অন্নপূর্ণার সামনে নবদম্পতি

হিমালয়কে সাক্ষী রেখে। ছবি: লেখক
হিমালয়কে সাক্ষী রেখে। ছবি: লেখক

সাফাত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আমার জুনিয়র ছিল। জুনিয়র হলে কী হবে, বাকি সবকিছুতেই সে সিনিয়র—আমার আগে ছবি তোলাকে পেশা হিসেবে নেওয়ার সাহস করা, প্রেম করে বিয়ে করা, পরিবারকে দেখভাল করা। তবে একটা বিষয় তার ও আমার মধ্যে বেশ মিল। আমরা দুজনই পাহাড় ও ছবি তুলতে ভালোবাসি।
একদিন ফেসবুকে ‘প্রকৃতিকাব্য’ নামে পেজ খুললাম। সেখানে ঘোষণা দিলাম আমাকে কেউ নতুন এবং চ্যালেঞ্জিং জায়গায় ছবি তোলার সুযোগ দিলে ছবি তোলা হবে ফ্রি, শুধু আসা–যাওয়ার ভাড়া এবং বেঁচে থাকার মতো খাবার দিলেই হবে। এ ঘোষণা দেওয়ার পর একদিন সাফাত আমাকে নক করে বলে, ‘দাদা, অন্নপূর্ণা বেস ক্যাম্পে আমার ও আমার বউয়ের (শিখা) ছবি তুলে দিবা নাকি?’
এমনিতেই পাহাড় ভালোবাসি, আবার পাহাড়ে প্রিয় দম্পতির ছবির কাজ, এর উত্তর কি ‘না’ হয় নাকি? সঙ্গে সঙ্গে বলে দিলাম আমি রাজি।
পরে কথায় কথায় জানতে পারলাম, ওরা তিন বছর আগেই অন্নপূর্ণা বেস ক্যাম্পে যাওয়ার চেষ্টা করেছিল, কিন্তু সাফাত অসুস্থ হয়ে পড়ায় যেতে পারেনি। বাকিদের রেখে চলে আসতে হয়েছে। এই আক্ষেপ থেকেই ওদের জেদ ছিল, ওরা আবার যাবে। শুরুর পরিকল্পনায় আমি, সাফাত ও তার স্ত্রী শিখা এই তিনজনই ছিলাম। শেষ দিকে আমাদের আরেক বন্ধু দোলন যেতে আগ্রহী হয়। আমাদের অবস্থা তখন সোনায় সোহাগা।

সাফাত–শিখা দম্পতি। পেছনে অন্নপূর্ণা
সাফাত–শিখা দম্পতি। পেছনে অন্নপূর্ণা

আমরা গিয়েছিলাম গত মে মাসে, ওদের বিয়ের এক বছর পর। সব মিলিয়ে ১৬ দিনের সফর ছিল। যাত্রা শুরু করেছি কাঠমান্ডু থেকে। সেখান থেকে পোখরা, পোখরা থেকে ট্রেকের স্টার পয়েন্ট নয়াপুল গেছি। ওখান থেকে হাঁটা শুরু। সব মিলিয়ে যাওয়া-আসা মিলিয়ে ১২ দিন হাঁটতে হয়েছে। সবাই নিজের ব্যাগ, ক্যামেরা বহন করেছে। ছবি তোলার মূল গন্তব্য ছিল অন্নপূর্ণা বেস ক্যাম্প, যা সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ৪ হাজার ১৩০ মিটার উঁচুতে অবস্থিত। আমাদের শুটিংয়ের ছবির পটভূমিতে দুটি চূড়া ছিল—অন্নপূর্ণা ১ ও ডাউলিগিরি ১। ৮ হাজার মিটার উচ্চতার বেশি। বিশ্বে ৮ হাজার মিটারের বেশি উঁচু পর্বতচূড়া আছে ১৪টি।

ছবি: লেখক
ছবি: লেখক

এই ভ্রমণের অনেক ছোট ছোট মুহূর্ত আসলে লিখে প্রকাশ করা যাবে না এবং ছবিতেও বোঝানো যাবে না। মেঘের ভেতর হাঁটা, দোলন ও শিখার জীবনে প্রথম তুষারপাত দেখা, দুদিন হাঁটাপথে কোনো মানুষ না দেখা—আরও কত–কী। এটা একটা সাধারণ দম্পতির ছবি তোলার কাজ ছিল না। আমাদের মূল লক্ষ্য ছিল অন্নপূর্ণা বেস ক্যাম্পে ছবি তোলা। সকালে মাত্র এক–দুই ঘণ্টার জন্য আকাশ ভালো পাওয়ার সুযোগ ছিল। মানে ছবি তোলার সময় নিতান্তই কম। তার ওপর ৪ হাজার ১৩০ মিটার ওপরে ঠান্ডা, অক্সিজেন–স্বল্পতা—এসব ব্যাপার ছিল। তবু আমরা দমে না গিয়ে এগিয়ে গেছি। আমি আর দোলন প্রায় ৩০ কেজির মতো ব্যাগ নিজেরা বহন করেছি—ক্যামেরা, ফ্লাশ, লেন্স। যারা পাহাড়ে এমন উচ্চতায় হাঁটে, তারা জানে যেখানে এক গ্রাম ওজন অনেক সময় এক কেজি মনে হয়। চারজন মানুষ এত দ্রুত এত আপন হয়ে গিয়েছিলাম, তা অবাক করার মতো।

ছবি: লেখক
ছবি: লেখক

যেহেতু হিমালয় পর্বতমালায় ছবি তুলব, আমার ইচ্ছে ছিল হিমালয়ের কাছে আমরা কত ক্ষুদ্র, এমন থিমে কাজ করা। এমন ফ্রেমে মানুষকে খুঁজে পাওয়া যায় না। শিখাকে একদিন বলি, ‘এত কষ্ট করে পোজ দিচ্ছিস, তোদের তো দেখাই যায় না।’ শিখা উত্তর দিল, ‘দাদা, আমাদের এমন ছবিই ভালো লাগে, কাছ থেকে তোলা ছবি তো জিন্দাপার্কেও তোলা যায়।’ এই উত্তর শুনে আমি ওদের আরও ছোট রেখে ছবি তোলা শুরু করলাম।
ছবি তোলার সময় সাফাত ও শিখা তাঁদের আক্দের শাড়ি–পাঞ্জাবি পরেছিল। বিশেষ একটা ধন্যবাদ দিতে হবে বন্ধু দোলনকে। ও না থাকলে অনেক ছবি, গল্প জমত না। সাফাত ও শিখা—তোমাদের মনের জোরের তুলনা নেই। এমন পাগলামি নিয়ে বেঁচে থাকো।

খেয়াল রাখুন
 দেশের বাইরে গিয়ে বিয়ের ফটোশুট এখনো এত পরিচিত না আমাদের দেশে। তবে যাঁরা যেতে চান, তাঁরা বেশ কিছু বিষয় খেয়াল রাখতে পারেন।
 যিনি ছবি তুলবেন এবং যাঁরা নিজেদের ছবি তোলাবেন, তাঁদের ইচ্ছাশক্তি জোরালো হতে হবে।
 উভয় পক্ষকে অনেক কষ্ট মেনে নিতে হবে এবং সময় দিতে হবে।
 ফটোগ্রাফারের সঙ্গে যোগাযোগ অনেক ভালো হতে হবে। যাঁর ছবি তোলা হবে, তিনি কী চান এবং ফটোগ্রাফার কী চান, সেটার ভারসাম্য যেন ঠিক থাকে।

.
.