রহস্যময় অনন্য শ্যামলিমায়

কাঠের ছোট্ট দোতলা বাড়িটা সমতল থেকে কয়েক হাজার মাইল উচ্চতায়। হিমালয়ের কাছাকাছি নিভৃতে ভুটানের চুউখা জেলার এক গ্রামে বাড়িটা। বিষণ্ন মনে যেন আমাদের জন্যই অপেক্ষা করছিল। অনেক রাত তখন। শন শন করে বইছে কনকনে শীতল হাওয়া।

সরাইখানাসহ বসতবাড়ির চৌকাঠ পেরিয়ে আমরা পাঁচজন হুড়মুড় করে বসে পড়লাম বৈঠকখানার একধারে রাখা রুম হিটারের কাছাকাছি। ঠান্ডায় জমে কাহিল অবস্থা পাঁচ ঢাকাই পরিব্রাজকের।

ডিসেম্বরের শেষ সময়ে রাত বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে নামতে থাকে তাপমাত্রা। সরাইখানার মালিক মধ্যবয়সী নারী ইংরেজি-হিন্দি মিলিয়ে বললেন, আজ রাতে বছর দশেকের ছেলে নিয়ে বাড়িতে একাই আছেন তিনি। তবে বাক্সপেটরা গুছিয়ে আমরা সেখানে রাতটা বহাল তবিয়তে কাটিয়ে দিতে পারি বলে ভরসাও দিলেন। কিন্তু হিটার ওই একখানা। আর তা ধারে মিলবে না বলেও সাফ জানিয়ে দিলেন।

দরজার বাইরে আঁচড় কাটতে উদগ্রীব বরফশীতল বাতাস। আশপাশে যে আরও একটু ঢুঁ মেরে দেখব, তা আর আমাদের সাহসে কুলাল না। মোমো অর্ডার করে গা এলিয়ে বসে সে রাতের মতো নিশ্চিত মনে অপেক্ষা করতে লাগলাম পেটপুজোর।

জনমানবহীন পাহাড়ঘেরা এই পাড়াগাঁয়ে পর্যটক প্রায় আসেন না বললেই চলে। আমরা দুদিন আগেই রোড ট্রিপের বুনো আনন্দের খোঁজে চ্যাংড়াবান্দা বর্ডার ক্রস করে প্রতিবেশী দেশ মাড়িয়ে চলে আসি ভুটানের ফুন্টসোলিংয়ে। রাজা-মহারাজাদের দেশ বলে কথা। ভারতের জায়গাও বর্ডার থেকে সুবিশাল নকশাখচিত তোরণ পেরিয়ে ফুন্টসোলিংয়ের আতিথ্য গ্রহণ করতে হয়। আর সে এক ম্যাজিক। তোরণের এ-পাশ আর ও-পাশে আসমান-জমিন ফারাক। প্রতিবেশী দেশের এ ধারে গাদাগাদি করে বসতি আর হুল্লোড়। বেশ নোংরা আর নানান কিসিমের তামাশা। আর অন্য ধারে ছিমছাম পরিচ্ছন্নতায় মোড়া অন্য এক দেশ। তার নাম ভুটান।

গ্রামের সে রাত কোনো দিনই ভোলার না। কাঠের পাটাতনে মচমচ শব্দ তুলে দোতলার যে ঘরখানায় আমরা সেই রাতে আশ্রয় নিয়েছিলাম, সেখানে সুচ, ছুরিসহ আরও ধারালো নানা অস্ত্রের মতো তীক্ষ্ণ বাতাস আসে কাঠের তক্তার ফাঁক গলে। পবনদেবসহ মনে আসা সব অবতারকে ডাকতে ডাকতে তিন চারটি কম্বল পেঁচিয়ে ঘুমিয়ে গিয়েছিলাম ক্লান্তশ্রান্ত প্রায় সবাই। আমি কেবল শুয়ে শুয়ে শুনছিলাম পাহাড়ের ডাক। সত্যি সত্যি সে রাতে পাহাড় ডাকছিল বলেই মনে হচ্ছিল। শন শন হাওয়ার সঙ্গে অদ্ভুত এক সুরের দ্যোতনা। পাহাড়ের একাকিত্ব, নিঃশব্দতার ভাষা কী যে ভীষণ টানতে থাকে, বুঝেছিলাম সে রাতে।

সকাল সকাল আমাদের রওনা দেওয়ার কথা চেলা লা পাস। ঠিক আটটায় এসে হাজির ভাড়া গাড়ির ড্রাইভার। সময়ানুবর্তিতা, নিয়মকানুন আর আদবকেতার কোনো অবমাননা চোখে পড়েনি পৃথিবীর একমাত্র কার্বন নেগেটিভ, আর সুখ দিয়ে উন্নয়ন পরিমাপের দেশে।

ভুটানে যদ্দিন থাকব, তত দিনের জন্য অস্থায়ী নিবাস হিসেবে ফুন্টসোলিং থেকে গাড়ি ভাড়া করেছি আমরা। চেলা লা রওনা দিতে রাস্তাতেই দেখলাম পাহাড়ের গা বেয়ে নামা ঝিরি আর রাস্তার পাশের নালাগুলো জমে বরফ হয়ে আছে। দুপাশের দুধসাদা বরফ, তার মাঝখান দিয়ে পিচ্ছিল রাস্তা বেয়ে আমরা চেলা লা পাস পৌঁছালাম।

সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ১৩ হাজার ফুট উচ্চতায় অবস্থিত চেলা লা পাস। একপাশে বুনো কালচে সবুজ পাহাড় আর অন্যদিকে হিমালয়ের দেখা মিলল। এই বিশালতা কিছুক্ষণ আমরা চুপচাপ শুধু দেখেই গেলাম। মনে হলো প্রকৃতির কাছে কী ভীষণ তুচ্ছ আমরা!

এরপর পড়ন্ত বিকেলের আলোয় পারোতে পৌঁছালাম। আহা কী মধুর শহর। এমন শহরও হতে পারে! পচু নদী বয়ে গেছে পুরো শহরের গা বেয়ে। কী পরিচ্ছন্ন চারিদিক। ভুটানের একমাত্র আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর অবস্থিত এখানে। নদী আর পাহাড়ঘেরা রানওয়ে। তামাম মুলুকের মানুষ এই পারো শহর দিয়েই এই দেশে তশরিফ রাখে।

সে রাতটা পারো আবিষ্কার করতে বের হলাম। আনাচকানাচ নানান জাতের খাবার চেখে দেখতেই রাত গভীর। সকালে ঘুম ভাঙল নদীর কুল কুল শব্দে। নদীর পাড়েই ছোট্ট দু-কামরার অতিথিশালায় ছিলাম। আহা মধুরও ধ্বনি সে নদীর।

সকালেই পারো পেরিয়ে রওনা দিলাম থিম্পু। দীর্ঘ পথ। তবু ক্লান্তি নেই, পথের দুপাশে ক্লান্তি দূর করার অজস্র উপাদান। হরেক রঙের মেঘ। তার আড়ালে পাথুরে, বুনো ঝোপে ছাওয়া, ঝাউগাছ ভর্তি আরও নানান কিসিমের পাহাড়ের উঁকিঝুঁকি। আপাতত আলবিদা এই রাস্তাতেই।

থিম্পু, পুনাখা, দোচু লা পাস আর পুনাখা জঙের গল্প না হয় থাকল অন্য কোনো সময়ের জন্য।