দিন কেটে যায় ঐতিহাসিক স্থানে ঘুরে

দৃষ্টিনন্দন শাহ মাহমুদ মসজিদ। এগারসিন্দুর, পাকুন্দিয়া, কিশোরগঞ্জ। ছবি: লেখক
দৃষ্টিনন্দন শাহ মাহমুদ মসজিদ। এগারসিন্দুর, পাকুন্দিয়া, কিশোরগঞ্জ। ছবি: লেখক

ভ্রমণের অভ্যাসটা পুরোনো। কিন্তু জীবনের ব্যস্ততায় সেই অভ্যাসকে আর আগের মতো ধরে রাখা যায়নি। বরং রুটিরুজির তাগিদে অভ্যাসকে ছুটি দিতে হয়েছে।

সাবেক সহকর্মী ও বর্তমানে ব্যাংক কর্মকর্তা সোহেলুর রহমান সম্প্রতি ফেসবুকের ইনবক্সে জানালেন, সদলবলে ঘুরতে যেতে চান কিশোরগঞ্জে। উদ্দেশ্য—সেখানকার ঐতিহাসিক স্থাপনা ও হাওর-বাঁওড় ঘুরে দেখা।

সোহেলুরের প্রস্তাবে রাজি হয়ে যাই। ১০-১২ জন মিলে ভ্রমণে যাওয়ার পরিকল্পনা করি। শেষ পর্যন্ত এই ভ্রমণযাত্রায় পাঁচজনকে পাওয়া গেল। ভ্রমণ দলের অন্য তিন সদস্য হলেন তানজিল রিমন, আবু আজাদ ও মিঠু হালদার। তাঁরা সবাই চাকরিজীবী।

পরিকল্পনা অনুযায়ী, গত ২১ সেপ্টেম্বর ছুটির দিনে ঢাকার মহাখালী বাস টার্মিনাল থেকে সকাল সাড়ে ছয়টার দিকে আমাদের যাত্রা শুরু হয়। বাস যখন গাজীপুর ছাড়িয়ে রাজেন্দ্রপুর সেনানিবাসের ভেতর দিয়ে চলতে শুরু করল, কেবল তখনই মনে হলো আমরা ভ্রমণে বেরিয়েছি। কারণ, এ পর্যন্ত যানজটে থেমে থেমে বাস চলছিল। এবার উঁচু–নিচু সড়কে হালকা দুলুনি দিয়ে কাপাসিয়ার দিকে বাস চলতে থাকে। সড়কের দুধারে গাছপালায় ঠাসা গাঢ় সবুজ। মনে হলো যেন বনের ভেতর দিয়ে এঁকেবেঁকে চলে গেছে পাহাড়ি পিচঢালা পথ। বাসের খোলা জানালা দিয়ে হাওয়া এসে আমাদের চোখে–মুখে লাগছে। ওড়াচ্ছে মাথার চুল। চলছে খোশগল্প। এভাবে প্রায় ১০০ কিলোমিটার দূরত্বের গন্তব্যে পৌঁছাতে আমাদের লেগে গেল চার ঘণ্টার মতো।

ঐতিহাসিক স্থাপনাগুলোর দিকনির্দেশনা বোর্ড। থানাঘাট মোড়, পাকুন্দিয়া, কিশোরগঞ্জ।
ঐতিহাসিক স্থাপনাগুলোর দিকনির্দেশনা বোর্ড। থানাঘাট মোড়, পাকুন্দিয়া, কিশোরগঞ্জ।

কিশোরগঞ্জের পাকুন্দিয়া উপজেলায় থানাঘাট মোড়ে বাস থেকে নেমেই চোখে পড়ল ঐতিহাসিক স্থাপনাগুলোর ছবিসহ দিকনির্দেশনার বোর্ড। একনজরে নির্দেশনা দেখে নিলাম। স্থানীয় লোকদের সঙ্গে কথা বলে ব্যাটারিচালিত অটোরিকশায় করে রওনা হলাম এক কিলোমিটার দূরত্বের এগারসিন্দুর গ্রামে অবস্থিত ঈশা খাঁর দুর্গের উদ্দেশে। গন্তব্যে পৌঁছে দেখলাম, পিচঢালা রাস্তা থেকে একটু দূরে গাছপালার আড়ালে দাঁড়িয়ে প্রায় ৫০ ফুট উঁচু ঈশা খাঁর দুর্গ। দুর্গটি ঘাস আর তরুলতায় বেষ্টিত। দুর্গের তথ্যসংবলিত কোনো সাইনবোর্ড সেখানে চোখে পড়ল না। দুর্গের প্রতি কর্তৃপক্ষের অবহেলা স্পষ্ট। দেখে মনেই হয় না, এটা কোনো দুর্গ।

