ভালোবাসা না মানে বয়সের বাধা

বয়স হিসাব করে কি ভালোবাসা হয়? ভালোবাসা তো স্থান-কাল-পাত্র বিবেচনা করেও হয় না সব সময়। ভালোবাসার সম্মোহনী শক্তি সব প্রতিকূলতাকেই হার মানায়। সমাজের চোখে যা অসংগতিপূর্ণ, প্রেমের ক্ষেত্রে তা খুব সহজেই আশকারা পায়। সারা পৃথিবীতেই স্বামী-স্ত্রীর বয়স নিয়ে একটা অলিখিত নিয়ম চালু আছে। ধরে নেওয়া হয় দুজনের মধ্যে স্বামীই হবেন বয়সে বড়। বাংলাদেশ, ভারতসহ এশিয়া অঞ্চলে এই নিয়মের বাড়াবাড়িও চোখে পড়ার মতো। এমনকি স্বামী যদি বয়সে স্ত্রীর সমান হন, সেটাও অনেক সময় সহজভাবে নেওয়া হয় না।

বেসরকারি একটি প্রতিষ্ঠানে একসঙ্গে চাকরি করতেন মাহিন আরা ও সানোয়ার (ছদ্মনাম)। মাহিন আরার স্বামী মারা গেছেন বেশ কয়েক বছর আগে। দুই সন্তান বিদেশে পড়াশোনা করছেন। চাকরি আর বাসা, এ নিয়েই চলছিল জীবন। তবে কখন, কেমন করে প্রাণোচ্ছল সানোয়ারের সঙ্গে তাঁর একটা ভালোবাসার সম্পর্ক তৈরি হয়ে যায়, তা যেন তিনি নিজেই বুঝতে পারেন না। একসময় ১৫ বছরের বয়সের ব্যবধানের বাধাকে পেছনে ফেলে বিয়ে করেন তাঁরা। কিন্তু একপর্যায়ে সমাজের কানাঘুষা, কিছুটা তিরস্কারে তাঁরা দেশ ছাড়ার পরিকল্পনা নেন। বিয়ের কয়েক বছরের মধ্যে কানাডায় থিতু হয়ে এখন সুখেই কাটছে তাঁদের জীবন।

আমাদের দেশে ১০ বছরের ছোট কনেকে বিয়ে করা মোটামুটি স্বাভাবিক হিসেবে ধরে নেয় সমাজ, সে ভালোবেসেই হোক বা পারিবারিকভাবেই হোক। তবে কোনো নারী তাঁর চেয়ে ১০ বছরের ছোট কোনো পুরুষকে বিয়ে করছেন, এমন হলেই পাল্টে যায় দৃষ্টিভঙ্গি। ‘বুড়ো বউ’ বিয়ে করায় ছেলেটির জীবন যে ‘শেষ’ হয়ে গেল, সেই সমবেদনা জানাতে ভোলেন না আত্মীয়-পরিজনেরা। আবার অনেক ক্ষেত্রে বয়স্ক পুরুষকে ভালোবেসে বিয়ে করাতেও সমাজের অসম্মতি রয়েছে। এ ধরনের যুগলকে নানা ক্ষেত্রেই চাপে রাখে সমাজ। তবে দেশ ও দেশের বাইরের অনেক তারকা, বিখ্যাত ব্যক্তি সমাজের এসব ফেনিয়ে তোলা সমস্যাকে তুড়ি মেরে উড়িয়ে দিয়ে দিব্যি আনন্দে সংসার করে যাচ্ছেন। বয়সের অসমতা তাঁদের জীবনকে প্রভাবিত করে না।

প্রিয়াঙ্কা চোপড়ার সঙ্গে মার্কিন পপতারকা নিক জোনাস
প্রিয়াঙ্কা চোপড়ার সঙ্গে মার্কিন পপতারকা নিক জোনাস

গত ১৮ আগস্ট বলিউড ও হলিউড তারকা প্রিয়াঙ্কা চোপড়ার সঙ্গে মার্কিন পপতারকা নিক জোনাসের বাগদান হয়। এ বছরই তাঁরা বিয়ে করবেন, এমনটা শোনা যাচ্ছে। ৩৬ বছর বয়সী প্রিয়াঙ্কার সঙ্গে ২৫ বছর বয়সী নিকের বিয়েটা এখন বলিপাড়ায় সবচেয়ে আলোচিত বিষয়। নিন্দুকেরা কথা বলতে ছাড়েননি। এই ভালোবাসা পরিণতি পাবে না, এমন কানাঘুষা চলেছে বিশ্বব্যাপীই। তবে বয়সের ব্যবধান যা-ই হোক না কেন, নিক যে তার মনের মানুষ, তা বলেই দিয়েছেন প্রিয়াঙ্কা।

অঙ্কিতা কোনওয়ার ও মিলিন্দ সুমন
অঙ্কিতা কোনওয়ার ও মিলিন্দ সুমন

প্রেমিকার বয়স নিজের বয়সের থেকে অর্ধেক বলে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বহুবারই সমালোচনার মুখে পড়েছেন ভারতীয় মডেল ও অভিনেতা মিলিন্দ সুমন। ভারতের গুয়াহাটির মেয়ে অঙ্কিতা কোনওয়ারের সঙ্গে প্রায় দুই বছর ধরে প্রেম করেন মিলিন্দ। অঙ্কিতা বয়সে মিলিন্দের চেয়ে ২৯ বছরের ছোট! বয়সের এই লম্বা ফারাকও তাঁদের প্রেমে কোনো বাধা তৈরি করতে পারেনি। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রায়ই দুজন নিজেদের রোমান্টিক মুহূর্তের ছবি প্রকাশ করেন। এ নিয়ে তাঁরা কোনো সমালোচনাকে প্রশ্রয় দেননি। চলতি বছরের এপ্রিলে বিয়ে করেন তাঁরা।

