জীবনধারায় বাংলাদেশ

শাড়িতে রিকশাচিত্র। ফুটে উঠেছে বিজয়ের চেতনা। মডেল: আশা, পোশাক: ফিনারী, স্থান: মুক্তিযুদ্ধ যাদুঘর, ছবি: কবির হোসেন
শাড়িতে রিকশাচিত্র। ফুটে উঠেছে বিজয়ের চেতনা। মডেল: আশা, পোশাক: ফিনারী, স্থান: মুক্তিযুদ্ধ যাদুঘর, ছবি: কবির হোসেন
দেশজ নকশার পোশাক, দেশীয় সাজ, দেশীয় ঘরানার অন্দরসজ্জা—অন্তর থেকেই আসে। রিকশাচিত্র আমাদের ঐতিহ্যের শিল্পধারা। রিকশাচিত্রেও আছে দেশজ নানা উপাদান। সেই রিকশাচিত্র কখনো সরাসরি, কখনো মোটিফ আকারে উঠে আসে পোশাকে, অন্দরে, প্রতিদিনের নানা অনুষঙ্গে।

নির্ভীক সত্যান্বেষণ তারুণ্যের প্রতীক। ইতিহাস আর ঐতিহ্যের মাঝেই তরুণেরা খুঁজে নেন স্বকীয়তা। পাশ্চাত্যের ছোঁয়ায় আধুনিকতা খুঁজলেও দেশজ সামগ্রী ঠিকই উঠে আসে দৈনন্দিন জীবনধারায়। দেশজ নকশার পোশাক, দেশীয় সাজ, দেশীয় ঘরানার অন্দরসজ্জা—অন্তর থেকেই আসে।

টি–শার্টে চিরায়ত বাংলার রূপ
টি–শার্টে চিরায়ত বাংলার রূপ

দেশপ্রেম প্রকাশের ধরন ব্যক্তি ব্যক্তিতে আলাদা। তবে জীবনের কোনো না কোনো একটি অংশে ‘দেশজ’ হয়ে ওঠার আকুলতা অনুভব করেন অনেকেই। পাশ্চাত্যের মোহময় নানান উপকরণকে পেছনে ফেলে রিকশাচিত্রও জায়গা করে নেয় এই তরুণদের জীবনে।
রিকশার উৎপত্তি জাপানে, তবে জাপানে রিকশা বিলুপ্ত হয়েছে বহু আগেই। ২০ শতকের প্রথমার্ধ থেকে এ দেশে প্রচলিত রিকশা; এখনো আছে স্বমহিমায়। আর রিকশাচিত্র উঠে এসেছে হাল সময়ের ফ্যাশনে, অন্দরের সাজে। খাঁটি দেশজ কৃষ্টির বাহক হতে চান, এমন যে কারও কাছেই রিকশাচিত্র আজ জীবনধারার এক অসাধারণ অনুষঙ্গ।

