স্বাধীনতা–উত্তর নগরায়ণে সুউচ্চ অট্টালিকায় বসবাসের স্পৃহা জাগাতে শুরু করার পেছনে যতটা না শখ বা আহ্লাদ কাজ করেছে, তার চেয়ে বেশি করেছে জমির ‘নিয়ন্ত্রণহীন’ মূল্যবৃদ্ধি। অনেক ‘জনকল্যাণমুখী’ রাষ্ট্রের ক্ষেত্রেই ‘নগর জমি’র মালিকানা রাষ্ট্রের হাতেই থাকে, বিশেষ করে অত্যধিক জনঘনত্বের নগর বা রাজধানীতে তা অবশ্য জরুরি ছিল। কিন্তু বিভিন্ন রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে এই নগরোর ‘ভূমি’ হয়েছে ধনীদের বিনিয়োগক্ষেত্র, ফলে নিয়ন্ত্রণহীনভাবে বেড়ে ওঠা জমির মূল্যের ঊর্ধ্বগতি সংগত কারণে আমাদের ভবনগুলো নির্মাণশৈলীতে ঊর্ধ্বমুখী হওয়ার জন্য তাড়িত করেছে। আর তাতেই নগরজীবনে ‘আকাশছোঁয়া বসবাস’–এর নতুন ‘নগরদর্শন’ এসে হাজির। এবার এই বসবাসের একটি সার্বিক মূল্যায়ন করা যাক।
সামগ্রিকতায় চিন্তা করলে ঢাকা শহরের বসবাস যোগ্যতার মানোন্নয়নের সম্ভাবনার সঙ্গে এই নতুন বসবাস ধারণার একটি আন্তযোগ আছে। প্রায় ৭০ শতাংশ চার-পাঁচতলার ঘন আর ঘিঞ্জি ভবনকাঠামো আচ্ছাদিত ‘মাঠ আর উন্মুক্ত স্থান’বিহীন যে প্রতিবেশ আমরা তৈরি করে চলেছি, তার বিরুদ্ধে ‘নগর পুনর্গঠন’ করে ধারণায় ‘যূথবদ্ধ’ অনেকগুলো প্লটের ক্ষেত্রে এই ‘আকাশছোঁয়া’ বসবাস ধারণা নতুন সম্ভাবনা তৈরি করবে। যূথবদ্ধ প্লটের সমপরিমাণ জমিতে বর্তমানের নিয়মানুযায়ী প্রতিটি একক প্লটের বিপরীতে যে পরিমাণ পরিসর বা ফ্লোর স্পেস তৈরি সম্ভব, তার প্রায় দেড় গুণ ‘পরিসর’ বা ‘বসবাস স্থান’ নির্মাণ করেও নিজস্ব উঠোন, খেলার মাঠসহ অন্যান্য নাগরিক সুবিধার অন্তর্ভুক্তি নিশ্চিত করা সম্ভব। এ ক্ষেত্রে সুউচ্চ আবাস ভবনগুলোই হবে এই লক্ষ্য অর্জনের অন্যতম হাতিয়ার। তাই শখ বা বিলাসিতা নয়, একান্তই প্রয়োজনীয় নাগরিক সেবাসংবলিত বাসযোগ্য আবাসন নিশ্চিতের লক্ষ্য অর্জনেও এই ‘আকাশছোঁয়া আবাসন’ অন্যতম অবলম্বন হতে পারে।
নতুন এই ধারায় ব্যক্তির বসবাসের আধুনিকায়নের সুবিধা সহজাত করার পাশাপাশি বাধাহীন আকাশ আর ধুলোহীন বাতাস নিশ্চিত করবে। ঋতুবান্ধব বায়ুর প্রবাহে ‘দমবন্ধ’ ঘুপচি প্রতিবেশের বিপরীতে প্রকৃতিনির্ভর জীবন, রৌদ্রোজ্জ্বল আলোর ঝরনাধারায় তুলনামূলক শব্দদূষণমুক্ত জীবনের সুযোগ তৈরির সঙ্গে সঙ্গে পূর্ণিমায় বারান্দা আর জানালার ধার ভেসে যাওয়া মধু-আলোর সঙ্গে ঝড়, বর্ষা বা শ্রাবণকে উপভোগ করার সুযোগ সৃষ্টি করবে। এর সঙ্গে ‘বারান্দাবাগান’ বা ‘টেরেসবাগান’–এর যুক্ততায় তৈরি হতে পারে ‘মশামুক্ত’ কিন্তু পাখি আর মৌমাছির পরশে সিক্ত ফুলেল নির্মল পরিবেশ। এই সুউচ্চ কাঠামো আদল ঘন বিন্যস্ত আবাসন নিশ্চিত করার পাশাপাশি পার্কিং এবং অন্যান্য বৈদ্যুতিক বা যান্ত্রিক সেবানির্ভর ব্যবস্থাকে ‘ভূ-গর্ভস্থ’ করার মধ্য দিয়ে ওপরের দৃশ্যমান তলাগুলোকে নির্ঝঞ্ঝাট করে পাশাপাশি আধুনিক স্বাচ্ছন্দ্যকেও ধারণ করতে পারে। এতে প্রকৃতিনির্ভর আলো-বায়ুর নিশ্চয়তার পাশাপাশি প্রয়োজনীয় কিন্তু দৃষ্টিদূষণে দুষ্ট নানা সেবা, সুবিধাদি দৃশ্যমান না করেও সামর্থ্য অনুযায়ী সংযোজনের সুযোগ তৈরি হতে পারে।
