নাশতা খেতে খেতে

সকালের নাশতা এখন হয়ে উঠেছে কাজ বা আড্ডার উপলক্ষ। মডেল: রাতুল, রিমা ও বাপ্পা। স্থান: গ্লোরিয়া জিনস, গুলশান ২। ছবি: কবির হোসেন
সকালের নাশতা এখন হয়ে উঠেছে কাজ বা আড্ডার উপলক্ষ। মডেল: রাতুল, রিমা ও বাপ্পা। স্থান: গ্লোরিয়া জিনস, গুলশান ২। ছবি: কবির হোসেন

দশটা-পাঁচটা অফিস। আর অফিসে গিয়ে সভাকক্ষে বসা অনেকের জন্য নিয়মিত ঘটনা। তবে একই ঘরে কেতাদুরস্ত হয়ে বসে সব সময় ‘মিটিং’ না করে রেস্তোরাঁয় বসেও একদিন কাজ সারা যায়। আর সেটা হতে পারে সকালে, নাশতা খেতে খেতে। শুধু যে এই ‘ব্রেকফাস্ট মিটিং’ তা নয়, বন্ধু-পরিবারসহ ছুটির দিনগুলোতে বাইরে গিয়ে সকালের নাশতা করতে করতে কাটানো যায় সুন্দর কিছু মুহূর্ত। শহুরে জীবনে এ ধারাটা বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠছে।

দেশবন্ধুর সকালের নাশতা খেতে আসেন অনেকে
দেশবন্ধুর সকালের নাশতা খেতে আসেন অনেকে

বন্ধুদের আড্ডা, কারও সঙ্গে দেখা করা বা জরুরি আলাপের জন্য দিনের শুরুটাকে বেছে নিচ্ছেন অনেকে। শহুরে জীবন মানেই দম ফেলার ফুরসত নেই। যানজটের জন্য কাজের পর অন্য কোথাও যেতে মনও তেমন টানে না। তাই রুটিন ভেঙে ঘরের বাইরে এসে সকালের নাশতাসহযোগে সেরে নিতে পারেন কাজ কিংবা বন্ধুদের সঙ্গে ‘গেট টুগেদার’। সেটা বাড়ির সামনে, বাসার ছাদে ছাড়াও হতে পারে কোনো রেস্তোরাঁ বা ক্যাফেতে। ঢাকা শহরে অনেক দোকানে সকালের নাশতা জনপ্রিয়। জ্যাম ছাড়া আরামে ঘুরে খেয়েদেয়ে তারপর শুরু করতে পারেন আপনার কর্মব্যস্ত দিন।

কাজের কথাও সারা যায় প্রাতরাশে
কাজের কথাও সারা যায় প্রাতরাশে

ঘরের বাইরে প্রাতরাশ খাওয়ার জন্য রাজধানীতে জায়গার অভাব নেই। স্টার হোটেলে সারা দিন যে ভিড়, সেটা কিন্তু শুরু হয় সকালেই। সকাল নয়টার পর এখানে নাশতায় পছন্দের পদ পাওয়া মুশকিল। স্টারের মগজ বা কলিজাভুনা, নেহারি, স্যুপ আর ফিনফিনে রুমালি রুটির স্বাদ নিতে দল ধরে লোকজন আসেন প্রতিদিন। পরিবার বা বন্ধুদের গেট টুগেদারের জন্য স্টারের সকালটা বেছে নিতে পারেন। 

প্রাতরাশের সঙ্গে কাজের আলাপ সারতে চাইলে কিংবা আনুষ্ঠানিক মিটিং করতে চাইলে গুলশানের গ্লোরিয়া জিনসে বসতে পারেন। এখানে দেশি-বিদেশি নাশতার সঙ্গে পাবেন এক মগ গরম কফি। বেশ কয়েকটি দেশের জনপ্রিয় পদ দিয়ে প্যাকেজ বানানো আছে এখানে। তার মধ্যে আলু গোবি উইথ মাসালা ওমলেট, গ্রিলড মাশরুম, স্ক্র্যাম্বেলড এগ, চিকেন সসেজ, বেকড বিনস, টোস্টেড ব্রেড উইথ বাটার এবং নানা স্বাদের কফি পাবেন। এখানে ২০০ থেকে ৪৫০ টাকার মধ্যে সকালের নাশতা খেতে পারবেন।