ঈশা খাঁর দুর্গ। এগারসিন্দুর, পাকুন্দিয়া, কিশোরগঞ্জ।
ঈশা খাঁর দুর্গ। এগারসিন্দুর, পাকুন্দিয়া, কিশোরগঞ্জ।

স্থানীয় লোকজন জানালেন, আগে এই দুর্গ আরও উঁচু ছিল। কিন্তু ভারী বৃষ্টি ও ঢলে দুর্গের উচ্চতা ক্রমেই কমে আসছে। দুর্গ রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্বে কেউ নেই। প্রকৃতিই যেন দুর্গটির অভিভাবক।

গ্রামবাসী জানালেন, পাশেই আছে পুরোনো মসজিদ। দিকনির্দেশনা নিয়ে মসজিদের সন্ধানে আমাদের হাঁটা শুরু হলো। মিনিট সাতেক হাঁটার পর আমরা আবিষ্কার করলাম ঐতিহাসিক এগারসিন্দুর শেখ সাদী জামে মসজিদ। গ্রামের ভেতরের পিচঢালা পথ থেকে মসজিদের একাংশ দেখা যায়। মসজিদের বাকি অংশ কলাগাছসহ অন্যান্য গাছের আড়ালে ঢাকা পড়ে আছে। পাশে একটি সাইনবোর্ড দেখে মনে হলো, মসজিদটি প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের নজরে আছে। মসজিদের দেয়াল, মেঝে ও গম্বুজে প্রাচীন স্থাপত্যের নিদর্শন স্পষ্ট। মুঘল সম্রাট শাহজাহানের শাসনামলে মসজিদটি নির্মাণ করা হয়। ১৬৫১ সালে জনৈক শাইখ সাদী মসজিদটি নির্মাণ করেন।

এগারসিন্দুর শেখ সাদী জামে মসজিদ। পাকুন্দিয়া, কিশোরগঞ্জ।
এগারসিন্দুর শেখ সাদী জামে মসজিদ। পাকুন্দিয়া, কিশোরগঞ্জ।

স্থানীয় বাসিন্দা নুরুল ইসলাম পাশের গ্রামের আরও একটি প্রাচীন মসজিদ দেখার পরামর্শ দিলেন। প্রায় ১৫ মিনিট হেঁটে চলে গেলাম আরেক ঐতিহাসিক নিদর্শন শাহ মাহমুদ মসজিদ ও বালাখানায়। সাদী মসজিদের তুলনায় এই মসজিদের নির্মাণশৈলী চমৎকার।

প্রাচীন স্থাপত্যশিল্পের নিদর্শন এগারসিন্দুর শেখ সাদী জামে মসজিদ। পাকুন্দিয়া, কিশোরগঞ্জ।
প্রাচীন স্থাপত্যশিল্পের নিদর্শন এগারসিন্দুর শেখ সাদী জামে মসজিদ। পাকুন্দিয়া, কিশোরগঞ্জ।

পাকা রাস্তার পর কিছুটা কাঁচা রাস্তা ধরে এগোলে হাতের ডানে বড় পুকুর। আর বাঁ পাশে বালাখানা ও শাহ মাহমুদ মসজিদ। অজু করার জন্য পুকুরে আছে শানবাঁধানো ঘাট। মুসল্লিরা এখানে অজু করে রাস্তার সঙ্গে লাগোয়া বালাখানার ভেতর দিয়ে প্রবেশ করেন প্লাস্টার করা মসজিদ প্রাঙ্গণে। সুবেদার শায়েস্তা খাঁর আমলে ১৬৬৪ খ্রিষ্টাব্দে তৎকালীন বিশিষ্ট ব্যবসায়ী শাহ মাহমুদ নিজের নামে মসজিদটি প্রতিষ্ঠা করেন।

শাহ মাহমুদ মসজিদ ও বালাখানা। এগারসিন্দুর, পাকুন্দিয়া, কিশোরগঞ্জ।
শাহ মাহমুদ মসজিদ ও বালাখানা। এগারসিন্দুর, পাকুন্দিয়া, কিশোরগঞ্জ।