ফরাসি প্রেসিডেন্ট এমানুয়েল মাখোঁ ও ফার্স্ট লেডি ব্রিজিত
ফরাসি প্রেসিডেন্ট এমানুয়েল মাখোঁ ও ফার্স্ট লেডি ব্রিজিত

ফ্রান্সের বর্তমান প্রেসিডেন্ট এমানুয়েল মাখোঁর প্রেম ও বিয়ে বেশ মজার। ১৭ বছরের কিশোর এমানুয়েল তাঁর স্কুলের ড্রামা শিক্ষিকা ব্রিজিতের প্রেমে পড়েন। হাইস্কুলে অনেক ছাত্র-ছাত্রীরই সুদর্শন শিক্ষক-শিক্ষিকার প্রতি আকর্ষণ তৈরি হয়, কিন্তু সাধারণত তা প্রেম বা বিয়েতে গড়ায় না। কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয়ে সাধারণত দেখা যায় দু-একটা ঘটনা। তবে সাহস দেখিয়ে ব্রিজিতকে ভালোবাসার কথা জানিয়ে দেন মাখোঁ। তিনি বলেন, ‘আমি তোমাকে একদিন বিয়ে করব, দেখো।’ এমানুয়েল কথা রেখেছেন। বয়সের ২৫ বছরের ব্যবধান অগ্রাহ্য করে ২০০৭ সালে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন তাঁরা। ব্রিজিত এখন আলোচিত ফার্স্ট লেডি।

প্রিন্স হ্যারি ও মার্কিন অভিনেত্রী মেগান মার্কেল
প্রিন্স হ্যারি ও মার্কিন অভিনেত্রী মেগান মার্কেল

তবে সবকিছুকে ছাপিয়ে প্রথা ভাঙার এক অনন্য দৃষ্টান্ত তৈরি করেছেন ব্রিটিশ রাজপুত্র হ্যারি। ৩৩ বছর বয়সী প্রিন্স হ্যারির সঙ্গে ৩৬ বছর বয়সী মার্কিন অভিনেত্রী মেগান মার্কেলের বিয়ে হয় চলতি বছরের মে মাসে। রাজপুত্র বয়সে বড় এক নারীকে বিয়ে করছেন, তার ওপর ওই নারীর এটি দ্বিতীয় বিয়ে—এ ঘটনায় আলোচনা-সমালোচনার ঝড় বয়ে গেছে সারা বিশ্বে। তবে সব সমালোচনার ঊর্ধ্বে গিয়ে ভালোবাসাটাই প্রাধান্য পেয়েছে।

অবশ্য অসম বয়সের সব দম্পতিই যে সুখে আছেন, এটা বলা যাবে না। এলিজাবেথ টেইলর-জ্যাসন উইন্টারস, ডেমি মুর-অ্যাস্টন কুচার ভালোবেসে গাঁটছড়া বেঁধেছিলেন, আবার তা ছিঁড়েও গেছে। ভারতের পাঞ্জাবি কবি ৬০ বছরের অমৃতা প্রিতম সিং বিয়ে করেছিলেন তাঁর অর্ধেক বয়সী এক চিত্রকরকে, সে বিয়েও টেকেনি। আসলে সামাজিক বাধা ভেঙে এগোনোর পরিকল্পনা করতে চাইলে দুজনের মধ্যে বোঝাপড়াটা বেশ জরুরি।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোবিজ্ঞান বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ক্লিনিক্যাল সাইকোলজিস্ট তানজির আহম্মদ বলেন, ‘আমাদের দেশে বহু আগে থেকে অসম বিয়ে হয়ে আসছে। ৩০ বছরের ছেলের সঙ্গে ১০-১৫ বছরের মেয়ের বিয়ে হরহামেশাই হয়েছে, হচ্ছে। তবে সমাজই এখন সেই ব্যবধান কিছুটা কমিয়ে আনছে। আসলে আমাদের দেশে দেখা যায় ছেলেটার বয়স কত বেশি, তাতে তেমন কিছু আসে যায় না। মেয়ের বয়স ছেলের থেকে বেশি হলেই নানা রকম চিন্তা, মাথা ব্যথা শুরু হয়ে যায়। ব্যবধান যা-ই থাকুক না কেন, ভালো থাকাটা নির্ভর করে চিন্তাচেতনা ও নিজস্ব চাহিদার ওপর। এ ধরনের সম্পর্কের ক্ষেত্রে বেশ কয়েকটি বিষয় আসে, যেমন শারীরিক বিষয়, বর্তমান অবস্থা ও আবেগ। কোন বিষয়টি গুরুত্ব দেব, এটা ঠিক করতে হবে।

কোনো বিয়েতেই সবার ১০০ ভাগ প্রত্যাশা পূরণ হয় না বলে মনে করেন তানজির আহম্মদ। তিনি বলেন, নিজের চাওয়াটা বুঝতে হবে। বয়সের বেশি ব্যবধানে বিয়ে করা দম্পতিদের ক্ষেত্রে একে অপরের প্রতি আগ্রহ, মনোযোগ, বোঝাপড়া খুবই গুরুত্বপূর্ণ, যা এই সম্পর্ককে সবকিছুর ঊর্ধ্বে নিয়ে যেতে পারে। আবেগের বশে সম্পর্কে জড়ানোর পর সামাজিক চাপ অনুভব করলে অনেক সময় এমন সম্পর্ক ভেঙে যায়। এটা মোকাবিলা করার শক্তি থাকতে হবে।