ছবি: কবির হোসেন
ছবি: কবির হোসেন

ধানমন্ডির বেঙ্গল বইয়ে নাশতা করতে পারবেন নিয়মিত সপ্তাহে দুই দিন। শুক্র ও শনিবার। এ ছাড়া সরকারি যেকোনো ছুটির দিনে নাশতার আয়োজন হয় এখানে। মূলত দুই ধরনের নাশতার প্যাকেজ থাকে বেঙ্গল বইয়ে। একটা প্যাকেজে খিচুড়ি, ডিমভাজি, বেগুনভাজি, মুরগি, আচার, মিষ্টি ও চা এবং আরেকটা প্যাকেজে লুচি, লাবড়া, ডিমভাজি, মুরগি, মিষ্টি ও চা পাওয়া যাবে। দাম ২০০ টাকার কিছু বেশি। প্রতিষ্ঠানটির ব্র্যান্ড অ্যান্ড কমিউনিকেশনস ম্যানেজার এ আর এম আখতার হোসেন বলেন, ‘সব রকম ছুটির দিনে বেঙ্গল বইয়ে নাশতা করতে আসেন অনেক লোক। এখানে গাছপালায় ঘেরা খোলা আকাশের নিচে উঠানে বসে নাশতা করা যায়। পরিবেশনে বাড়ির আবহ দিতে চেষ্টা করি।’

একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে (এনজিও) কর্মরত রুহুল আমিন নিজের অভিজ্ঞতা থেকে বললেন, ‘আমাদের কাজ নানা ধরনের মানুষের সঙ্গে। তাই সপ্তাহে প্রায় তিন-চার দিন মিটিং করতে হয়। প্রতি মাসেই চেষ্টা করি কিছু মিটিং অফিসের বাইরে করতে। সে ক্ষেত্রে সকালে ভালো কোনো রেস্তোরাঁয় বসে যাই। কর্মীদের মধ্যেও আলাদা এক ধরনের উৎসাহ থাকে। আমার মনে হয়, অফিসের বাইরে মিটিং করায় কর্মীদের মনোযোগ বেশি থাকে।’

পাঁচতারকা হোটেলে নাশতার পদে ভিন্নতা থাকে সবচেয়ে বেশি। যাঁরা হোটেলে অতিথি হিসেবে থাকেন, তাঁদের সকালের নাশতার জন্য আলাদা পয়সা দিতে হয় না। নানা কাজে অনেক বিদেশি অতিথি বাংলাদেশে আসেন। যেহেতু তাঁরা হোটেলে ওঠেন, তাই মিটিং করতে হোটেলের রেস্তোরাঁ বেছে নেন। ঢাকার একটি পাঁচতারকা হোটেলের একজন জনসংযোগ কর্মকর্তা জানালেন, তৈরি পোশাক বা চামড়াজাত পণ্যের অনেক বিদেশি ক্রেতা নিয়মিত তাঁদের হোটেলে এসে থাকেন। এই সময় তাঁরা নানা ধরনের মানুষের সঙ্গে মিটিং করেন। সাধারণত সকালের নাশতা আর দুপুরে খাবারের সঙ্গেই তাঁরা টেবিলে বসে মিটিং করেন।

গ্লোরিয়া জিনসের ভিনদেশি পদ
গ্লোরিয়া জিনসের ভিনদেশি পদ

অনেক সময় দেখা যায়, পুরোনো কোনো বন্ধু বিদেশ থেকে দেশে ফিরেছেন। অনেক দিন পর দেশে আসায় প্রতিদিন দুপুরে এই বাসায় তো রাতে ওই বাসায় খাচ্ছেন। হয়তো কাছের বন্ধুরাই এক বেলা সময় দিতে পারছেন না। সে ক্ষেত্রে সহজ সমাধান বন্ধুকে সকালে ডেকে নেওয়া। সকালটা নিশ্চয়ই খালি পাবেন বন্ধুর। ছুটির দিনে সকালে ডাকলে তো অনেক সময় দিতে পারবেন। তবে কাজের দিনে ডাকলে অফিসের আশপাশের কোনো ক্যাফেতে বসতে পারেন। সকালে হলেও বন্ধুর সঙ্গে কাটানো এই সময়টা আপনাকে পরে ‘হায় হায়’ আফসোসে পোড়াবে না। গুলশান ও বনানীর বাংলার মিষ্টি দোকানেও পাবেন নাশতা। এখানে পরোটা বা লাল আটার রুটি পাওয়া যায়। সঙ্গে আলুর দম, বুটের ডাল, কলিজাভুনা, জুস, রসগোল্লা, দুধ-চা ইত্যাদি পাবেন। ২৫০ থেকে ৪৫০ টাকার প্যাকেজ আছে বাংলার মিষ্টিতে।

