দায়িত্ব নিতে হবে ওদেরও

ছোট থেকেই সন্তানকে একটু একটু করে দায়িত্ব নিতে শেখান। ছবি: প্র অধুনা
ছোট থেকেই সন্তানকে একটু একটু করে দায়িত্ব নিতে শেখান। ছবি: প্র অধুনা

‘আহা, ও ছোট মানুষ। ওকে কোনো কাজ দিয়ো না’ অথবা ‘এতগুলো কাজের মানুষ থাকতে আমার আদরের মেয়ে কেন কাজ করবে?’ সন্তানের প্রতি স্নেহের বশবর্তী হয়ে বাবা-মায়েরা প্রায়ই মনে করেন যে তাদের কোনো কাজই দেওয়া যাবে না—তুলোয় মুড়ে মুড়ে বড় করতে হবে। এটা করতে গিয়ে প্রকারান্তরে সন্তানের মনোসামাজিক বিকাশে তাঁরা বাধাগ্রস্ত করছেন।

কেবল পরিবারের বা বাসার কাজই নয়, বাবা-মায়েরা সন্তানের নিজের কাজটুকুও অনেক সময় করতে দিতে চান না। স্কুলব্যাগ গুছিয়ে দেওয়া থেকে শুরু করে সন্তানের জুতার ফিতা পর্যন্ত বাবা-মায়েরা বেঁধে দিতে চান। দেখা যায় পরিবারের ছোট শিশুটি নিজের জামাকাপড়টা পর্যন্ত ঠিক জায়গামতো রাখছে না, সবই বাবা-মা করে দিচ্ছেন। সন্তানকে এভাবে দায়িত্ব না দিয়ে বড় করতে থাকলে সে সামাজিকভাবে দক্ষ হয়ে উঠতে পারবে না। যেসব শিশু পরিবারে কোনো ধরনের কাজে সম্পৃক্ত না হয়ে বেড়ে ওঠে, তারা সিদ্ধান্তহীনতায় ভোগে।

সকালে ঘুম থেকে উঠে নাশতার টেবিলে ‘ফার্মের’ ডিমের ওমলেট খাবে, না ‘দেশি’ ডিমের ওমলেট খাবে—এই সিদ্ধান্তর জন্য যে শিশু মায়ের মুখাপেক্ষী থাকে সে পরিণত বয়সেও সিদ্ধান্ত নিতে পারে না কোন চাকরিটি সে করবে বা পছন্দের কোন মেয়েকে সে বিয়ে করবে! অর্থাৎ ছোট ছোট সিদ্ধান্ত না নিতে নিতে একসময় সে জীবনের বড় বড় সিদ্ধান্ত নিতে পারবে না। ফলে বড় হয়ে গেলে বাবা-মা থেকে দূরে থাকলে সমস্যার সমাধান করতে না পেরে অস্থিরতা-হতাশায় ভোগে।
শিশুকে যদি ছোটবেলায় কোনো দায়িত্ব না দেওয়া হয় তখন তার আত্মবিশ্বাস কমে যায়, ফলে উদ্বিগ্নতা আর বিষণ্নতায় সহজেই আক্রান্ত হয়ে পড়ে। শিশুর সামাজিক দক্ষতা বাড়াতে আর মানসিকভাবে সবল হতে ছোটবেলা থেকেই তাদের বয়স–উপযোগী দায়িত্ব প্রদান করতে হবে। এ বিষয়টির চর্চা করার জন্য বাবা–মায়েরা যা করতে পারেন—

* পারিবারিক কোনো সিদ্ধান্ত গ্রহণের সময় শিশুর মতামত গ্রহণ করার চর্চা করুন। অনেক সময় শিশুর মতামতের পেছনে অনেক ইতিবাচক যুক্তি থাকে যা বড়রা কল্পনাও করতে পারে না।
* সন্তান মেয়ে হোক বা ছেলে হোক উভয়কেই বয়স–উপযোগী দায়িত্ব দেবেন। ‘ও মেয়ে, এটা পারবে না’ বা ‘ছেলেদের রান্নার কাজে সাহায্য করা মানায় না’ এই ধরনের বৈষম্যমূলক কথা বলে শিশুর জ্ঞানীয় বিকাশকে (কগনিটিভ ডেভেলপমেন্ট) প্রভাবিত করবেন না। এতে করে শিশুর মনে বৈষম্য আর হীনমন্যতা জন্ম নেবে।
* পরিবারে কোনো বয়স্ক, অসুস্থ বা খুবই ছোট শিশু থাকলে তাদের যত্ন আর ছোটখাটো কাজে অপেক্ষাকৃত বড় সন্তানকে অংশ নিতে উৎসাহিত করুন।
* ঘরের ছোটখাটো কাজ যা বাবা-মা বা গৃহকর্মীরাই করে থাকেন, এসব কাজে মাঝে মাঝে শিশুদের সম্পৃক্ত করুন। যেমন ঘর গোছানো, ঘর পরিষ্কার ইত্যাদি।
* শিশুকে দেওয়া কাজটি সম্পন্ন করার পর তার প্রশংসা করুন, পুরস্কৃত করুন। কাজে ভুল হলে সমালোচনা বা ব্যঙ্গ করবেন না।
* শিশু নিজে থেকে কোনো দায়িত্ব নিতে চাইলে তার আগ্রহে বাধা দেবেন না।
* শিশুকে দায়িত্ব দেওয়ার পাশাপাশি কাজগুলো করার সময় শিশুর নিরাপত্তার দিকে নজর রাখুন। বিপজ্জনক কাজের (বৈদ্যুতিক যন্ত্রপাতির ব্যবহার) দায়িত্ব দেবেন না।
* এমন কোনো দায়িত্ব তাকে দেবেন না যাতে তাদের কোনো আসক্তি জন্মাতে পারে। যেমন ধূমপানের সরঞ্জাম এগিয়ে দেওয়া, মোবাইল ফোনের অ্যাপস ঠিক করতে দেওয়া ইত্যাদি। অনেক বাবা-মা সন্তানের মোবাইল ফোনবিষয়ক জ্ঞান নিয়ে আত্মতৃপ্তিতে ভোগেন—‘আমার ছেলেটা মোবাইলের সব খুঁটিনাটি পারে, যা আমিও পারি না!’ মনে রাখবেন, এই আত্মতৃপ্তির ফল হতে পারে সন্তানের মোবাইল/ইন্টারনেট আসক্তি।
* সন্তানকে দায়িত্ব দেওয়ার ক্ষেত্রে মা-বাবা সমন্বিত সিদ্ধান্ত নিন। এ বিষয়টি নিয়ে দ্বিমত প্রকাশ করলে তা সন্তানের সামাজিক দক্ষতাকে আরও কমিয়ে দেবে।

সহযোগী অধ্যাপক, জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট, ঢাকা।