অর্ধেক কথা পেটে, অর্ধেক মুখে

মনের ভেতরের কথা সরাসরি বলে ফেললে অনেক সমস্যা এড়ানো যায়। মডেল: প্রমি ও নীল, ছবি: সুমন ইউসুফ
মনের ভেতরের কথা সরাসরি বলে ফেললে অনেক সমস্যা এড়ানো যায়। মডেল: প্রমি ও নীল, ছবি: সুমন ইউসুফ
>লজ্জা, অস্বস্তি বা সাহসের অভাব অনেক বিষয়কে জটিল করে তোলে। সরাসরি কথা বলায় অনেক সমস্যার সহজ সমাধান হয়ে যায়। চাকরিজীবনে এ ধরনের দ্বন্দ্ব মোকাবিলা করতে না পেরে চাকরি ছেড়ে দিতে হয়েছে এমন ঘটনাও ঘটে।

বলা হয় কথায় কথা বাড়ে, তবে কিছু কিছু ক্ষেত্রে অকপট স্বীকারোক্তিতে দ্বন্দ্বের আগুন নেভানো যায়। সমাজে সব মানুষ এক হতে পারে না, জীবনের নানা ক্ষেত্রেই একজনের সঙ্গে আরেকজনের মতের অমিল হবে, এটাই বাস্তবতা। এসব ক্ষেত্রে আলোচনা, ধৈর্য ধরে কথা শোনার মানসিকতা জটিল পরিস্থিতিকে সহজ করে তুলতে পারে।

অনেক সময় দেখা যায়, কেউ একজনের ওপর কিছু চাপিয়ে দিচ্ছেন বা নতুন দায়িত্ব দিচ্ছেন। হয়তোবা তিনি সহজভাবে সেটা দিয়েছেন। কিন্তু ওই কাজ বা দায়িত্ব যাঁর ওপর দেওয়া হচ্ছে তিনি তা নিতে চাইছেন না। সরাসরি বা ‘চক্ষুলজ্জার’ কারণে নিজের মতামতটা জানাতে পারছেন না। সরাসরি বলতে না পেরে মনে মনে ফুঁসছেন। বিষয়টি নিয়ে তৃতীয় এমন কাউকে জানাচ্ছেন, যাতে পরিস্থিতি আরও জটিল হয়ে উঠছে। অথচ বিষয়টি জটিলই হতো না, যদি তিনি সরাসরি তাঁর অপারগতা জানিয়ে দিতে পারতেন। খুব সহজে সমাধানযোগ্য বিষয়কে শুধু সরাসরি না বলতে পারার কারণে জটিল করে তোলেন অনেকে।

বিয়ের পাঁচ বছরের মধ্যে কখনো বাবার বাড়িতে ঈদ করেননি সীমা (ছদ্মনাম)। প্রতিবারই স্বামী রাশেদ (ছদ্মনাম) তাঁর কাছে জানতে চান ‘কোথায় ঈদ করতে চাও?’। তিনি জবাব দেন, ‘তোমার ইচ্ছে’। রাশেদও ঝটপট বলেন, ‘তাহলে ঈদের দিন এ বাসায় থাকি, ঈদের পরের দিন তোমাদের বাসায় যাব।’ রাশেদের এই সিদ্ধান্ত খুব একটা পছন্দ না হলেও নিজের ইচ্ছেটা কোনো দিন জানাননি সীমা। স্বামীর সিদ্ধান্ত মেনে নিয়ে প্রতিবছর শ্বশুরবাড়িতে ঈদ করেন ঠিকই, তবে মনের মধ্যে পুষে রাখা ক্ষোভের কারণে উৎসবের আনন্দ যথাযথভাবে উপভোগ করতে পারেন না। বাবা–মাকে তিনি বলেন, ‘রাশেদ পছন্দ করে না ঈদের দিন বাইরে থাকি।’

