স্থাপত্য হয়ে উঠুক সবুজের কবিতা

সবুজঘেরা আবাসনই আমরা চাই। ছবি: সংগৃহীত
সবুজঘেরা আবাসনই আমরা চাই। ছবি: সংগৃহীত

বিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝিতে যখন বিশ্বায়নের জয়জয়কার, মনে হচ্ছিল পৃথিবীর তাবৎ সুন্দর বিষয়গুলো বিশ্বায়িত হবে। দেশে দেশে অর্থনীতির ফারাক সংকুচিত হবে। বিশ্বায়িত হবে মানুষে মানুষে বিশ্বাস, শ্রদ্ধা আর ভালোবাসা। কিন্তু দুঃখের সঙ্গে এই পৃথিবী দেখল যে বিশ্বায়িত হলো দেশে দেশে যুদ্ধ, অস্ত্র, হিংসা, বিদ্বেষ, অবিশ্বাস আর বিভিন্ন অবয়বে কার্বন। আর সরলভাবে বললে, এই কার্বনের প্রসার একাই যথেষ্ট এই পৃথিবীকে বসবাসের অযোগ্য করে তুলতে।

 সুতরাং এই ছোট্ট পৃথিবীকে বসবাসের জন্য আমাদের বিশ্ববাসীকে একত্রে কাজ করতে হবে। এটাই সত্য। আর এই যাত্রায় স্থপতিরা হচ্ছেন একদল মানুষ, যাঁরা জলবায়ু পরিবর্তন অনুধাবন করতে পারেন সামনের সারিতে দাঁড়িয়ে। স্থপতিমাত্রই কাজ করেন পরিসর আর পরিবেশ নিয়ে। এদের মধ্যকার মধ্যস্থতা নিয়ে। সুতরাং একজন স্থপতির জন্য জলবায়ু পরিবর্তনের কারণ ও ফল সম্পর্কে গভীরভাবে জানা গুরুত্বপূর্ণ। বিজ্ঞানীদের মতানুসারে, বিশ্বের তাপমাত্রা আর ৬ ডিগ্রি বাড়লেই পৃথিবী ধ্বংস হওয়ার উপক্রম হবে। গবেষণায় দেখা যায়, ২০৮০ সালে বাংলাদেশের তাপমাত্রা বেড়ে যাবে দুই ডিগ্রি সেলসিয়াস। তাপমাত্রা বাড়ার ফলে সমস্যা হবে ক্যাসকেডিং বা বহুমাত্রিক এবং এর করুণ পরিণতি ভোগ করবে বাংলাদেশের মানুষসহ আশপাশের দেশগুলো। এমতাবস্থায় এটি স্পষ্ট যে জলবায়ু পরিবর্তনের বিরুদ্ধে নগরকেন্দ্রিক স্থাপত্যচর্চায় স্থপতিদের ভূমিকা বিশাল সমুদ্রে এক বিন্দু জলের ফোঁটার মতো। তাই কেবল বৃহত্তর স্তর থেকে ক্ষুদ্রতম স্তর পর্যন্ত মানব সম্প্রদায়ের একটি সম্মিলিত এবং সংঘবদ্ধ জোর প্রচেষ্টাই পারে এই ধরণিকে রক্ষা করতে। তবে জলবায়ু নিয়ে সচেতন পদক্ষেপ স্থপতিদের নেতৃত্বে হওয়া একান্তভাবে কাম্য। স্থপতিরা জানেন, একটি নগর স্থাপত্যে যত উপাদান, যেমন দালান, দালানের মাঝখানের জায়গাগুলো, রাস্তা, ফুটপাত, উদ্যান, মাঠ, গাছগাছালি, পাখপাখালি সবকিছুতে কীভাবে সমন্বয় করতে হয়। এখন স্থপতিদের চ্যালেঞ্জটা হলো, কীভাবে কার্বন ফুটপ্রিন্ট কমিয়ে প্রকৃতিতে প্রাধান্য দিয়ে একটি টেকসই সমন্বিতরূপে নগর নির্মাণ করা যায়। দরকার দর্শনভিত্তিক স্থাপত্যচর্চার। যেমনটি বলেছেন কবি জালালউদ্দিন রুমি, ‘গাছের মতো হও, ঝেড়ে ফেলো মৃত পাতা’।

