বস, ঘুম ঠিকঠাক তো?

প্রতীকী ছবি।
প্রতীকী ছবি।

রেজাউল হকের মেজাজ বেশ তিরিক্ষি হয়ে আছে। এমনিতেই কিছুদিন ধরে রাতে ভালো ঘুম হচ্ছে না তাঁর। এর ওপর আবার অফিসের ভাইবার গ্রুপে রাত-বিরেতে টুংটাং! কালও এমন হয়েছে। নোটিফিকেশনের শব্দে কাঁচা ঘুম ভেঙে যায় রেজাউলের। সেই বিরক্তির রেশ সকালে অফিসে আসার পরও আছে। নিজে যেমন অফিসের বসের কাছে ঝাড়ি খেয়েছেন, তেমনি অধস্তন কর্মীদেরও একহাত নিয়েছেন!

প্রতিদিনের কাজে সতেজ থাকতে হলে পর্যাপ্ত ঘুম খুবই প্রয়োজন। চিকিৎসক, গবেষক—সবার সাফ কথা, কাজে উন্নতি চাইলে ঘুম ভালো হতে হবে। সম্প্রতি হার্ভার্ড বিজনেস রিভিউ এ বিষয়ে একটি নিবন্ধ প্রকাশ করেছে। তাতে বলা হয়েছে, পর্যাপ্ত ঘুম দরকার বস বা ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের। কারণ তাঁদের ঘুম ঠিকঠাক না হলে, তার প্রভাব পড়ে কচি-কাঁচাদের ওপর! ভালো ঘুম না হলে বসের মেজাজ এমনিতেই খিটখিটে থাকে। আর স্নেহের মতো মেজাজ খারাপও নিম্নগামী। তাই বাজে নেতৃত্ব ও ব্যবহারের শিকার হন অধস্তন কর্মীরা। এতে অফিসের কর্মপরিবেশ যেমন নষ্ট হয়, তেমনি সৃষ্টিশীলতাও বিঘ্নিত হয়।

সাধারণত বলা হয়ে থাকে, একজন প্রাপ্তবয়স্ক মানুষের দিনে ৮ ঘণ্টা ঘুমানো প্রয়োজন। তবে এই নিয়ম এখন আর শাশ্বত নয়। কারণ মুক্তবাজার অর্থনীতির দুনিয়ায় কাজের ধরন, কর্মঘণ্টা ও কাজের মানসিক চাপে বেশ পরিবর্তন এসেছে। অনেক ক্ষেত্রে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, দিনে ১৬ ঘণ্টা কাজে তুমুল ব্যস্ত থাকার পর ৮ ঘণ্টাতে সেই ক্লান্তি দূর করা সম্ভব না-ও হতে পারে। সেদিক থেকে যাঁরা ৮ ঘণ্টারও কম সময় ঘুমান, তাঁদের শরীর ও মনে বাজে প্রভাব পড়া খুবই স্বাভাবিক।

হার্ভার্ড বিজনেস রিভিউ-এ প্রকাশিত নিবন্ধটি লিখেছেন ক্রিস্টোফার এম বার্নস। তিনি ইউনিভার্সিটি অব ওয়াশিংটনের ফস্টার স্কুল অব বিজনেসের সহযোগী অধ্যাপক। অফিসের ব্যবস্থাপক বা নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিদের ওপর কিছু গবেষণা করেছেন তিনি ও তাঁর দল। তাতে দেখা গেছে, অপর্যাপ্ত ঘুম ব্যবস্থাপকদের কাজের গতি কমিয়ে দেয়। এটি তাঁদের আচরণেও খারাপ প্রভাব ফেলে।

সমস্যা কতটুকু গুরুতর?
২০১৭ সালে একটি আন্তর্জাতিক গবেষণা চালায় সেন্টার ফর ক্রিয়েটিভ লিডারশিপ। নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিদের মধ্যে চালানো এই গবেষণায় দেখা গেছে, অফিসের নেতাদের মধ্যে ৪২ শতাংশই ঘুমের সমস্যায় ভোগেন। তাঁরা রাতে সাধারণত ছয় ঘণ্টা বা তারও কম সময় চোখ বুঁজে থাকেন।