 এই সামান্য দ্বন্দ্ব তাঁদের ছোট সংসারে কিছুটা হলেও ছন্দপতন ঘটায়। হয়তো মনের ইচ্ছেটা জানালে রাশেদ সেটাকে সমর্থন ও সম্মান করতেন। আলোচনার এই ফাঁকটুকু তৈরি করে মনের ব্যবধান। স্বর্ণা-মঈন (ছদ্মনাম) দম্পতির বেশ কয়েকজন বন্ধু আছেন, যাঁরা দুজনেরই বন্ধু। প্রায়ই সবাই মিলে আড্ডা দেন। উঠে আসে সংসারের নানা কাহিনি। স্বর্ণা প্রায়ই মঈনের নানা ধরনের দোষ তুলে ধরেন বন্ধুদের কাছে। কথাগুলো মজার ছলে বলা হলেও এটা ভালো লাগে না মঈনের। তবে অসন্তুষ্টির এই জায়গাটা নিয়ে স্বর্ণাকে সরাসরি কখনোই কিছু বলেন না তিনি। তবে বন্ধুদের কাছে স্ত্রীর এই বিষয়টি নিয়ে ঠিকই অসন্তোষ প্রকাশ করেন।

সংসার জীবনে এমন দ্বন্দ্ব প্রায়ই তৈরি হয়। একটি সংসার তৈরি করে অসংখ্য সম্পর্ক। খুঁটিনাটি ছোটখাটো অনেক অমিল নিয়ে মনের মধ্যে সংকট তৈরি হয়। বড় কিছু নিয়ে হয়ে যায় তুলকালাম। বিয়ের পর পর রান্না করতেন না রত্না। রান্না করতে গেলেই শাশুড়ি জাহানারা বলতেন, ‘না মা তোমার রান্না করতে হবে না। আমি আছি।’ রত্নাও ভাবতেন, শাশুড়ি হয়তো চান না রান্নাঘরের কর্তৃত্ব হারাতে। ওদিকে জাহানারা ভাবেন, বউ তো জোর করেও তাঁর হাত থেকে রান্নার হালটা ধরতে পারে। মনের এই কথা মেয়ে পুতুলকে জানান তিনি। পুতুলও সবাইকে বলে বেড়ায়, ভাবি কোনো রান্নাবান্না করেন না। একসময় অন্য এক আত্মীয় এ কথা বলে দেন রত্নাকে। ঘটনাটি জানতে পেরে রীতিমতো অসহায় বোধ করা শুরু করেন। শাশুড়ির সঙ্গে তাঁর চমৎকার একটি সম্পর্ক ছিল বলে এত দিন গর্ব করতেন, এ ঘটনায় সেই সম্পর্কে তৈরি হয় ফাটল। বারবারই তাঁর মনে হচ্ছিল, ‘মা তো কথাটি আমাকে বললেই পারতেন!’

লজ্জা, অস্বস্তি বা সাহসের অভাব অনেক বিষয়কে জটিল করে তোলে। সরাসরি কথা বলায় অনেক সমস্যার সহজ সমাধান হয়ে যায়। চাকরিজীবনে এ ধরনের দ্বন্দ্ব মোকাবিলা করতে না পেরে চাকরি ছেড়ে দিতে হয়েছে এমন ঘটনাও ঘটে। টেলিভিশন মিডিয়ায় চাকরি করতেন ফারহান। বিজনেস রিপোর্টিংয়ে কাজ করতেন। বেশ স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করতেন তিনি এই কাজে। একদিন বস জানালেন, ডেস্কে কাজ করতে হবে তাঁকে। বসকে না করতে সাহসে কুলায় না, কিন্তু এই সিদ্ধান্ত মেনেও নিতে পারেন না তিনি। অন্য সহকর্মীদের ক্ষোভের কথা বলেন। কিন্তু বসকেই কিছু বলেন না। একসময় চাকরি ছেড়ে চলে যান। বস জানতেও পারেননি কেন বা কোন ক্ষোভ থেকে তিনি চাকরিটা ছেড়ে দিলেন।

বেসরকারি একটি ব্যাংকে চাকরি করেন পৃথুলা রহমান। তিনি জানালেন, মাতৃত্বকালীন ছুটির পর যখন অফিস করা শুরু করেন, খুব সমস্যা হচ্ছিল তাঁর। বাচ্চাটা প্রায়ই অসুস্থ থাকত। তাঁকে প্রায়ই অফিস থেকে তাড়াতাড়ি বের হতে হতো। সন্ধ্যায় তাঁর দায়িত্ব বেশির ভাগ সময় সহকর্মী ছন্দাকে বুঝিয়ে বের হতেন তিনি। ছন্দা সব সময় বলতেন, ‘আপু আপনি চলে যান আমি ম্যানেজ করে নেব। বাবুকে সময় দেন।’ পৃথুলা নিশ্চিত হয়ে চলে যেতেন। তবে বাড়তি কাজের এই চাপ নিতে পারছিলেন না ছন্দা। অন্য সহকর্মীদের কাছে বিষয়টি শেয়ার করেন। এক কান দুই কান হয়ে কথাটা যায় বসের কানে। পৃথুলাকে কারণ দর্শানোর নোটিশ দেওয়া হয়। পরে পুরো বিষয় জানতে পেরে ছন্দার ব্যবহারে কষ্ট পাওয়ার চেয়ে বিস্মিত হন পৃথুলা। তাঁর মনে হচ্ছিল, ছন্দা সানন্দেই রাজি হয়েছেন। ও না করতে চাইলে তিনি অন্য কাউকে দায়িত্ব দিতে পারতেন অথবা আগে বাড়ি না গিয়ে নিজে কাজ শেষ করেই যেতেন।