প্রবেশপথে দোচালা পাকা ঘর। এটার নামই বালাখানা। মসজিদের ভেতর-বাহির সুলতানি আমলের চিত্রফলকে অলংকৃত। বর্গাকৃতির নির্মাণশৈলীর মসজিদটি এক গম্বুজবিশিষ্ট। চার কোনায় চারটি আট কোনাকৃতির মিনার রয়েছে। পশ্চিমের দেয়ালে আছে তিনটি মেহরাব। নির্মাণশৈলীর নান্দনিক কারুকাজ দেখতে দেখতে দুপুর প্রায় ১২টা ছুঁই ছুঁই। তখন মনে পড়ল, ঘুম থেকে তড়িঘড়ি করে বাসে ওঠায় পেটে দানাপানি কিছু পড়েনি। পরে স্থানীয় মঠখালী বাজারে গিয়ে একটি রেস্তোরাঁয় খাবার শেষ করলাম। খাবার মেন্যুতে ছিল হাওরাঞ্চলের শিং মাছ, চিংড়ি মাছসহ নানা পদ। তবে মুখে লেগে থাকল শিং মাছের তরকারি ও চিংড়ি ভর্তার লোভনীয় স্বাদ। সফরসঙ্গী তানজিল রিমন বললেন, শিং মাছ দিয়ে তিনি আরও এক প্লেট ভাত খেতে পারতেন। কিন্তু ভ্রমণে আছেন বলেই ঝুঁকি নিলেন না। খাবার শেষে স্থানীয় কারিগরদের তৈরি মিষ্টি আমাদের বাড়তি রসনার চাহিদা মিটিয়েছে।

দৃষ্টিনন্দন শাহ মাহমুদ মসজিদ। এগারসিন্দুর, পাকুন্দিয়া, কিশোরগঞ্জ।
দৃষ্টিনন্দন শাহ মাহমুদ মসজিদ। এগারসিন্দুর, পাকুন্দিয়া, কিশোরগঞ্জ।

আরও কিছু পর্যটনকেন্দ্র দেখা বাকি। তাই সময়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে মঠখালী বাজার থেকে সিএনজিচালিত অটোরিকশা করে পৌঁছে গেলাম প্রায় ২০ কিলোমিটার দূরে কিশোরগঞ্জ সদরে। সেখানে অপেক্ষায় থাকা স্থানীয় বাসিন্দা ও আরেক সহকর্মী টিটু দাস আমাদের স্বাগত জানালেন। তাঁর পীড়াপীড়িতে রেস্তোরাঁয় ফের হালকা কিছু খেতে হলো। টিটু দাসকে সঙ্গে নিয়ে আমরা চলে গেলাম বাংলা সাহিত্যের প্রথম নারী কবি চন্দ্রাবতীর স্মৃতিবিজড়িত পাতোয়াইর গ্রামে। কিশোরগঞ্জ শহর থেকে প্রায় পাঁচ কিলোমিটার দূরে এই গ্রামে দুটি শিবমন্দির বা মঠ রয়েছে, যা চন্দ্রাবতীর মঠ হিসেবে পরিচিত। মঠ দুটির দরজা বন্ধ। বাইরে থেকে মঠের সৌন্দর্য উপভোগ করতে হয়। দুটি মঠের মধ্যে একটি অপেক্ষাকৃত ছোট। এখানে একসময় ফুলেশ্বরী নদী ছিল। কালের বিবর্তনে তা হারিয়ে গেছে।

বাংলা সাহিত্যের প্রথম নারী কবি চন্দ্রাবতীর স্মৃতিবিজড়িত স্থান। চন্দ্রাবতীর মঠ, পাতোয়াইর গ্রাম, কিশোরগঞ্জ।
বাংলা সাহিত্যের প্রথম নারী কবি চন্দ্রাবতীর স্মৃতিবিজড়িত স্থান। চন্দ্রাবতীর মঠ, পাতোয়াইর গ্রাম, কিশোরগঞ্জ।

