শান্তিনিকেতনে এক দিন

শান্তিনিকেতনে ‘খোয়াই বনের অন্য হাটে’ বাউলেরা গান করছেন। ছবি: লেখক
শান্তিনিকেতনে ‘খোয়াই বনের অন্য হাটে’ বাউলেরা গান করছেন। ছবি: লেখক

এক আমন্ত্রণে ভারতীয় অংশের সুন্দরবন দেখতে যাই। দেখা শেষে গঙ্গা নদী দিয়ে স্টিমারে কলকাতা ফিরছি। আনমনে গুনগুন করছিলাম—‘যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে তবে একলা চলো রে...’

সঙ্গী সাংবাদিক মানিক ভাই ও পিনাকী দাদা বললেন, ‘চলো, কাল শান্তিনিকেতন যাই। এক দিনে যতটা ঘোরা যায়, ঘুরে ঢাকায় ফিরে যাব।’

আমি লাফিয়ে উঠে বললাম, ‘আমি প্রস্তুত, চলেন!’

একলা আর চলতে হলো না। দল ভারী। সানন্দে ভাবছি, রবিঠাকুরের শিলাইদহের কুঠিবাড়ি, শাহজাদপুরের কাছারিবাড়ি, কলকাতা জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়িসহ অনেক কিছু দেখা হয়েছে, কিন্তু স্বপ্নের শান্তিনিকেতনে যাওয়া হয়নি। এবার এটি দেখার সুযোগ এসেছে।

সৃজনী শিল্পগ্রাম। বিভিন্ন রাজ্যের চিরায়ত লোকশিল্পের প্রদর্শনীর প্রবেশপথ। ছবি: লেখক
সৃজনী শিল্পগ্রাম। বিভিন্ন রাজ্যের চিরায়ত লোকশিল্পের প্রদর্শনীর প্রবেশপথ। ছবি: লেখক

পরদিন আমরা তিনজন কলকাতা থেকে ট্রেনে করে রাতে বোলপুরে পৌঁছালাম। আগে থেকে থাকার জায়গা ঠিক না থাকায় যন্ত্রণা পোহাতে হলো। এক মাতাল হোটেল ম্যানেজারের কথায় বিরক্তি নিয়ে গভীর রাতে খোঁজা শুরু করলাম হোটেল। বিভিন্নজনের সহযোগিতায় অবশেষে রাত কাটানোর ভালো ব্যবস্থা হলো।

সকালে ব্যাটারিচালিত অটোরিকশায় করে সারা দিনের জন্য বেরিয়ে পড়লাম। আমাদের অটোচালক গাইডের কাজও করলেন। রাস্তার ধারে নাশতা করাতে নিয়ে গেলেন। পথে দেখি, বিভিন্ন বয়সের মেয়েরা সাইকেল চালিয়ে স্কুল-কলেজ বা কাজে যাচ্ছেন। বিভিন্ন শিল্পকর্ম, নানা রঙের বীজ দিয়ে বানানো মালা, হস্তশিল্পসামগ্রী দিয়ে দোকান খুলেছেন। চারপাশের মানুষের মধ্যে একধরনের প্রাণবন্ত ভাব। চালক জানালেন, এখানে যে যাঁর মতো কাজ করেন, কোনো বৈষম্য নেই।

খাওয়া শেষে শান্তিনিকেতনের বিশ্বভারতী এলাকার দিকে রওনা হলাম।

ফটকের এক পাশে লেখা ‘প্রতীচী, অন্য পাশে ‘এ টি সেন’। নোবেল বিজয়ী অমর্ত্য সেনের বাড়ি। ছবি: লেখক
ফটকের এক পাশে লেখা ‘প্রতীচী, অন্য পাশে ‘এ টি সেন’। নোবেল বিজয়ী অমর্ত্য সেনের বাড়ি। ছবি: লেখক