আসলে সম্পর্ক যেটাই হোক না সেই সম্পর্কে বোঝাপড়া থাকাটা অত্যন্ত জরুরি। আলোচনায় দুঃখ–যন্ত্রণার ভার কমে, সমাধান আসে। নিজের অধিকারগুলো রক্ষা করতে নিজেকেই দৃঢ় হতে হয়। অন্যের অধিকারে আঘাত না করেও ব্যক্তিগত অধিকারগুলোকে রক্ষা করা যায়। সামাজিক দক্ষতার মতো নিজের অধিকারের সুরক্ষার দক্ষতাও জরুরি। একদিক থেকে দেখলে এ রকম দক্ষতা হলো নিজেকে প্রমাণ করতে শেখার দক্ষতা। যখন দরকার তখন সাহায্য চাইতে শেখা, কেউ অন্যায় দাবি করলে ‘না’ বলতে শেখা। কোনো বিষয়ে বুঝতে অসুবিধা হলে বা বিরক্ত হলে সরাসরি বলা, নিজের সম্পর্কে অন্যের বিরূপ মন্তব্য বা প্রতিক্রিয়া মাথা ঠান্ডা রেখে শুনতে শেখা, অন্যের প্রতিক্রিয়া বিচার-বিবেচনা করে বিশ্লেষণ করাও একধরনের শিক্ষা।

এ বিষয়ে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোবিজ্ঞান বিভাগের সহকারী অধ্যাপক তানজির আহম্মদ বলেন, ‘অনেক সময় দেখা যায়, কেউ কিছু চাপিয়ে দিচ্ছে বা নতুন দায়িত্ব দিচ্ছে। হয়তো ওই কাজটা বা দায়িত্ব আমরা নিতে চাইছি না। কিন্তু সঠিক জায়গায়, সঠিক সময়ে বা সঠিক ব্যক্তিকে নিজের মতামতটা জানাচ্ছি না। এটাকে বলে ল্যাক অব অ্যাসারটিভনেস। যেটাকে দৃঢ়তার অভাব বলা যায়। এর কারণে মানুষ নিজস্ব মতামত সরাসরি, খোলাখুলিভাবে বা সৎভাবে প্রকাশ করতে পারে না। যা উচিত তা করতে পারে না, অনুরোধ, অধিকার নিশ্চিত করতে পারে না। কিন্তু কষ্ট পায়। যা ব্যক্তিগত, পারিবারিক কর্মক্ষেত্র সবদিক থেকেই ওই মানুষকে পেছনে ফেলে দেয়। বিভ্রান্তি তৈরি হয়। পরে দেখা যায়, ভুল জায়গায় মনের কথা বলা হয়ে যায়।’

এসব ক্ষেত্রে কী সমাধান হতে পারে? তানজির আহম্মদ বলেন, কারণটা যেখানে সমাধানও সেখানে। জানার সঙ্গে সঙ্গে অনুশীলনের প্রয়োজন। যেটা তিনি মনে মনে ভাবছেন তা বলা উচিত, যেটা তিনি পাওয়ার অধিকার রাখেন মনে করছেন সেটা জানানো উচিত। এ ধরনের মতামত প্রকাশের অনুশীলন করতে হবে। ভয়, দ্বিধা, শঙ্কা কাটিয়ে সাহস করে নিজের অধিকার বা চাওয়াটাকে তুলে ধরতে হবে। শুধু কষ্ট পেলে চলবে না। অনেক ক্ষেত্রে কারও কারও পক্ষে একদমই সম্ভব হয় না মতামত প্রকাশ করার, এমন অবস্থায় প্রশিক্ষণ নিতে পারেন, কাউন্সেলিং নিতে পারেন। মনে রাখতে হবে এটাও সামাজিক দক্ষতার একটি অংশ।