ইংরেজি নববর্ষ অতি মনোহর

যেকোনো উৎসব উদ্‌যাপনে মজাদার খাবার রান্না করতে ভালোবাসেন বাঙালি। মডেল: সাফা কবির, ছবি: নকশা
যেকোনো উৎসব উদ্‌যাপনে মজাদার খাবার রান্না করতে ভালোবাসেন বাঙালি। মডেল: সাফা কবির, ছবি: নকশা

বাঙালি যথেষ্ট ভাগ্যবান জাতি। তারা বছরে দুইবার নতুন বছরের আনন্দ উদ্‌যাপন করতে পারে। এই দুটি নতুন বছরের পার্থক্য শুধু ঋতুতে। একটির শুরু গ্রীষ্মে, অন্যটির শুরু শীতে। গ্রীষ্ম বা শীত যা–ই হোক না কেন, নতুন বছরকে বরণ করার আনন্দ সে অনির্বচনীয়! খ্রিষ্টীয় নতুন বছর সোজা বাংলায় আমরা যাকে বলি ইংরেজি নববর্ষ, তাকে বরণ করার মধ্যে একটা ‘রকিং’ ব্যাপার আছে। কেন যেন আমাদের বাঙালি মানসে এই ইংরেজি নববর্ষ মানেই বারবিকিউ পার্টি, হুডখোলা জিপ বা হাউস্পিড বাইক, চামড়ার জ্যাকেট, নীল জিনস, মেটাল মিউজিক আর সেই সঙ্গে অদম্য তারুণ্য মিশে আছে। হয়তো ব্যাপারটা ইউরোপীয় বলে, হয়তো ব্যাপারটার সঙ্গে আমাদের প্রায় ২০০ বছরের ‘প্রতিপালক’ ইংরেজদের প্রত্যক্ষ যোগাযোগ আছে বলেই।

আজ এই একুশ শতকের প্রায় সিকি ভাগ বয়স চলে যাওয়ার কালে বাঙালি এই খ্রিষ্টীয় নতুন বছরকে যেভাবে নিজেদের মতো করে উদ্‌যাপন করে, গত শতকের ষাট, সত্তর বা আশির দশকেও ব্যাপারটা সে রকম ছিল না। সাধারণ্যে ডিসেম্বরের ৩১ তারিখ বা জানুয়ারির ১ তারিখ বিশেষ কোনো অর্থবহ ব্যাপার ছিল না। এলিট ক্লাসের পালনীয় একটা অনুষ্ঠান ছিল এই ‘নিউ ইয়ার’। তাতে সেই ক্লাসের তরুণ-তরুণীদের অংশগ্রহণই ছিল মূল ব্যাপার। সাধারণ বাঙালি ছিল দূরবর্তী দর্শকমাত্র। তবে মধ্যবিত্ত পরিবারগুলোতে কিছুটা চর্চা ছিল, বিশেষ করে যেসব পরিবারের প্রধান ব্যক্তিটি চাকরিজীবী ছিলেন। কারণ, নতুন বছরের প্রথম দিনটিতে ছুটি থাকত। আর কে না জানে যে ছুটি থাকলে কর্তাটি বাড়িতেই থাকবেন। আর কর্তা বাড়িতে থাকলে বাড়িতে কিছু ভালোমন্দ খাওয়া হবে। এই ভালোমন্দ খাবারের সূত্র ধরেই বাঙালি মধ্যবিত্ত মনে রাখত ইংরেজি নতুন বছরের কথা। তবে হ্যাঁ, সাহেবী মালিকানা আর সাহেব বড়কর্তা থাকার ফলে চা–বাগান ছিল নিউ ইয়ার উদ্‌যাপনের গুরুত্বপূর্ণ ঘাঁটি। চার্চ এবং খ্রিষ্টান ধর্মাবলম্বী মানুষের সংখ্যা চিরকালই বাংলাদেশে কম। কিন্তু এই কমিউনিটিরও গুরুত্বপূর্ণ অবদান আছে নিউ ইয়ার উদ্‌যাপনকে বাংলাদেশের সাধারণ মানুষের কাছে নিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে।

