ইন্টারকন্টিনেন্টাল ১৯৭১

হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টাল, ঢাকা। ১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১। ছবি: আলোকচিত্রী সাইদা খানম
হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টাল, ঢাকা। ১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১। ছবি: আলোকচিত্রী সাইদা খানম

ইন্টারকন্টিনেন্টাল থেকে ঢাকা শেরাটন।

ঢাকা শেরাটন থেকে রূপসী বাংলা।

রূপসী বাংলা থেকে ফের ইন্টারকন্টিনেন্টাল।

রমনার সবুজের পাশে আধুনিক স্থাপত্য ও ঐতিহ্যের নান্দনিকতার মিশেলে নবরূপে সজ্জিত এই হোটেলটিতে আছে ২০১টি প্রিমিয়াম ডিলাক্স রুম, ১০টি ডিলাক্স সুইট, ৫টি সুপিরিয়র সুইট, ৫টি ডিপ্লোমেটিক সুইট ও ৫টি প্রেসিডেন্সিয়াল সুইট। অতিথি সেবার জন্য আছে সুইমিংপুল, অনেকগুলো রেস্তোরাঁ ও ক্যাফে।

তবে এটাই ঢাকার ইন্টারকন্টিনেন্টাল বা সংক্ষেপে ইন্টারকনের একমাত্র পরিচয় নয়। এই হোটেলের সঙ্গে জড়িয়ে আছে আমাদের মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাস।

পাকিস্তান আমলে ইন্টারকন ছিল একমাত্র পাঁচতারা হোটেল। স্বাভাবিক কারণে রাষ্ট্রীয় অতিথি, বিদেশি সংস্থার প্রতিনিধি ও বিদেশি সাংবাদিক যাঁরাই তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে আসতেন, এখানে উঠতেন। ১৯৭০ সালের ১২ নভেম্বর যখন দক্ষিণাঞ্চলের ওপর দিয়ে ভয়াবহ ঘূর্ণিঝড় বয়ে যায়, তখন অনেক বিদেশি ত্রাণ সংস্থার প্রতিনিধির পাশাপাশি সাংবাদিকেরাও এখানেই সাময়িক আবাস গেড়েছিলেন। সত্তরের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেলেও পাকিস্তানি সামরিক জান্তা ক্ষমতা হস্তান্তর নিয়ে টালবাহানা করতে থাকে। একাত্তরের মার্চে শুরু হয় অসহযোগ আন্দোলন। এসব খবর সংগ্রহ করতে যেসব বিদেশি সাংবাদিক ঢাকায় এসেছিলেন, তাঁদেরও বেশির ভাগ ওঠেন ইন্টারকনে।

৭ মার্চ রমনার রেসকোর্সে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব ঘোষণা দিলেন ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।’ পাকিস্তানিরা ভয় পেয়ে গেল। আলোচনার নামে ঢাকায় এলেন ইয়াহিয়া খান ও জুলফিকার আলী ভুট্টো। ইয়াহিয়া ছিলেন রাষ্ট্রীয় অতিথিশালায়। আর ভুট্টো তাঁর দলবল নিয়ে উঠেছিলেন এখানেই। ভুট্টোর বাঙালি বিদ্বেষ সবার জানা। বাঙালিও তাঁর ওপর প্রচণ্ড ক্ষুব্ধ। যেখানে ভুট্টো যান সেখানেই বিক্ষোভ, প্রতিবাদ।

২.

কবি নির্মলেন্দু গুণ তখন সাংবাদিকতা করেন সাপ্তাহিক গণবাংলায়। তাঁর কাছে প্রেসকার্ড ছিল। তিনি যেকোনো সময় ইন্টারকনে যেতে পারেন। হোটেলের কর্মচারীরাও তাঁর পরিচিত। বন্ধু কবি হুমায়ুন কবিরের সঙ্গে পরামর্শ করে ঠিক করলেন, ভুট্টোকে শিক্ষা দিতে হবে। ২৩ মার্চ তাঁরা দুজন হোটেল লবিতে গিয়ে জানলেন ভুট্টো বাইরে গেছেন। তাঁরা লবিতে অপেক্ষা করতে লাগলেন। ঠিক যখন ভুট্টো সশস্ত্র প্রহরাসহ ভেতরে ঢুকলেন, হুমায়ুন কবির দাঁড়িয়ে উচ্চকণ্ঠে স্লোগান তুললেন, জয়...বাংলা। সবাই সচকিত হলেন। প্রহরীরা দ্রুত ভুট্টোর চারপাশে নিরাপত্তাবেষ্টনী গড়ে তুলল। দুই তরুণ কবি বিজয়ের আনন্দ নিয়ে হোটেল লবি থেকে বেরিয়ে এলেন।