রফিক আজম
রফিক আজম

এই প্রেক্ষাপটে ঢাকার দিকে তাকালে দেখি, ঢাকা হচ্ছে বিশ্বের একটি অত্যন্ত জনবহুল শহর এবং জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে ঝুঁকিপূর্ণ। নথি অনুযায়ী, বাংলাদেশ হলো জলবায়ু পরিবর্তনে সব থেকে কম ভূমিকা রাখা সবচেয়ে বেশি ভুক্তভোগী একটি দেশ। বাংলাদেশ পার ক্যাপিটায় মাত্র শূন্য দশমিক ৪ মেট্রিক টন কার্বন উৎপাদন করে থাকে, যেখানে যুক্তরাষ্ট্র করে থাকে ১৭ মেট্রিক টন এবং যুক্তরাজ্য করে ৭ দশমিক ১ টন। এ কথা সত্যি যে ‘বিশ্বায়ন’ শব্দটি নতুন হলেও জলবায়ুর ক্ষেত্রে পৃথিবী বরাবরই ছিল বিশ্বায়িত। তাপ, দূষণ, মানবজাতির দায়িত্বহীন কর্মকাণ্ড, কোনো রকম বাধাবিঘ্ন ছাড়াই ছড়িয়ে পড়তে পারে বিশ্বময়। তাই ঢাকা শহরের সমস্যা আসলে স্থানিক নয়, বৈশ্বিকও বটে।

বিশ্বের প্রসঙ্গে বাংলাদেশের প্রসঙ্গকে বোঝা, গোটা দেশের জলরাশিকে (হাইড্রোলজি) বোঝা খুব জরুরি শুধু স্থাপত্যের বিচারে একটি দাগ টানার জন্য। একটি সবুজ নগরীর জন্য আমাদের জানতে হবে ইতিহাস, প্রত্নতত্ত্ব, নৃতত্ত্ব, সামগ্রিক মনস্তত্ত্ব, ভূবিজ্ঞান, সূর্য, বাতাসের গতিপথ ইত্যাদি।

সবকিছুর পরে এটাও সত্য যে বাংলাদেশ বসে নেই। বিশ্বের সঙ্গে যোগাযোগ রেখে কাজ করে যাচ্ছে জলবায়ু পরিবর্তন নিয়ে। অতি সম্প্রতি ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন একটি প্রকল্প হাতে নিয়েছে ‘জল সবুজে ঢাকা’ নামের, যেখানে ৩১টি খেলার মাঠ আর পার্ককে সঠিকভাবে পুনরুজ্জীবিত করা হচ্ছে, যাতে নগরবাসী এগুলো অবাধভাবে ব্যবহার করতে পারে। এ জন্য প্রধানত এখানে থাকছে না আর কোনো নিরেট সীমানাদেয়াল। এগুলো দার্শনিকভাবে হয়ে উঠবে জনগণের জন্য উন্মুক্ত আর শহরের একটি অংশ। এতে প্রতিদিন হাজার হাজার মানুষ যাতায়াত করবে সবুজে ঘেরা পরিবেশের মধ্য দিয়ে এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্ত। আশা করি এই প্রকল্পের সার্থকতা ঢাকাকে খানিকটা হলেও টেকসই সবুজের দিকে ধাবিত করবে।

সামগ্রিকভাবে বলতে গেলে, বাংলাদেশ হলো বিশ্বের সবচেয়ে বড় ব–দ্বীপ। ৫০টির বেশি নদ–নদী, ১ হাজার ২০০–এর অধিক খাল–বিল উত্তরের হিমালয় থেকে পানি বয়ে নিয়ে আসে আর এঁকেবেঁকে ধাবিত হয়ে মিলিত হয় বঙ্গোপসাগরে। পানির প্রাচুর্য আর মানুষের সঙ্গে পানির গভীর সম্পর্ক বাংলাদেশকে পরিণত করেছে এক কবিতার দেশে। এই কবিতা আরও সমৃদ্ধ হয় বর্ষাকালে যখন এ দেশের ভূদৃশ্যের ক্যানভাসে পানিপ্রধান হয়ে নেতৃত্ব দেয়। বর্ষার পর যখন পানি কমতে থাকে, রেখে যায় পলিমাটি তার ভালোবাসার চিহ্নস্বরূপ। চাষযোগ্য হয়ে ওঠে জমি আর সবুজে সবুজে ছেয়ে যাওয়া প্রান্তর দোল খায় বাতাসের ছোঁয়ায়।

আমাদের শহরগুলোও হওয়া দরকার এই আবেগে তৈরি। যেখানে শহর হবে জলরাশি, সূর্যের আলো আর বাতাসের লীলাভূমি, ধাবিত হবে কাব্যিক এক নগরীর দিকে।

লেখক: স্থপতি