মানুষের মস্তিষ্কে স্মৃতি সংরক্ষণের সঙ্গে ঘুমের বিষয়টি ওতপ্রোতভাবে জড়িত। হার্ভার্ড বিজনেস রিভিউ বলছে, স্মৃতি সংরক্ষণ ও সংহত করতে সাহায্য করে ঘুম। এ ছাড়া আবেগময় অভিজ্ঞতা প্রক্রিয়াজাত করা, মস্তিষ্কে গ্লুকোজের (এটিই মস্তিষ্কে শক্তির জোগান দেয়) সরবরাহ ঠিক রাখা এবং বিটা-অ্যামিলয়েড নামক বর্জ্য পদার্থ নিষ্কাশনে সাহায্য করে পর্যাপ্ত ঘুম। অন্যদিকে অপর্যাপ্ত ঘুমের কারণে মানুষের বিচার-বিশ্লেষণের ক্ষমতা হ্রাস পায়, সৃষ্টিশীলতা নষ্ট হয় এবং আত্মনিয়ন্ত্রণ কমে যায়।

ক্রিস্টোফার এম বার্নস বলছেন, তাঁর দলের চালানো গবেষণায় দেখা গেছে, অপর্যাপ্ত ঘুমে শুধু যে ব্যক্তির ক্ষতি হয়, তা নয়। যখন ব্যবস্থাপকদের ঘুম কম হয়, তখন তাঁদের কর্মীরা বাজে অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হন এবং কাজের মানও নেমে যায়।

গবেষকেরা বলছেন, অপর্যাপ্ত ঘুমের কারণে কর্মীদের ওপর প্রায়ই মেজাজ হারান কর্তাব্যক্তিরা। কিছু ক্ষেত্রে অধস্তন কর্মীদের সঙ্গে অনৈতিক আচরণের ঘটনাও ঘটে। সম্প্রতি ৪০ জন ব্যবস্থাপক ও তাঁদের অধীন ১২০ জন কর্মীর ওপর গবেষণা চালান ক্রিস্টোফার এম বার্নস ও ক্রিস্টিয়ানো গুয়ারানা। তিন মাসের এই গবেষণায় দেখা গেছে, অল্প ঘুমানো নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিরা খুব অধৈর্য, বিরক্তিকর ও বৈরী স্বভাবের হয়ে থাকেন। আর এসব কারণেই কর্মীদের সঙ্গে তাঁদের পারস্পরিক সম্পর্ক খারাপ হয়। কিন্তু বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই নিজেদের এই সমস্যা সম্পর্কে কর্তাব্যক্তিরা সচেতন নন।

অন্যদিকে অপর্যাপ্ত ঘুমের কারণে বসদের মধ্যে ইতিবাচক মনোভাবের অভাব দেখা দেয়। এতে করে কর্মীদের অনুপ্রেরণা দেওয়ার ক্ষমতা কমে যায়। কর্তা যদি কর্মীকে প্রেরণাই দিতে না পারেন, তবে আর কাজ ভালো হবে কীভাবে? আবার কাজ ভালো না হলেও ঝাড়ি খান কর্মীরাই! কিন্তু এর কারণ যে বস তৈরি করছেন, সেদিকে কারও দৃষ্টি নেই।

২০১৬ সালের এক পরীক্ষায় দেখা গেছে, কর্তাব্যক্তি যদি ইতিবাচক থাকেন, তবে তাঁর অধস্তন কর্মীরা কাজে উৎসাহী হোন। এতে করে কাজের পরিমাণ এবং মান, দুইই ভালো থাকে। অন্যদিকে বস ক্যারিশমাটিক হন তখনই, যখন কর্মীর সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক শ্রদ্ধাপূর্ণ হয়। আর এ জন্যই ঘুম উপকারী—তা কর্মী বা বস, যিনিই হোন না কেন!