বইয়ের দোকান ‘সুবর্ণরেখা’ ঐতিহাসিক পুরোনো ও নুতন বই বিক্রেতা। বিখ্যাত মানুষেরা এখানে এসেছেন বই কিনেছেন বলে জানালেন দোকানের কর্মচারীরা। পিনাকী দাদা আর মানিক ভাই অনেক বই নিয়েই চলেছেন। চল্লিশের দশকের এই অঞ্চলের নদ-নদীর সারভেটির কপিটি দেখে খুবই পছন্দ হলো। বই যা দেখছি, তা-ই পছন্দ হচ্ছে। অবশেষে আমার কেনা হলো মাত্র দুটি। আমাদের সবার টাকাও প্রায় শেষ, এখনো অনেক দেখা বাকি।

উইকিপিডিয়া থেকে এর ইতিহাসটা দেখে নিই: ১৮৬৩ খ্রিষ্টাব্দে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বাবা মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর নিভৃতে ঈশ্বরচিন্তা ও ধর্মালোচনার উদ্দেশ্যে বোলপুর শহরের উত্তরাংশে এই আশ্রম প্রতিষ্ঠা করেন। ১৯০১ সালে রবীন্দ্রনাথ শান্তিনিকেতনে ব্রহ্মবিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন, যা কালক্রমে বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের রূপ নেয়। রবীন্দ্রনাথ তাঁর জীবনের দ্বিতীয়ার্ধের অধিকাংশ সময় শান্তিনিকেতন আশ্রমে অতিবাহিত করেছিলেন। ১৯৫১ সালে বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয় ভারতের কেন্দ্রীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের মর্যাদা লাভ করে। মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর যখন রায়পুরের জমিদারবাড়িতে নিমন্ত্রণ রক্ষা করতে এসেছিলেন, তখন এই ছাতিমতলায় কিছুক্ষণের জন্য বিশ্রাম করেন এবং এখানে তিনি তার ‘প্রাণের আরাম, মনের আনন্দ ও আত্মার শান্তি’ পেয়েছিলেন। তখন রায়পুরের জমিদারের কাছ থেকে ষোলো আনার বিনিময়ে ২০ বিঘা জমি পাট্টা নেন। বর্তমানে ঘেরা আছে। সেখানে সাধারণের প্রবেশ নিষেধ।

কালো বাড়ি। দেয়ালে আছে নানা শিল্পকর্ম। ছবি: লেখক
কালো বাড়ি। দেয়ালে আছে নানা শিল্পকর্ম। ছবি: লেখক

এই স্থানের প্রতিটি জায়গাই ঐতিহাসিক। তালধ্বজ, তিনপাহাড়, দেহলী, নতুন বাড়ি, শালবীথি, আম্রকুঞ্জ, ঘণ্টাতলা—নানা উৎসব-অনুষ্ঠানের জন্য আলাদা আলাদা স্থানের নাম রয়েছে। শান্তিনিকেতন নামটির মধ্যেই শান্তি শান্তি ভাব আছে। শুধু নামে নয়, সেই জায়গাতে গেলেও মনে শান্তি শান্তি ভাব চলে আসে। দেখলাম কালো বাড়ি। কালো বাড়িটি মাটির তৈরি, দেয়ালে বিভিন্ন কারুকাজ করা। বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের ফাইনাল বর্ষের ছাত্ররাই সাধারণত এখানে থাকেন। ঘুরলাম ছাতিমতলা। দেখলাম কীভাবে কোন জায়গায় বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্র্যাজুয়েটদের সমাবর্তন হয়। সমাবর্তনে স্নাতকদের সপ্তপর্ণীগাছের পাঁচটি পাতার গুচ্ছ উপহার দেওয়া হয়। বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ছিলেন অগ্রণী বাঙালি কবি, ঔপন্যাসিক, সংগীতস্রষ্টা, নাট্যকার, চিত্রকর, ছোটগল্পকার, প্রাবন্ধিক, অভিনেতা, কণ্ঠশিল্পী ও দার্শনিক। রবীন্দ্রনাথকে গুরুদেব, কবিগুরু ও বিশ্বকবি অভিধায় ভূষিত করা হয়। ১৯১৩ সালে গীতাঞ্জলি কাব্যগ্রন্থের ইংরেজি অনুবাদের জন্য তিনি সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার লাভ করেন। তিনি আমাদের জাতীয় সংগীত ‘আমরা সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালোবাসি’র রচয়িতা। ভারতের জাতীয় সংগীতও তিনি রচনা করেছেন।

