শীতে ভালো থাকুন ভালোবাসার ওমে

মডেল: নাবিলা ও তাঁর স্বামী জুবাইদুল হক।  ছবি: কবির হোসেন, কৃতজ্ঞতা: হোটেল ট্রপিক্যাল ডেইজি
মডেল: নাবিলা ও তাঁর স্বামী জুবাইদুল হক। ছবি: কবির হোসেন, কৃতজ্ঞতা: হোটেল ট্রপিক্যাল ডেইজি
শীত মানে বারান্দায় রোদ। মায়ের হাতে বোনা সোয়েটার। চায়ের কাপ নিয়ে মুখোমুখি বসে থাকা। শীত মানে হৃদয়ের উষ্ণতা বিনিময়। শীত মানে একটুখানি যত্ন, ভালোবাসার ওমে ভালো থাকা। লিখেছেন আনিসুল হক

শীত মানে নস্টালজিয়া, শৈশবকে ফিরে পাওয়া! জীবনানন্দ দাশ লিখেছিলেন, ‘শিশিরের শব্দের মতন সন্ধ্যা আসে’, আমাদের রংপুরের টিনের চালে ছাওয়া বাড়িতে কিন্তু আমরা সারা রাত শিশিরের শব্দ পেতাম। শিশির জমে টুপটুপ করে ঝরে পড়ত; আমগাছের পাতা থেকে ঘরের টিনের চালে। কোনো কোনো দিন দুপুর ১২টা পর্যন্ত সূর্য কুয়াশার চাদরে নিজেই মুখ লুকিয়ে রাখত; রাস্তাঘাটে কিচ্ছুটি দেখা যেত না। রোদ উঠলে আমরা বারান্দায় বসতাম মোড়া নিয়ে, রোদ পোহাতে। আম্মার হাতে লাল উলের বল, সোয়েটার বোনা চলছে; একটা বল গড়িয়ে গিয়ে পড়ল ওম নিতে চুলার পাশে শুয়ে থাকা বিড়ালের পায়ের কাছে। কোন অন্ধকার ভোরে ভাপা পিঠা বিক্রেতারা রাস্তা দিয়ে হেঁকে যেত এই ‘ভাগা পিঠা...’। রংপুরে ভাপা পিঠাকে বলত ভাগা পিঠা।

চায়ের কাপে জমে উঠুক শীতের সকাল
চায়ের কাপে জমে উঠুক শীতের সকাল

শীত মানে বাগানের ফুলকপি-বাঁধাকপির পাতায় শিশির। ধনেপাতার মিহি চিকন শাখা-প্রশাখার মাথায় সাদা ফুল। গ্রামের বাড়িতে উঠোনে শুকনো সরষে গাছের পালায় আগুন জ্বালিয়ে সকাল ১০টা পর্যন্ত আগুন পোহানো, আর তাতে মটরশুঁটি পুড়িয়ে খাওয়া। গ্রামের বাড়িতে পৌষ মাসে সারা রাত ঢেঁকিতে ঢ্যাম কুর কুর বাজনা বাজত, চাল কুটে সাদা আটা ভানা হচ্ছে, ভোরবেলা ফাঁপা পিঠা আর পুলি পিঠায় ভরে যাচ্ছে কাঁসার বাটি। খেজুরের রসের পিঠা, পায়েস—শীতে জমে সর পড়ে আছে ওপরে! আহ্!
আজকের ঢাকায় শীত কই? তবু এক কাপ চা হাতে বারান্দায় গিয়ে দাঁড়াই, কমলা রঙের রোদটা যদি পাই, জীবনানন্দ দাশ যে কমলা রঙের রোদ দেখেছিলেন। কিংবা কারও শিয়রে তিনি তো কমলার শুশ্রূষা হতে চেয়েছিলেন, তাও তো নিশ্চয়ই শীতেই।
‘আবার যেন ফিরে আসি
কোনো এক শীতের রাতে
একটা হিম কমলালেবুর
করুণ মাংস নিয়ে
কোনো এক পরিচিত
মুমূর্ষুর বিছানার কিনারে।’

শীতে ত্বকের শুষ্কতা এড়াতে ময়েশ্চারাইজিং ক্রিম ব্যবহার করেন নাবিলা
শীতে ত্বকের শুষ্কতা এড়াতে ময়েশ্চারাইজিং ক্রিম ব্যবহার করেন নাবিলা

