শীতের তারকা সবজি এবং...

শীতের সবজিতে বাজার এখন বর্ণিল। ছবি: লেখক
শীতের সবজিতে বাজার এখন বর্ণিল। ছবি: লেখক

রঙিন সবজির দিকে তাকালেই চোখ জুড়িয়ে যায়। আর এই সময়টাতে বাজারে শীতের সবজি মোহনীয় রূপ পুরোটাই মেলে ধরে। পুরো বাজারটাই যেন রঙিন।

শীতের সবজি নিয়ে কোনো কিছুই ভাবার দরকার নেই। বাংলার মানুষ রোজকার সবজির বাইরে শীতের তারকা সবজির জন্যই অপেক্ষা করে—স্বাদে-গন্ধে-রূপে এ সময়ের সবজির তুলনাই নেই।

গত শুক্রবার সকাল সকাল বের হলাম মোহাম্মদপুর টাউন হল বাজারে। শীতের সবজির হালচাল দেখা। এ বাজারটিই কেন? রাজধানীতে খুচরা বিক্রির যত কাঁচাবাজার রয়েছে, সেগুলোর মধ্যে এই বাজারে অনেক পদের সবজি পাওয়া যায়। সকালে তাজা-টাটকা সবজির মহাসমারোহে বাজার ভরে থাকে। উত্তরবঙ্গের নাপা শাক, যা এদিককার জেলাগুলোতে জন্মায় না, সেটাও পাওয়া যায় এই বাজারে।

তখন সকাল আটটার কাছাকাছি। তখনো ভিড় খুব একটা বেশি না। দু-একটা পিকআপ, ভ্যান থেকে তখনো নামছে সবজি। দোকানে দোকানে সাজানো হচ্ছে তাজা শিম, ফুলকপি, টমেটো—চেহারাই আলাদা। হাইব্রিডের এই আমলে বছরজুড়েই বাজারে কমবেশি বর্তমান। ‘শীতের সময় টেস্টই আলাদা। যখনকার যে সবজি তখন সেটিই খেতে হয়।’ ঝুড়িভর্তি টমেটো কাপড় দিয়ে মুছতে মুছতে বললেন আবুল হোসেন। পাশ থেকে ওই দোকানের মালিক আবদুল হাকিম বললেন, ‘এখন সবই নতুন সবজি। অন্য রকম টেস্ট।’ ২৮ বছর ধরে সবজি বিক্রি করেন। কথা সেটাই। শীতকালীন সবজিগুলো শীতেই বেশি সুন্দর, বেশি মজা।

বাঙালির খাবারে যেমন বৈচিত্র্যের অভাব নেই, তেমনি সবজিরও আছে নানা ধরন। শীতে সব ধরনই পাওয়া যায়। এক শিমের কথাই ধরা যাক। চ্যাপটা ও লম্বা দুই পদের শিম। চ্যাপটা শিম দৈর্ঘ্যে খাটো বিচি বড়; লম্বাগুলোর দৈর্ঘ্য বেশি, বিচি এর মুখ্য নয়।

শীতে বড় বেগুনের আমদানি বেশ। গাঢ় বেগুনি রঙের বেশ বড় আকারের এই সবজিকে তাল বেগুন নামে ডাকেন বিক্রেতারা। বাজার থেকে কেনার সময় সবজি চেনার একটা ব্যাপার আছে, জানারও। তাই জিজ্ঞেস করি, কোথাকার বেগুন? বিক্রেতা আবদুল জব্বার বলেন, ‘ময়মনসিংহের গফরগাঁওয়ের?’ ইসলামপুরের (জামালপুর) বেগুনও তো ভালো। বিক্রেতার জবাব, ‘গফরগাঁওয়ের বেগুনের ভেতরে নরম। জামালপুরের বেগুন ভেতরে শক্ত।’ বাস্তব জ্ঞান অর্জন।