প্রতীকী ছবি।
প্রতীকী ছবি।

সমাধান কী?
প্রথমেই নেতৃত্বস্থানীয় ব্যক্তিদের ঘুমের পরিমাণ ও মান বাড়াতে হবে। অর্থাৎ ভালো ঘুম দরকার বেশি সময় ধরে। ঘুমানো ও ঘুম থেকে ওঠার জন্য একটি সুনির্দিষ্ট সময় বেছে নেওয়া যেতে পারে। কমিয়ে দিতে হবে চা-কফি পানের পরিমাণ। ভালো ঘুমের জন্য পরিমিত ব্যায়াম বেশ কাজে দেয়। তবে ঘুমানোর আগে আবার ব্যায়াম করতে যাবেন না যেন। এতে উল্টো ফল হতে পারে।

ক্রিস্টোফার এম বার্নস বলছেন, বর্তমানের স্মার্টফোনের অতিরিক্ত ব্যবহারও ঘুমের জন্য অপকারী। এ জন্য রাতে স্মার্টফোনের দিকে তাকিয়ে থাকার সময় কমিয়ে আনতে হবে। নিজের ঘুমে কোনো সমস্যা আছে কি না, সেই বিষয়ে ওয়াকিবহাল হতে হবে অফিসের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের। এ ব্যাপারে চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়াও গুরুত্বপূর্ণ।

গবেষকেরা বলছেন, কাজের ফাঁকে ছোট ছোট মেয়াদে ঘুমিয়ে নিলে, তা কাজের ক্ষেত্রে উপকারী প্রভাব রাখে। ইংরেজিতে একে ‘ন্যাপিং’ বলা হয়। একটি গবেষণায় দেখা গেছে, দিনের বেলা আট মিনিটের ছোট্ট ঘুমও স্মৃতিশক্তি বাড়াতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে যথেষ্ট।

পর্যাপ্ত ঘুম কাজে কী প্রভাব রাখে, তা বুঝতে আমাজনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা জেফ বেজোসের একটি বক্তব্য শুনে নিন। তিনি বলেছেন, ‘আট ঘণ্টার ঘুম আমার মধ্যে ব্যাপক পরিবর্তন নিয়ে এসেছে। ঘুমের সময় কমিয়ে হয়তো কাজের কিছু অতিরিক্ত সময় পাবেন। কিন্তু ওই সময়ের কাজ বিভ্রান্তি মাত্র। অসংখ্য সিদ্ধান্তের তুলনায় অল্পসংখ্যক গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নেওয়া বেশি কার্যকর।’

বসের মেজাজ সামলাবেন যেভাবে
অফিসের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা মেজাজ দেখালে পরিস্থিতি ঠান্ডা করতে কিছু কৌশল অবলম্বন করা যেতে পারে। ক্যারিয়ার-বিষয়ক ওয়েবসাইট দ্য মুজে বলছে, বসের খিটখিটে মেজাজের শিকার হলে এমন ব্যবহারের পেছনের কারণ সম্পর্কে প্রথমে বোঝার চেষ্টা করতে হবে। এরপর ধীরে ধীরে সমাধানের দিকে এগোতে হবে। এ ক্ষেত্রে নিচের কৌশলগুলো কাজে দিতে পারে:

১. আপনার বস আসলেই খারাপ স্বভাবের কি না, তা নিশ্চিত হওয়ার চেষ্টা করুন।
২. বসের উদ্দেশ্য কী, সেটি বোঝার চেষ্টা করুন। এমনও হতে পারে, ঝিকে মেরে বউকে শেখানোর জন্য ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা আপনাকে বলির পাঁঠা বানিয়েছেন।
৩. বসের মেজাজের গতিপ্রকৃতি বুঝতে পারলে তাঁর চেয়ে এক ধাপ এগিয়ে থাকার চেষ্টা করতে পারেন। অর্থাৎ আগেভাগেই কিছু কাজ করে রাখা, যাতে বস চোখ রাঙানোর সুযোগ না পান।
৪. বস অযোগ্য হলে, নিজে নেতা হওয়ার পথে এগিয়ে যান।
৫. বসের খিটখিটে মেজাজ যেন কাজের মানে প্রভাব না ফেলে, তা নিশ্চিত করতে হবে। কারণ দিন শেষে নিজের খারাপ মানের কাজের জন্য আপনাকেই জবাবদিহি করতে হবে।