মরিতে চাহি না আমি সুন্দর ভুবনে

জীবন উদ্‌যাপনের। যত হতাশাই আসুক, তাকে জয় করতেই হবে। মডেল: সুহাস, খুশবু, মৃত্তিকা ও আবির, ছবি: কবির হোসেন
জীবন উদ্‌যাপনের। যত হতাশাই আসুক, তাকে জয় করতেই হবে। মডেল: সুহাস, খুশবু, মৃত্তিকা ও আবির, ছবি: কবির হোসেন

সোহেলী (ছদ্মনাম) পড়ছেন বিশ্ববিদ্যালয়ে। কদিন ধরেই তাঁর কথাবার্তা কেমন যেন বদলে যাচ্ছে। তাঁর কথায় সব সময় হতাশা। বন্ধুদের বলেন, ‘আমি যখন থাকব না তখন পৃথিবীটা কেমন থাকবে?’ বন্ধুরা তাঁর কথা নিয়ে হাসাহাসি করেন। কাজকর্মও খুব শ্লথ হয়ে গেছে। কারও সঙ্গে বেশি মিশতে চান না। একা একা থাকেন। কোনো কিছুতেই যেন তাঁর আগ্রহ নেই। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তিনি হতাশামূলক পোস্ট দেন।

সোহেলীর এসব বিষয় কেউ আমলে নিচ্ছিল না। কিন্তু হঠাৎ করে একদিন শোনা গেল একগাদা ঘুমের ওষুধ খেয়ে হাসপাতালে ভর্তি। বন্ধু-স্বজনেরা সবাই তাঁকে দেখতে গেলেন। বেশ কয়েক দিনের চিকিৎসায় শারীরিকভাবে সুস্থ হলেন এবং মনোচিকিৎসকের কাছে তাঁকে পাঠানো হলো।

সারা পৃথিবীতে সোহেলীর মতো প্রায় ৬০ হাজার মানুষ প্রতিদিন নানাভাবে আত্মহত্যার চেষ্টা করে থাকেন। তাঁদের মধ্যে ২২০০ থেকে ৩০০০ জন আত্মহত্যা করেই ফেলেন। এই হিসাবে বিশ্বে বছরে ৮ লাখ মানুষ আত্মহত্যার মাধ্যমে মৃত্যুবরণ করেন। প্রতি ৪০ সেকেন্ডে একজন!

বাংলাদেশে বড় মাপের গবেষণা না হলেও বিভিন্ন গবেষণা আর বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্যমতে বছরে প্রায় ১০ হাজার মানুষ আত্মহত্যা করেন। এর ১০ গুণ মানুষ আত্মহত্যার চেষ্টা করেন আর তারও ১০ গুণ মানুষ আত্মহত্যার চিন্তা করে থাকেন। পশ্চিমা বিশ্বে পুরুষদের আত্মহত্যার হার বেশি আর বাংলাদেশসহ দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোতে নারীদের আত্মহত্যার হার বেশি।

আত্মহত্যা একটি প্রতিরোধযোগ্য স্বাস্থ্য সমস্যা। বিষণ্নতা, ব্যক্তিত্বের বিকার, বাইপোলার ডিসঅর্ডার, সিজোফ্রেনিয়াসহ নানা রোগের কারণে মানুষ আত্মহত্যা করে থাকে। আত্মহত্যাপ্রবণতা ও মানসিক স্বাস্থ্যসচেতনতা গুরুত্বপূর্ণ। তাই বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, যাঁরা চেষ্টা করে ব্যর্থ হচ্ছেন, তাঁদের বেশির ভাগই কোনো না কোনো মানসিক রোগে আক্রান্ত। কাউন্সেলিং এবং যথাযথ চিকিৎসার মাধ্যমে আত্মহত্যার পথ থেকে তাঁদের ফেরানো সম্ভব। মনোবিজ্ঞানীদের মতে, অতিমাত্রায় বিষণ্নতায় আক্রান্ত ব্যক্তিরা আত্মহত্যার দিকে ধাবিত হন। তরুণ প্রজন্ম সবচেয়ে বেশি আত্মহত্যার ঝুঁকিতে রয়েছে।