হিমাগারে থাকা আলুই খাওয়া হয় সারা বছর। শীতের সময়ে বাজারে আসে নতুন আলু। সেটার আকর্ষণ নাই-বা বললাম। আলুর প্রকার কম না। সাদা আলু ও লাল আলু। খুদে যে লাল আলু সেটাও ‘নতুন’ হয়ে এসেছে বাজারে। ছালসহ পাটায় পিষে এই আলুর ভর্তা খাওয়ার পর তার স্বাদ স্মৃতি থেকে হারাবে না। খুদে এই আলুর উৎপাদনস্বত্ব শুধুই বগুড়ার।

মুলা শীতের সবজি। তবে হাইব্রিড জমানায় সাদা মুলা সারা বছরই পাওয়া যায়। তবে কিঞ্চিৎ রুগ্‌ণ, চেহারায় বোঝা যায়। লাল মুলাটা বাজারে দেখা যায় শীতেই। সাদার মুলাও এ সময়ে বড় ও তাজা। সাদা-লালের পার্থক্য কী? লাল মুলায় ঝাঁজ বেশি, সাদায় কম—স্বাদে মিষ্টি।

মুলার পর শালগমের কথা বলি। খুব বেশি চাহিদাসম্পন্ন না হলেও শালগম এ সময়ে অনেকের পাতেই ওঠে। সবুজ শালগমের পাশাপাশি গাঢ় বেগুনি শালগমও দেখা গেল বাজারে।

শীতের অভিজাত সবজির তালিকায় টমেটোকে রাখতেই হয়। কাঁচা, পাকা—দুই টমেটোই বাজারে সেরা স্বাদ নিয়ে। পাকা টমেটোর আবার দুই জাত—একটা গোল, ওপরে-নিচে চ্যাপ্টা। স্বাদে কিছুটা টক, খাঁটি দেশি এটা। লম্বাটে ধরনের টমেটো মিষ্টি।

লাউ শীত ছাড়া খাওয়াই চলে না। কচি আর টাটকা লাউ এখন বাজার ভরা। গোল, মাঝারি, লম্বা লাউ এখন কেনার সময় বোঁটা না দেখলেও চলবে। মেরুন আর সবুজাভ সাদা বরবটিও এখন সতেজ।

ফুলকপি শীতের সময় আকারে প্রকারে পুরো প্রস্ফুটিত। বাঁধাকপি শীত ছাড়া পাওয়াই মুশকিল। ফুলকপির মতোই গঠন, তবে রং পুরোটাই সবুজ। বলছি ব্রোকলির কথা। আমাদের সবজিজগতে নতুন মুখই বলা যায়। তবে দিনে দিনে ব্রোকলির পরিমাণ বাজারে বাড়ছেই। চীনা বা বিদেশি রান্নার এই সবজি, ভর্তার পদেও যুক্ত হয়েছে। যেমনটা হয়েছে স্ট্রবেরির অবস্থা। কাসুন্দি দিয়ে স্ট্রবেরি মাখিয়ে রাস্তাতেই তা বিক্রি হচ্ছে দেদার। নতুন মুখের আরেক সবজি স্কোয়াশ। তবে এখনো খুব জনপ্রিয় নয় শসা-মিষ্টিকুমড়ার মিলিত স্বাদের এই সবজি।

পাতাসহ নতুন পেঁয়াজ বাজারের আরেক তারকা। ধনেপাতা এখন পূর্ণ স্বাদ নিয়ে উপস্থিত। আছে শলুক পাতাও। বরই ভর্তার সঙ্গে শলুক পাতা যায় দুর্দান্ত। শীত ছাড়া এর দেখাও মেলে না। মটরশুটির বেলাতেও তাই।

শাকের বাজারে ঢুঁ মারি একটু। শীতের শাক বলতে শর্ষে শাক, পালংশাক আর মুলার শাকের কথাই বলতে হয়। শর্ষের হলুদ ফুলও বিক্রি হচ্ছে শীতের বাজারে। দোকানে থাকা সেই ফুলের আঁটিতে এসে বসছে মৌমাছি।

মাসখানেক আগেও শীতের সবজির বাজারে যেন ছুটেছে আগুনের হলকা। দাম কিছুটা কমে এলেও আগুনের আঁচ আছে। শীত যত গড়াবে, দাম আরও কমবে। শীতের শেষে বা শীত পেরোলে এই সবজিগুলোর স্বাদও কমতে থাকবে।