পড়ল হলুদ বালুর ওপর দাঁড়িয়ে থাকা হাজার হাজার চুনাপাথরের স্তম্ভ। নিজেদের আচমকা যেন চুনাপাথর স্তম্ভের দুনিয়ায় আবিষ্কার করলাম। স্তম্ভগুলোর মাথা পাহাড়ের চূড়ার মতো। এ জন্যই বোধ হয় এর নাম দেওয়া হয়েছে পিনাকলস। কোনোটা খুবই ছোট, আবার কোনোটা ১৩-১৪ ফুট পর্যন্ত উঁচু।

আমাদের সবার চোখে বিস্ময়। গাড়ি থেকে বেরিয়ে মনে হলো এ এক অন্য দুনিয়া। কোনো এক কল্পনার পরাবাস্তব জগৎ। আমরা সেখানে প্রবেশ করেছি। চুনাপাথরগুলোর আকার যেমন ভিন্ন, তেমনি রঙও। কোনোটি ধূসর, কোনোটি হলুদাভ আর অন্যগুলো অস্বাভাবিক রকম সাদা। হলুদ,
ধূসর আর চুনাপাথরের সাদা রঙের বিভিন্ন মিশ্রণ দেখে একবার মনে হলো, কোনো চিত্রকরের তুলির টানে আঁকা ক্যানভাস। হাঁটতে থাকলাম সেই অপার্থিব জগতে। দূর থেকে যখন বড় আকারের স্তম্ভগুলো দেখছিলাম, তখন মনে হচ্ছিল, কোনোটা রবীন্দ্রনাথের প্রতিকৃতি, কোনোটা সক্রেটিসের
আর কোনোটা–বা যিশুর। আরও কিছুদূর এগোনোর পর দেখলাম, ভাঙা পাথরের মতো ছোট ছোট চুনাপাথরের শক্ত খণ্ড ছড়িয়ে আছে চারদিকে। এবার মনে হলো যেন আমরা কোনো বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনির প্লটের মধ্যে এসে পড়েছি। পাশেই পেলাম তিন তলার মতো উঁচু ওয়াচ টাওয়ার। সেখানে উঠে সাড়ে ১৭ হাজার হেক্টর এলাকাজুড়ে থাকা পিনাকলস মরুভূমির প্রায় সবটাই দেখা যায়। ভাবা যায়, এই হাজার হাজার চুনাপাথরের চূড়াগুলো ৩০ হাজার বছর ধরে এভাবে দাঁড়িয়ে আছে প্রকৃতির অপার বিস্ময় হিসেবে! ৩০ হাজার বছরের আলো-বাতাস-রোদ-বৃষ্টি আর জলবায়ু পরিবর্তন—সব অগ্রাহ্য করে টিকে আছে ছোট–বড় এ চূড়াগুলো।

সেদিন পিনাকলস মরুভূমি থেকে অদ্ভুত ভালো লাগা নিয়ে আমরা ফিরেছিলাম। নিজের অজান্তেই মনে মনে আওড়েছিলাম জীবনানন্দ দাশ—‘হাজার বছর ধরে আমি পথ হাঁটিতেছি পৃথিবীর পথে...’। মনে হলো, কত বৈচিত্র্যময়ই না আমাদের এই পৃথিবী। আর অপার বিস্ময়ে ভরা বিপুলা এই পৃথিবীর কতটুকু–বা জানি?

এই পথই পৌঁছেছে পিনাকলসের দরজায়
এই পথই পৌঁছেছে পিনাকলসের দরজায়

পিনাকলস-­বৃত্তান্ত

পিনাকলস কীভাবে গঠিত হয়েছে কিংবা টিকে আছে, তার বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা রয়েছে। ধারণা করা হয়, এই মরুভূমির বয়স কয়েক মিলিয়ন বছর। এলাকাটিতে আছে চুনাপাথরসমৃদ্ধ বালু। তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে ভারত মহাসাগরের ঢেউ আর বাতাসের তোড়ে আসা অতি প্রাচীন শামুকের গুঁড়া। আজ থেকে ৩০ হাজার বছর আগে নানা প্রাকৃতিক প্রক্রিয়ায় গঠিত হয়েছে স্তম্ভগুলো। আর যখনই বৃষ্টির পানি পড়েছে, চুনাপাথর আর পানি মিলে তৈরি হয়েছে ক্যালসিয়াম কার্বনেট। সেই ক্যালসিয়াম কার্বনেট স্তম্ভের গা বেয়ে নেমে গেছে গোড়ায়। ধীরে ধীরে তা জমে হয়েছে প্লাস্টারের মতো শক্ত আর স্তম্ভগুলোকে দিয়েছে টিকে থাকার শক্তি। বিস্তৃত হয়েছে মাটির নিচ পর্যন্ত। বুশ ফায়ার, ভূমিক্ষয় আর বাতাসের কারণে এখানকার নরম বালু সরে গেছে। চুনাপাথর আর কোয়ার্টজ বালু মিলে তৈরি হয়েছে নতুন ধরনের পরিবেশ। হাজার হাজার বছর ধরে চলা নানা প্রাকৃতিক পরিবর্তনে সমৃদ্ধ হয়েছে আজকের এই পিনাকলস।

অবাক করা ব্যাপার হলো, পিনাকলস মরুভূমিতে ছয় হাজার বছর আগে অস্ট্রেলীয় ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর মানুষদের বিচরণের প্রমাণ রয়েছে। এ এলাকায় পাওয়া বিভিন্ন ‘আর্টিফ্যাক্টস’ বিশ্লেষণ করে প্রত্নতত্ত্ববিদেরা এটি নিশ্চিত করেছে। ইউরোপীয়রা ১৬৫৮ সালের দিকে প্রথম এই এলাকায় এসেছিল। ডাচদের তৈরি করা মানচিত্রে এ এলাকার উল্লেখ দেখা যায়। ১৮২০ সালে ফিলিপ পার্কার কিং নামের এক পরিব্রাজক পিনাকলস মরুভূমির কথা তাঁর লেখায় উল্লেখ করেন। তবে সাধারণ অস্ট্রেলীয়দের নজরে এই মরুভূমি প্রথম আসে ১৯৬০ সালের দিকে, যখন একে নামবাং ন্যাশনাল পার্কের ভেতর অন্তর্ভুক্ত করা হয়। আর এখন বছরে প্রায় আড়াই লাখ মানুষ দেখতে আসে এই প্রাকৃতিক বিস্ময়।