শীতে কিন্তু রোগশোক আসবেই। চামড়ায় চড়চড় টান, ছোটবেলায় গায়ে আঁচড় দিয়ে শুকনো মাটির মতো দাগ বের করে বলতাম, মানুষের শরীর মাটির তৈরি। এ থেকে রক্ষা পেতে পেট্রোলিয়াম জেলি ছোটবেলা থেকেই ছিল এক ধন্বন্তরি। ঠোঁটেও পেট্রোলিয়াম জেলি মাখতাম, আমরা বলতাম ‘শিশুমালতী’।
সরষের তেল মেখে রোদে গা গরম করে টিউবওয়েলের নিচে বসে গোসল করতাম, উত্তুরে হাওয়া এসে গায়ে লাগত, দাঁতে দাঁতে লেগে আওয়াজ হতো ঠকঠক, কাঁপতাম। শীতের হাওয়ায় লাগল নাচন আমলকীর এই ডালে ডালে...শিবরাম চক্রবর্তী প্যারোডি করেছিলেন, শীতের হাওয়ায় লাগল কাঁপন নন্দলালের হাড়ে হাড়ে...আমাদেরও হাড়ে কাঁপন লাগত।
তখন তো মাথায় মাখতাম নারকেল তেল। তেল জমে থাকত বোতলে। পাটখড়ি (রংপুরে বলে সিন্টা) দিয়ে তেল বের করতে হতো, তা না হলে উঠোনের রোদে তেল গলাতে দিতাম।
এখন তো কত কিছু পাওয়া যায় শিশুদের আর নিজেদের সুস্থ আর সুন্দর রাখার জন্য। বেবি অয়েল, অলিভ অয়েল, ময়েশ্চারাইজার।
শীত আসে না আসে না করতে করতে একটা সময় শীত কিন্তু ঠিকই পড়বে।
হাড়কাঁপানো শীতই পড়বে। এবার নাকি শীতের মাত্রা তীব্রই হবে। রুম হিটারের দোকানেও ভিড় জমবে। শীতে বিয়ের ধুম তো এরই মধ্যে পড়ে গেছে। পিকনিকেও ছুটবে পিকনিক পার্টি। জারিসারি, পালাগানের আসর বসবে গ্রামেগঞ্জে। কক্সবাজারের মতো বিখ্যাত পর্যটন গন্তব্যগুলোয় ছুটবে অগুনতি ভ্রমণপিয়াসী। হোটেলগুলোয় রব উঠবে ঠাঁই নাই ঠাঁই নাই।
বাংলাদেশে শীতের প্রধান অসুবিধা হলো ধূলিবালি। গাছের পাতা পর্যন্ত ধূসরিত হয়ে থাকে। সর্দি-কাশি থেকে শুরু করে নানান অসুখ-বিসুখ তো হাত বাড়াবেই।
তাহলে জীবনানন্দ দাশের কমলা হয়ে না হয় কারও শিয়রে মায়া হয়ে উষ্ণতা হয়ে থাকা যাবে। কিন্তু আরও ভালো হবে, যদি আপনি সুস্থই থাকেন। বরং বলি, এই শীতে ভালো থাকুন। যত্ন আর মমতার আশ্রয়ে থাকুন। ভালোবাসার ওমে থাকুন।
নাকি গাইব ভূপেন হাজারিকার গান: ‘রক্তিম যেন এক উত্তাপ হই।’

শীত কাটুক ভালোবাসার উষ্ণতায়
শীত কাটুক ভালোবাসার উষ্ণতায়

সুকান্তের ভাষায়:
‘হে সূর্য!
তুমি আমাদের স্যাঁতসেঁতে ভিজে ঘরে
উত্তাপ আর আলো দিও
আর উত্তাপ দিও
রাস্তার ধারের ঐ উলঙ্গ ছেলেটাকে।’
তাহলে কথা গুছিয়ে আনি: আসুন, নিজে ভালো থাকি, স্বজনদের ভালো রাখি, আর ভালো রাখার জন্য একটুখানি উষ্ণতা নিয়ে হাত বাড়াই সমাজের পিছিয়ে পড়া শীতার্ত মানুষদের জন্য। শীত মানে তাই কাছে আসা। শীত মানে তাই একটুখানি উষ্ণতা বিনিময়। শীত মানে ভালোবাসায় ওম! ভালো থেকো, ভালোবাসা; এই শীতে, ভালো থেকো একজোড়া চায়ের কাপ থেকে ওঠা ভাপে।

আনিসুল হক : সাহিত্যিক ও সাংবাদিক