পুরান ঢাকার ছানা ও মাঠা
পুরান ঢাকার ছানা ও মাঠা

পুরান ঢাকার দেশবন্ধু সুইটমিটের নাশতারও একটা ঐতিহ্য আছে। ইত্তেফাক মোড় ও হাটখোলা রোডের লম্বা-চিকন দুটি দোকানে পরোটা, ভাজি, হালুয়া আর রসগোল্লার কদর বুঝতে চাইলে একদিন ঘুরে আসতে পারেন দেশবন্ধু থেকে। যদিও সারা দিন এখানে পরোটা-ভাজি পাবেন, তবে সকালের স্বাদ আলাদা। সকাল সাতটা থেকে রাত আটটা পর্যন্ত খোলা দেশবন্ধু। ৪০ থেকে ৫০ টাকায় সকালের নাশতা খেতে পারবেন এখানে।

মরণচাঁদ মূলত মিষ্টির দোকান হলেও এখানে সকালের নাশতায় সবজি-ভাজি আর পরোটার সুনাম আছে। মরণচাঁদে বসে কামড় দিয়ে দেখতে পারেন ১০ টাকার কলিজা শিঙাড়াতেও। স্বাদ? মুখে লেগে থাকবে।

স্টার হোটেল অ্যান্ড রেস্টুরেন্টের ঐতিহ্যবাহী নাশতা
স্টার হোটেল অ্যান্ড রেস্টুরেন্টের ঐতিহ্যবাহী নাশতা

পুরান ঢাকার আল রাজ্জাক হোটেলেও সকালের নাশতা খেতে আসেন অনেক লোক। এ ছাড়া ভোরবেলা পুরান ঢাকার নাজিমুদ্দিন রোড, লালবাগ, তাঁতীবাজারসহ বিভিন্ন সড়কে খেতে পারেন আলগা ছানা। টিনের হাঁড়ি নিয়ে রাস্তার ধারে বসে থাকা এই ছানা বিক্রেতাদের কাছে ঘোল বা মাঠাও পাওয়া যায়। পত্রিকার কাগজে ১০ টাকার আলগা ছানার ওপর চিনি ছিটিয়ে বিক্রি করেন বিক্রেতারা। ফেসবুকের বিভিন্ন খাবারবিষয়ক গ্রুপে ঘুরেও আরও নানা জায়গার খোঁজ পাবেন সহজে।

দৈনন্দিন রুটিনে ঘেরাটোপ থেকে বেরিয়ে একদিন না হয় সকালে উঠে বেরিয়ে পড়লেন। ভোরের নরম আলোয় আর ঠান্ডা বাতাস গায়ে মাখতে মাখতে পেট ভরে নাশতা করুন প্রিয়জনদের সঙ্গে ভালো কোনো হোটেলে। রাতে হিসাব করে দেখুন, হইহল্লা দিয়ে শুরু করা এই দিনটা কিন্তু মন্দ কাটল না!

যেভাবে নাশতার প্রচলন

সকালে নাশতা করার বিষয়টা ৩০০ বছর আগেও মানুষের দৈনন্দিন জীবনের অংশ ছিল না। সকালের নাশতা বা ব্রেকফাস্টের প্রচলন ঘটে ব্রিটেনে অষ্টাদশ শতকে। আরও নির্দিষ্ট করে বললে ব্রিটেনে রাজতন্ত্র ফিরে আসার পর ১৭৪০ সালের দিকে দ্বিতীয় চার্লস রাজা হিসেবে দায়িত্ব নেন। তখন থেকে সকালে খাবার টেবিলে নাশতা এবং চা-কফির আয়োজন করা ব্রিটেনের সংস্কৃতির অংশ হয়ে যায়।

দেশবন্ধুর নাশতা
দেশবন্ধুর নাশতা

প্রাথমিকভাবে নাশতার সংস্কৃতি প্রচলন ছিল শুধু সেখানকার অভিজাত পরিবারের মধ্যে। পরে উনবিংশ শতকে প্রথম শিল্প বিপ্লবের সময় নতুন গড়ে ওঠা কল-কারখানার শ্রমিকেরা সকালে কিছু খেয়ে কাজে যাওয়া শুরু করেন। এভাবে সকালের নাশতা করার এই প্রচলন ব্রিটেনের অভিজাত পরিবার থেকে সাধারণ মানুষের মধ্যে নেমে আসে।

সূত্র: বিবিসি ম্যাগাজিন