মডেল: রজার
মডেল: রজার

ডিজাইনার ঊর্মিলা শুক্লা বললেন, ‘যে দৃশ্যে বাংলাদেশকে বুঝি, তেমনটাই দেখা যায় রিকশাচিত্রে। এক একটি রিকশাচিত্রে ফুটে ওঠে বাংলাদেশের এক একটি রূপ। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা ছিল না বা নেই এই রিকশাচিত্রের শিল্পীদের। তবে তাঁদের তুলির টান সবকিছুর থেকে আলাদা। ডিজিটাল ছাপার যুগ শুরু হওয়ার পর এক সময় রিকশাচিত্রের চাহিদা কমে গিয়েছিল। তবে আজকাল নতুনভাবে জীবনধারায় উঠে এসেছে রিকশাচিত্র। ব্যতিক্রমধর্মী কাজ হচ্ছে। আজকের দিনে নতুনভাবে যেন পুরোনো ঐতিহ্যকে খুঁজে পাচ্ছি রিকশাচিত্রে।’
রিকশাচিত্র, ক্ষুদ্র জাতিসত্তার বিলুপ্ত গয়না ও পোশাক নিয়ে কাজ করেন অনলাইন দোকান ফিনারির স্বত্বাধিকারী ড চিং চিং। রিকশাচিত্র এমন এক ঐতিহ্য, যা দেশকে চিত্রিত করে; সেই শিল্পের দুর্দিন দেখে ড চিং চিং ভেবেছিলেন, পরবর্তী প্রজন্ম তো এই ঐতিহ্যবাহী সৌন্দর্য না-ও পেতে পারে, অন্তত কাজের মধ্য দিয়ে বেঁচে থাক শিল্পটি। খুঁজে পেতে রিকশাচিত্রের শিল্পী এনে কাজ শুরু করেন তিনি। শিল্পটিকে সৃজনশীল উপায়ে দৈনন্দিন জীবনধারায় নিয়ে আসতে আর এর শিল্পীদের প্রাপ্য সম্মানটুকু দিতে সচেষ্ট ড চিং চিং। শখের বশে শুরু করা কাজটিকে এখন দেশে ও বিদেশে নানা আঙ্গিকে এগিয়ে নিতে সচেষ্ট তিনি।
ফ্যাশন হাউস নিত্য উপহারের স্বত্বাধিকারী বাহার রহমান রিকশাচিত্রকে বাংলাদেশের স্থানীয় ঐতিহ্যবাহী অঙ্কনশৈলী মনে করেন—যা দেখলেই চেনা যায়। বললেন, ‘রিকশাচিত্র নিজেই একটি ধারা। এটি বাংলাদেশের কৃষ্টি-সংস্কৃতিকে ফুটিয়ে তোলে। জীবনধারার নানান উপকরণে এর ব্যবহার দৃষ্টিনন্দন।’

কী আছে হেথা?
ঊর্মিলা শুক্লা জানালেন, সুন্দরবনের বাঘ, গ্রামের দৃশ্য, পানিতে হাঁস ভেসে থাকার দৃশ্য কিংবা ফুল, পাখি, লতাপাতা—দৈনন্দিন সরল বিষয়গুলোই ফুটিয়ে তোলেন রিকশাচিত্রের শিল্পীরা। একসময় সিনেমার নায়ক-নায়িকাদের মুখও আঁকা হতো। স্মৃতিসৌধ বা সংসদ ভবনের মতো বিষয়গুলোও উঠে আসে রিকশাচিত্রে।

ছবি: কবির হোসেন
ছবি: কবির হোসেন

‘রিকশাচিত্রের মূল বৈশিষ্ট্য উজ্জ্বল রং, যা সহজেই নজর কাড়ে’—বলেন ড চিং চিং। শাপলা ফুল, মুক্তিযুদ্ধ ও ভাষা আন্দোলনের প্রতীকী চিত্র, এ দেশের নানান উৎসবের ছবি কিংবা স্কুলশিক্ষার্থীদের জন্য পাখি পরিচিতি—রিকশাচিত্রে গোটা দেশটাকেই ফুটিয়ে তোলা সম্ভব বলে জানালেন তিনি।

যেভাবে ব্যবহারে
৩৫ বছর ধরে শিক্ষকতা করছেন সামিয়া জামান। বর্তমানে গুলশানের সিব্রিজ ইন্টারন্যাশনাল স্কুলের শিক্ষক। বাংলাদেশকে ফুটিয়ে তোলে, এমন সামগ্রীই ব্যবহার করতে পছন্দ করেন। বাড়িতে আছে রিকশাচিত্র আঁকা সিন্দুক ও হাঁড়ি-পাতিল। আরও রেখেছেন বেঞ্চ, টেবিল ও শিশুর চেয়ার। রিকশাচিত্রের শাড়িও পরেছেন। জানতে চাওয়া হলো, কেন রিকশাচিত্রে আগ্রহ এত? জবাবে বলেন, ‘রিকশাতেই তো বড় হওয়া। সেই সময় প্রাইভেট গাড়ি আর পাবলিক বাস ছিল না এখনকার মতো। রিকশার সামনের পর্দা, পেছনের নামানো অংশ—এই নিয়েই যাওয়া হতো এখান সেখান।’ রং বড্ড ভালোবাসেন, দেশজ সামগ্রীতে পান মায়ের গন্ধ। তাই উজ্জ্বল রঙের এই সৃজনশীল শিল্পটিকে আপন করে নিয়েছেন নিজের জীবনে।