পঁচিশে মার্চ রাতে যখন সাংবাদিকেরা ইন্টারকনের লবিতে বসে আড্ডা দিচ্ছিলেন, তখনই এক সেনা কর্মকর্তা এসে বললেন, ‘বাইরে যাওয়া চলবে না।’ তার আগেই সাংবাদিকেরা জেনে গেছেন আলোচনা ভেঙে গেছে। ইয়াহিয়া খান সামরিক অভিযানের হুকুম দিয়ে ঢাকা ত্যাগ করলেন। রাত ৯টার দিকে সেনা সদস্যরা ট্যাংকবহর নিয়ে শহরে বেরিয়ে পড়েছে। শেরাটনের সামনে দিয়ে যখন ট্যাংকগুলো ঘড়ঘড় শব্দ করে যাচ্ছিল, তখন আর তাঁদের অনুমান করতে কষ্ট হয়নি কী ঘটতে যাচ্ছে। গভীর রাতে ছাদের ওপর উঠে তাঁরা দেখলেন চারদিকে আগুন জ্বলছে। কাছাকাছি কোথাও থেকে ভেসে আসছে মানুষের আর্তনাদ, গোঙানির শব্দ। পুরো রাত তাঁরা অবরুদ্ধ। পুরো শহরে কারফিউ চলছে, বাইরে যাওয়ার উপায় নেই। হোটেলে বসেই দারুণ উৎকণ্ঠায় সময় পার করে দিলেন সাংবাদিকেরা। বিকেল ৫টায় সেনাবাহিনীর জনসংযোগ কর্মকর্তা সিদ্দিক সালেক এসে হুকুমের সুরে বললেন, ‘তোমাদের এখনই ঢাকা ছাড়তে হবে।’ এরপর সাংবাদিকদের নিয়ে কয়েকটি ট্রাক সোজা বিমানবন্দরের দিকে রওনা হয়।

কিন্তু দুজন সাংবাদিক সিদ্ধান্ত নিলেন, তাঁরা যাবেন না। ডেইলি টেলিগ্রাফ–এর প্রতিবেদক সাইমন ড্রিং ও এপির আলোকচিত্রী মাইকেল লরেন্ট। তাঁরা হোটেলের রান্নাঘরে লুকিয়ে থাকলেন। এ ব্যাপারে বাঙালি কর্মচারীরা তাঁদের সহায়তা করেন। ২৭ মার্চ কারফিউ তুলে নেওয়া হলে এই দুই সাংবাদিক বেরিয়ে পড়েন শহরে। সড়ক, ছাত্রাবাস, বস্তি—সর্বত্র ধ্বংসযজ্ঞ, লাশ পড়ে আছে ছড়িয়ে–ছিটিয়ে। ১০–২০–৪০–৮০...তাঁরা আর গুনতে পারলেন না। পরে সাইমন ড্রিং সেই গণহত্যার কথা লিখলেন ডেইলি টেলিগ্রাফে। ঢাকা থেকে করাচি হয়ে ব্যাংকক যাওয়ার সময় তিনি পায়ের মোজার ভেতরে তাঁর নোটগুলো নিয়ে গিয়েছিলেন। তাঁর রিপোর্টের মাধ্যমেই বিশ্ব পাকিস্তানিদের গণহত্যার খবর জানতে পারে।

৩.

চারদিকে ধ্বংস আর মৃত্যুর বিভীষিকা। কিন্তু পাকিস্তানিরা বাইরের দুনিয়াকে দেখাতে চাইছে পূর্ব পাকিস্তানের পরিস্থিতি স্বাভাবিক। তারা বিশ্বব্যাংকের প্রতিনিধিদের আমন্ত্রণ জানাল। ৯ জুনই তাঁদের ওঠার কথা ছিল ইন্টারকনে। গেরিলা মুক্তিযোদ্ধা ইউনিট ক্রাক প্লাটুনের সদস্যরা আগেই প্রস্তুতি নিয়েছিলেন। হোটেলের কর্মীরা তাঁদের সহায়তা করেছেন। ঠিক সাড়ে ৭টায় যখন বিশ্বব্যাংকের প্রতিনিধি বহনকারী গাড়িটি হোটেল গেটে এসে পৌঁছাল, তখনই বিকট শব্দে কয়েকটি গ্রেনেড ফাটানো হলো। পর পর কয়েকটি গ্রেনেড ফাটিয়ে ক্রাক প্লাটুনের সদস্যরা চম্পট। বিশ্বব্যাংকের প্রতিনিধিদের বহনকারী গাড়িটিও মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হলো। সারা বিশ্ব জেনে গেল ঢাকার কেন্দ্রস্থলেও মুক্তিযোদ্ধারা ঢুকে পড়েছে। কোথাও আর পাকিস্তানিদের নিয়ন্ত্রণ নেই। বিশ্বব্যাংকের বৈঠক সেখানেই শেষ। ক্রাক প্লাটুনের এই অভিযানে নেতৃত্ব দিয়েছিলেন হাবীবুল আলম বীরপ্রতীক।

১৪ ডিসেম্বর পাকিস্তানিদের পুতুল গভর্নর ডা. এম এ মালেক মন্ত্রিসভার বৈঠক ডাকলেন তৎকালীন গভর্নর হাউসে (বর্তমান বঙ্গভবন)। মন্ত্রিসভার সদস্যরা না পৌঁছাতেই গভর্নর হাউসের ভেতরে বিমান থেকে অনেকগুলো বোমা ফেলা হলো। বৈঠক না করে মালেক মার্কিন কনসাল জেনারেলের মাধ্যমে আত্মসমর্পণের বার্তা পাঠালেন এবং মন্ত্রিসভার সদস্যদের নিয়ে ইন্টারকনে আশ্রয় নিলেন।

এই হলো মুক্তিযুদ্ধের সঙ্গে হোটেল যুক্ত হওয়ার গল্প।

সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা হোটেলটি উদ্বোধন করতে গিয়েও সেই গল্পের কথা বলেছেন।