আত্মহত্যার কারণ
বাংলাদেশে আত্মহত্যার কারণ হিসেবে বিভিন্ন গবেষণায় যে বিষয়গুলো উঠে এসেছে—

  • যৌতুক ও পারিবারিক নির্যাতন
  • দাম্পত্য কলহ
  • উত্ত্যক্ত করা ও আত্মহত্যা প্ররোচনা
  • প্রেম ও পরীক্ষায় ব্যর্থতা
  • দারিদ্র্য ও বেকারত্ব
  • আত্মহত্যার উপকরণের সহজপ্রাপ্যতা
  • মানসিক অসুস্থতা
  • জটিল শারীরিক রোগযন্ত্রণা থেকে আত্মহত্যা
  • নগরায়ণ ও পরিবারতন্ত্রের বিলুপ্তি
  • নৈতিক অবক্ষয় ও সামাজিক অস্থিরতা।

ফেরানো যায়
আত্মহত্যা একটি প্রতিরোধযোগ্য সমস্যা। ফলে একটু মনোযোগ দিলেই আত্মহত্যার জন্য ঝুঁকিপূর্ণ ব্যক্তিকে চিহ্নিত করা যায় এবং প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিলে তাঁদের জীবন বাঁচানো যায়।

আত্মহত্যার জন্য যাঁরা ঝুঁকিপূর্ণ

  • সব সময় মৃত্যুর কথা বলেন, মৃত্যুচিন্তা করেন।
  • সরাসরি বা ঘুরিয়ে আত্মহত্যা বা মৃত্যুর কথা বলছেন।
  • আগে একা থাকতেন না কিন্তু এখন একা থাকেন, কারও সঙ্গে মেশেন না।
  • সব বিষয়ে উৎসাহ হারিয়ে ফেলেছেন
  • কান্নাকাটি করেন
  • সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে মৃত্যুর ইচ্ছা ব্যক্ত করেন
  • পুরোনো বন্ধু-স্বজনদের কাছ থেকে বিদায় নিচ্ছেন
  • আত্মহত্যাবিষয়ক ওয়েবপেজ ঘাঁটাঘাঁটি করেন
  • আত্মহত্যার উপকরণ সংগ্রহ করেন
  • যাঁরা নেশা করেন
  • কোনো নির্যাতনের শিকার হয়েছেন
  • ইদানীং বেশি বেশি রেগে যাচ্ছেন, রাস্তাঘাটে ঝুঁকিপূর্ণভাবে চলাচল করছেন
  • নিজের যত্ন নিচ্ছেন না
  • নিজের বিষয়সম্পত্তি অন্যদের বিলিয়ে দিচ্ছেন, কোনো উপযুক্ত কারণ ছাড়াই উইল করছেন
  • খুব বেশি ঘুমাচ্ছেন বা কম ঘুমাচ্ছেন
  • হাত-পা কাটাকাটি করছেন, বেশি বেশি ঘুমের ওষুধ খাচ্ছেন

কাছের মানুষেরা এসব বুঝতে পারেন। বন্ধু-স্বজনদের যা করতে হবে—

  • কারও মধ্যে আত্মহত্যার ঝুঁকিপূর্ণ আচরণ দেখা গেলে তাঁকে উপহাস করা যাবে না।
  • সব সময় বিষয়টিকে গুরুত্বের সঙ্গে নিতে হবে। ‘আরে ধুর’ বলে উড়িয়ে দেওয়া যাবে না।
  • তাঁর মনের কথা সহমর্মিতা দিয়ে শুনতে হবে।
  • প্রয়োজনে মনোরোগ বিশেষজ্ঞের সঙ্গে যোগাযোগ করিয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে। মানসিক সমস্যা বা নেশার সমস্যা থাকলে লুকিয়ে না রেখে চিকিৎসার ব্যবস্থা নিতে হবে।
  • সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে কোনো বন্ধুর এ ধরনের পোস্ট দেখা গেলে তৎক্ষণাৎ তাঁর সঙ্গে সরাসরি সাক্ষাৎ করতে হবে বা ফোনে কথা বলতে হবে। তাঁকে একা রাখা চলবে না।
  • প্রয়োজনে হাসপাতালে ভর্তি করতে হবে এবং আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী বা অভিভাবকের সাহায্য নিয়ে তাঁকে নিবৃত্ত করতে হবে।