শান্তিনিকেতনের ভবনে শিল্পকর্ম। ছবি: লেখক
শান্তিনিকেতনের ভবনে শিল্পকর্ম। ছবি: লেখক

একটি বাসার সামনে দিয়ে যাওয়ার সময় গেটের এক পাশে লেখা দেখলাম ‘প্রতীচী’, অন্যদিকে ‘এটি সেন’। গাইড জানালেন, নোবেল বিজয়ী অমর্ত্য সেনের বাড়ি। কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের বাঙালি অধ্যাপক অমর্ত্য সেন ১৯৯৮ সালের অর্থনীতিতে নোবেল পুরস্কার লাভ করেছেন। অমর্ত্য ড. সেনের বাবা আশুতোষ সেন ভারতীয় পাবলিক সার্ভিস কমিশনের চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করেন। তিনিও রবীন্দ্রনাথ থাকাকালে শান্তিনিকেতনে শিক্ষকতা করেছেন।

কলাভবন। ভবনজুড়ে কারুকাজ। ছবি: লেখক
কলাভবন। ভবনজুড়ে কারুকাজ। ছবি: লেখক

অমর্ত্য সেনের পূর্বপুরুষদের আদিবাস ছিল ঢাকায়। তাঁর শৈশবও কেটেছে ঢাকায়। শৈশবের দুরন্ত দিনগুলো অমর্ত্য সেন কাটিয়েছেন মানিকগঞ্জ আর ঢাকায়। তিনি উদীচীর প্রতিষ্ঠাতা সত্যেন সেনের দৌহিত্র। সম্প্রতি অমর্ত্য সেন প্রথম আলোর অনুষ্ঠানে বাংলাদেশে এসেছিলেন। সেই সময় আমার সৌভাগ্য হয়েছিল তাঁর কাছ থেকে শান্তিনিকেতনের অনেক কিছু জানার। সবকিছু স্বপ্নের মতো মনে হচ্ছে। একজন রবিঠাকুরের কৃতিত্বে কত কিছুই না পেয়েছে বাঙালি জাতিসহ সারা বিশ্ব। ‘গ্রামছাড়া ঐ রাঙ্গা মাটির পথ...’ রবীন্দ্রসংগীত যে স্থান নিয়ে লিখেছিলেন, সেই পথ ধরে চলছি। সৌভাগ্যক্রমে শনিবার হওয়ায় পেয়ে গেলাম ‘খোয়াই বনের অন্য হাট’। গ্রামের বাউলেরা দল বেঁধে এসেছেন গান করতে, হাটে নানান হস্তশিল্প নিয়ে বসেছেন স্থানীয় লোকজন। তৃপ্তি হচ্ছে না এই শান্তিনিকেতন কিংবা বোলপুর দেখে। এত অল্প সময় নিয়ে আসা ঠিক হয়নি। তবে এই সান্ত্বনা, কবিগুরুর আরও একটি তীর্থস্থান তো দেখা হলো, জানা হলো। দিন শেষে ফেরার পালা। বোলপুর স্টেশনে ট্রেনে যখন উঠেছি, মনে পড়ছে কবিতাটি—‘রেলগাড়ির কামরায় হঠাৎ দেখা, ভাবিনি সম্ভব হবে কোন দিন...সবাই নেমে গেল পরের স্টেশনে, আমি চললেম একা...’

জিয়া ইসলাম: সাংবাদিক।