মধ্যযুগের কবি চন্দ্রাবতী ছিলেন ‘মনসামঙ্গল’–এর অন্যতম কবি দ্বিজ বংশীদাসের কন্যা। তাঁর জন্ম ১৫৫০ সালে বলে ধারণা করা হয়। রূপসী চন্দ্রাবতী একই গ্রামের যুবক জয়চন্দ্রের প্রতি প্রণয়াসক্ত ছিলেন। কিন্তু জয়চন্দ্র মুসলিম এক নারীর প্রেমে আসক্ত হয়ে নিজেও ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেন। প্রেমের ব্যর্থতা ভুলতে ফুলেশ্বরী নদীর তীরে বাবার নির্মিত শিবমন্দিরে শিবের আরাধনায় মগ্ন হন চন্দ্রাবতী। মঠ দুটির পাশে ৩৮ নম্বর চন্দ্রাবতী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়।

স্থানীয় জমিদার নীলকণ্ঠের বাড়ি। পাতোয়াইর গ্রাম, কিশোরগঞ্জ।
স্থানীয় জমিদার নীলকণ্ঠের বাড়ি। পাতোয়াইর গ্রাম, কিশোরগঞ্জ।

বিদ্যালয় লাগোয়া রাস্তার পাশে জরাজীর্ণ অবস্থায় দেখা গেল বিশাল এক দোতলা ভবন। এটি স্থানীয় জমিদার নীলকণ্ঠের বাড়ি ছিল বলে জানা যায়। দোতলা ভবনটির দু-একটি কক্ষ এখনো ব্যবহৃত হয় বলে জানালেন স্থানীয় বাসিন্দা নজরুল ইসলাম।

কিশোরগঞ্জ শহরের অদূরে দেশের সবচেয়ে বড় ঈদ জামাতের স্থান শোলাকিয়া ময়দান। বিশাল এই ময়দান দেখার সুযোগ আমরা হাত ছাড়া করিনি। এমন ঐতিহাসিক নানা স্থান ঘুরে দিন প্রায় কেটে যায়।

দেশের সবচেয়ে বড় ঈদের জামাত অনুষ্ঠিত হয় এই মাঠে। শোলাকিয়া, কিশোরগঞ্জ।
দেশের সবচেয়ে বড় ঈদের জামাত অনুষ্ঠিত হয় এই মাঠে। শোলাকিয়া, কিশোরগঞ্জ।

এক দিনের সফর হওয়ায় ঢাকায় ফেরার তাড়া ছিল। হাতে সময় থাকলে শালংকা মসজিদ, হর্ষি শাহী মসজিদ, পাঁচ পীরের মাজার, অধিকারী মঠ, বেবুদ রাজার দিঘি, আংটি চোরার বিল, নীলকুঠিসহ কিশোরগঞ্জের অন্য ঐতিহাসিক স্থানগুলো ঘুরে দেখা যেত। এলাকাটির সব ঐতিহাসিক স্থান ঘুরে হাওরের জলে গা ভিজিয়ে ঘরে ফেরার জন্য অন্তত দুই দিনের সফরে যাওয়া উচিত। সেটা হয়নি বলে কিছুটা আফসোস নিয়ে ঢাকার পথে ফিরতে হলো।

যেভাবে যাবেন
ঢাকার মহাখালী বাস টার্মিনাল থেকে অনন্যা ও অনন্যা ক্ল্যাসিক নামে দুটি বাস সার্ভিস চালু আছে। প্রথমটি লোকাল, দ্বিতীয়টি সিটিং সার্ভিস। ঢাকা থেকে কিশোরগঞ্জের পাকুন্দিয়ার থানাঘাট মোড় পর্যন্ত অনন্যা ক্ল্যাসিকের ভাড়া জনপ্রতি ১৫০ টাকা। অনন্যার ভাড়া ১০০ টাকা। প্রতি ১৫ থেকে ২০ মিনিট পরপর গাড়ি ছাড়ে।

রাতে থাকার ব্যবস্থা
কিশোরগঞ্জ শহরে বিভিন্ন মান ও দামের আবাসিক হোটেল আছে। বিলাসবহুল হোটেলের মধ্যে রয়েছে ক্যাসেল সালাম ও উজান ভাটি। উজান ভাটির এসি কক্ষের প্রতি রাতে ডাবল বেডের ভাড়া ১ হাজার ২০০ টাকা। নন–এসির ভাড়া ৮০০ টাকা। এ ছাড়া গাঙচিল, রিভারভিউ, নিরালা, আল মোবারকসহ বিভিন্ন আবাসিক হোটেল আছে। এসব হোটেলের সিঙ্গেল বেডে রাত্রিযাপনের খরচ ন্যূনতম ২৫০ টাকা, ডাবল বেডে ৩৫০ টাকা।