তারও আগে, ব্রিটিশ আমলে সম্ভবত বাঙালি ব্যাপক পরিমাণে দ্বিধান্বিত ছিল খ্রিষ্টীয় নববর্ষ পালনের ব্যাপারে। এর বড় কারণ ছিল, এই নতুন বছরের সঙ্গে বাঙালি কৃষি সংস্কৃতির কোনো রকম সম্পর্ক না থাকা, শাসক ইংরেজদের পালন করা একটা অনুষ্ঠানকে নিজেদের করে ভাবতে না পারা। সে জন্য কখনো কখনো বাঙালি মানস যে কিছুটা ব্যঙ্গের চোখেই দেখত ‘গোরা’ সাহেবদের এই আচার পালন, সেটা বোঝা যায় ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্তের ‘ইংরাজী নববর্ষ’ নামে লেখা একটি কবিতায়। কবি ব্যঙ্গ করে বলছেন, ‘নিরন্ন বায়ান্ন দেব ধরিয়া বিক্রম।/ বিলাতীর শকে আসি করিলা আশ্রম।।/ খ্রীষ্টমতে নববর্ষ অতি মনোহর।/ প্রেমানন্দে পরিপূর্ণ যত শ্বেত নর।।’ সে সময়ের নিরিখে এই ব্যাপারগুলো স্বাভাবিক ছিল। এই ব্যঙ্গ আবার স্বাধীনতা–উত্তর বাংলাদেশে কিছুটা অহংকার হিসেবে ধরা দিয়েছিল। আশির দশকের একটি ঢাকাই সিনেমায় দেখা যায়, সদ্য বড়বাবু হওয়া এক তরুণ নায়ক তাঁর অধীনস্থকে বলছেন, ‘এখন থেকে শ্রমিকদের বেতন দেওয়া হবে বাংলা মাসে। যান, নোটিশ দিন।’ কিন্তু বাঙালির এই ‘অহংকার’ খুব বেশি দিন টেকেনি। গত শতকের নব্বইয়ের দশক–পরবর্তী সময়ের ব্যাপক গোলকায়নের ফলে ইংরেজি নববর্ষ পালনের ধারা বানের পানির মতো ঢুকে গেছে বাঙালির জীবনে। শহুরে মানুষ তো বটেই, গ্রামীণ পরিসরেও পয়লা জানুয়ারিতে নতুন বছর পালনের একটা বাতাবরণ তৈরি হয়েছে। সেটা পান্তা–ইলিশ আর অষ্টব্যঞ্জনসহযোগে হয়তো নয়। কিন্তু সকালে উঠে হাসিমুখে দুটো কথা বলে, একটু ভালোমন্দ খাবারের আয়োজন করে ইংরেজি নববর্ষ পালিত হচ্ছে।

তারপরেও যে কথাটি বলতেই হয় সেটি হচ্ছে, নিউ ইয়ার পালনের হিড়িক বা প্রবণতা মূলত তারুণ্য–নির্ভর। নতুন বছরে নিয়ম করে বাইরে খাওয়া, মেসেজিং, উপহার দেওয়া থেকে এর যাবতীয় ইভেন্টে তরুণদেরই দেখা যায় সামনের সারিতে। আলো–ঝলমলে সুসজ্জিত শহরে মধ্যরাতে বন্ধুদের সঙ্গে খোলা জিপে কিংবা জ্যাকেট গায়ে বাইকে চড়ে শহরময় ঘুরে বেড়ানোর যে স্বাধীনতা, যে আনন্দ, তাতে তরুণদের অধিকারই প্রধান। বয়স্করা যেহেতু সাবধানী ,তাই তাঁদের দৌড় খুব বেশি হলে রুফটপ রেস্টুরেন্টের খোলা আকাশ। সামনে পরিবার কিংবা বন্ধুবান্ধব এবং সুস্বাদু খাদ্য-পানীয়।

এতক্ষণ যা বলেছি তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য অংশজুড়ে আছে খাদ্য। নতুন বছর পালন হবে আর সামনে পছন্দের সুস্বাদু খাবার থাকবে না, শুধু বাঙালি নয়, পৃথিবীর কোনো জাতির মানুষই মনে হয় সেটা মেনে নিতে পারে না। সেখানে আবার ‘খাদ্য রসিক’ হিসেবে বাঙালির কিঞ্চিৎ খ্যাতি আছে। হ্যাঁ, পান্তা-ইলিশ বা অষ্টব্যঞ্জনের মতো নির্দিষ্ট কোনো ব্যাপার এখনো নিউ ইয়ারকে ঘিরে গড়ে ওঠেনি বটে। তাতে নিউ ইয়ারি খানাখাদ্যের সংস্কৃতিতে খুব উনিশ–বিশ হয়েছে, সেটা বলা যাবে না। তারকা হোটেল থেকে গলির রেস্টুরেন্টের ভিড় দেখলে সেটা বোঝা যায়। এ ছাড়া রসিকজনের রান্নাঘরের খোশবুতে প্রতিবেশীর ঘুম যে হারাম হয়ে ওঠে, তা না বললেও চলে।

নিউ ইয়ারের খাবার হিসেবে চপ-কাটলেটের যুগ এখন আর নেই। আছে ভারতীয় বংশোদ্ভূত চৈনিক খাদ্যের কদর, মোগলাই ঘরানার হেভি স্পাইসি হট খাবারের সুনাম, আছে বিরিয়ানির স্পেশাল কদর। নিউ ইয়ার ইউরোপীয় প্রথা হলেও বাঙালি তো আর কাঁটা চামচে খুটে খুটে খাবার খাবে না। খাবে কবজি ডুবিয়ে নালে–ঝোলে। তাই বরং চলুন এত কথা বাদ দিয়ে বাংলাদেশ থেকে হারিয়ে যাওয়া একটা বিরিয়ানি রান্না শিখে নেওয়া যাক।

সুনামগঞ্জ অঞ্চলের মাঝিমাল্লাদের মধ্যে প্রচলিত ছিল এই বিরিয়ানি রান্নার ঘরানা। এখন আর পাবেন বলে মনে হয় না। তাই এই বিরিয়ানির নাম দেওয়া হয়েছে ‘মাঝিদের বিরিয়ানি’।

শুভ নববর্ষ। শান্তিতে-সমৃদ্ধিতে, সুখাদ্যে-সুবাসে ভরে উঠুক বাংলাদেশ।

লেখক: লোকসংস্কৃতি–িবষয়ক গবেষক