কিন্তু সচেতন প্রয়াসে ‘উঠোনকেন্দ্রিক’ কাঠামোভিত্তিক গুচ্ছ গঠনকে প্রাধান্য না দিলে কিংবা আনুভূমিক বাগান বা ‘টেরেস’নির্ভর আলো-বাতাসে সিক্ত ‘আকাশছোঁয়া’ ভবনের আদল নিশ্চিত না করলে, এই বসবাসধারা সামাজিক বিচ্ছিন্নতা, মাটির সংস্পর্শবিহীন, ভালোবাসাহীন জীবনের সূত্রপাত করতে পারে। করতে পারে স্বার্থপর ও আত্মকেন্দ্রিক সামাজিক পরিবেশের সূচনা। তৈরি করতে পারে অতি উচ্চতায় ভীতিজনিত মনোদৈহিক চাঞ্চল্য আর দুর্যোগ-দুর্বিপাকে বিপদাপন্ন হওয়ার আশঙ্কাও।
নগরকেন্দ্রে বসবাস করার তাগিদে ‘আকাশছোঁয়া’ আবাসনে বসবাস একটি উপযুক্ত বাস্তবতা হিসেবে ধরলেও এটি এখনো ‘ধনী গোষ্ঠী’র সামর্থ্যের প্রতীকী সমাধান হিসেবেই স্বীকৃত। কিন্তু শিশুর বেড়ে ওঠার যথার্থতায় এই আদলটিকে যথাযথকরণ, বিশেষ করে আনুভূমিক বিভিন্ন স্তরে শিশুতোষ অঞ্চল, সবুজায়ন ও বাগান, উন্মুক্ত পরিসর ইত্যাদির সংকুলানে সামাজিক সুস্বাস্থ্য নিশ্চিত করা জরুরি। এমনকি শিশুবান্ধব খেলার জায়গা, পাঠকেন্দ্র, দিবাযত্ন–সুবিধা কিংবা বয়স্ক ব্যক্তিদের বিভিন্ন তলায় সুবিধামতো হাঁটাচলার জায়গা তৈরি আবশ্যকীয় বিষয় হিসেবে গণ্য করাও জরুরি।
তা ছাড়া অনুচ্চ ভবনের তুলনায় ‘আকাশছোঁয়া’ উচ্চ ভবনের সিঁড়ি, সামাজিক বা ‘কমন’ করিডর কিংবা স্তরে স্তরে ছাদবাগান সংযোজনের ক্ষেত্রে মাত্রা ও তার পরিধি তুলনামূলক প্রশস্ত ও বেশি মাত্রায় হওয়া প্রয়োজন। সামাজিক আচার, অনুষ্ঠান আর পারস্পরিক সৌহার্দ্যের জন্য প্রয়োজনীয় সেবাসহ পরিসর রাখাও জরুরি। এসবের সঙ্গে আধুনিক নিরাপত্তা আর সেবা-সুবিধার সংযুক্তিতেই কেবল এই বসবাস হতে পারে ‘আকাশে হেলান দেওয়া’ এক মায়াবী বসবাসের বাস্তবতা। আর এ কারণেই ‘প্রকৃতিবাদী’ পেশাজীবীদের মাধ্যমে ও নিজস্ব সচেতনতায় দেশজ আলো-বাতাস-প্রকৃতির আদলের প্রতি সংবেদনশীল উদ্যোগ নিশ্চিত করেই কেবল ‘আকাশছোঁয়া’ ভবনের জীবন কাম্য হতে পারে। আর এর সঙ্গে বাঙালির সামাজিক সর্ম্পকনির্ভর পরিসর ও প্রতিবেশের আদল প্রাধান্যে বসবাসকাঠামোর পারস্পরিক সম্পর্ক ও যূথবদ্ধতা নিশ্চিত করাটাও জরুরি।
প্রতি বর্গকিলোমিটারে প্রায় ৪৭ হাজার ৮০০ জনসংখ্যার ঢাকা নগরে এই বসবাস ধারার বা আদলের যথাযথ ব্যবহারের মধ্য দিয়েই যে নগর তৈরির সুযোগ, সঙ্গে সঙ্গে বর্তমানের আবাসযোগ্য বিশাল অংশের পুনর্গঠনের সম্ভাবনা, সেটাই হয়তো জমির অতি উচ্চমূল্যের কারণে জর্জরিত নগরের মুক্তির সোপান।
লেখক: পরিচালক, ভিত্তি স্থপতিবৃন্দ