পতাকার রং পোশাকে
পতাকার রং পোশাকে

ছেলেবেলায় দেখা বেবিট্যাক্সিতে আঁকা রিকশাচিত্রের কথা বলছিলেন ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্র্যাক জেমস পি. গ্র্যান্ট স্কুল অব পাবলিক হেলথের যোগাযোগ ব্যবস্থাপক তানভীর হাসান। সেই বেবিট্যাক্সি আজ শুধু গিফট শপের ছোট্ট শোপিস। শৈশবের মধুর স্মৃতির একটা অংশ রিকশাচিত্র। রিকশাচিত্রের সামগ্রী উজ্জ্বল, মজাদার ও বিচিত্র। এর পাশাপাশি তা খেয়ালিপনা প্রকাশ করে থাকে বলে তরুণ প্রজন্মের মাঝে অনুরণিত হচ্ছে বলে মনে করেন তিনি। একটু ভিন্ন ধাঁচের জিনিস পছন্দ তাঁর নিজেরও। একসময় রিকশাচিত্রে পোস্টার আঁকা হতো, সেই স্মৃতি থেকে সম্প্রতি মুঠোফোনের কভারে রিকশাচিত্রে সিনেমার পোস্টারের মতো করে বিড়াল আঁকিয়ে নেবার জন্য অর্ডার করেছেন। তাঁর পছন্দের কথা মাথায় রেখেই সহকর্মীরা ইস্তিরির একটা শোপিস উপহার দিয়েছিলেন তাঁকে, যাতে রিকশাচিত্রে তাঁর ছবি আঁকা হয়েছে।
রিকশাচিত্র থাকতে পারে আপনার বাড়ির জগ, গ্লাস, কাপ, মগ, ট্রে, কেটলি, কাচের বোতল, ব্যাগ, ট্রাঙ্ক, চেয়ার, ফুলদানি, পর্দা কিংবা ল্যাম্পে। শাড়ির নকশার সঙ্গে মানানসই রিকশাচিত্র ফুটিয়ে তুলতে পারেন শিল্পীরা। টি-শার্ট, লকেট, কানের দুল বা চশমার ফ্রেমের জন্যও বেছে নিতে পারেন রিকশাচিত্র। এমনকি অফিসের ফাইল ক্যাবিনেটে, বাড়িতে রাখা ক্যানভাসে; চাই কি বাড়ির একটা দেয়ালজুড়েও রাখতে পারেন রিকশাচিত্র।
রিকশাচিত্রের শিল্পীরা শাড়ির ধরন বুঝে তাতে মানানসই রিকশাচিত্র এঁকে দিতে পারেন বলে জানালেন ড চিং চিং। একরঙা শাড়ির পাড়, আঁচলসহ বিভিন্ন অংশে রিকশাচিত্র করা যেতে পারে। টি-শার্টের সামনে বা পেছনে যেকোনো অংশেই থাকতে পারে রিকশাচিত্রের ব্যবহার। ঘরের বিভিন্ন তৈজস, ট্রাঙ্ক, আলমারি, জুয়েলারি রাখার বাক্সটিতেও রিকশাচিত্র আঁকা হতে পারে।
মুঠোফোনের খাপসহ বিভিন্ন অনুষঙ্গে রিকশাচিত্রের নকশা এঁকে দেয় বিস্কুট ফ্যাক্টরি। তরুণ প্রজন্মের কাছে গ্রহণযোগ্য উপায়ে লোকসংস্কৃতিকে পৌঁছে দিতে ২০১৪ সাল থেকে প্রতিষ্ঠানটি রিকশাচিত্রের নকশা করছে নানা পণ্যে। গ্রাহকের চাহিদা অনুযায়ী যেকোনো কিছুর ওপরেই রিকশাচিত্র এঁকে দেয় তারা। মুঠোফোনের কেস, ল্যাপটপ কম্পিউটারের কেস, নিমন্ত্রণপত্র, ক্যানভাস, সানগ্লাস বা জ্যাকেট যা-ই হোক না কেন।