ধ্যানে প্রশান্তি

ধ্যানের জন্য বেছে নিন নিরিবিলি জায়গা। মডেল: শবনম ফারিয়া, ছবি: অধুনা
ধ্যানের জন্য বেছে নিন নিরিবিলি জায়গা। মডেল: শবনম ফারিয়া, ছবি: অধুনা

চৈতির (ছদ্মনাম) সমস্যা হচ্ছে কোনো কথা সহজভাবে নিতে পারে না। আড্ডায় এক বন্ধু তাকে ধান্দাবাজ বলেছে। সঙ্গে সঙ্গে চৈতির দুই কান গরম হতে শুরু করে, বুক ধড়ফড় করতে থাকে। মুখ-চোখ শক্ত করে বন্ধুদের মধ্যে স্বাভাবিক থাকার চেষ্টা করে, কিন্তু সমস্যা কাটে না। দিনের পর দিন এসব শারীরিক প্রতিক্রিয়া চলতেই থাকে। চৈতি অসুখী হয়ে যাচ্ছিল। জীবন নিয়ে হতাশ, নিজেকে নিয়ে বিরক্ত। একসময় সে মেডিটেশন বা ধ্যান করতে শুরু করল। জটিল কোনো ব্যাপার না। ঘরের মধ্যে শান্ত হয়ে বসে কতগুলো ব্যাপার খুব মনোযোগের সঙ্গে করতে হয়। কাজটা করতে করতেই সে খেয়াল করল ভেতর থেকে সে বদলে যাচ্ছে। তুচ্ছ, ছোটখাটো ব্যাপারগুলো টেনে টেনে লম্বা করছে না। আগে যে কাজের কথা ভাবলে ঘাম ছুটে যেত এখন সেটা শান্তভাবে করতে পারছে।
মেডিটেশন অবশ্য এখন মোটেই অচিন কোনো ব্যাপার না। অনেকেই জানেন, ধ্যান বা মেডিটেশন এখন কেবল নির্জনবাসী সাধু-সন্ন্যাসীর সাধনা না, নাগরিক জীবনযাপনে অভ্যস্ত ব্যক্তিরাও মেডিটেশন করছেন। বিজ্ঞানীরা অনেক দিন ধরেই এ ব্যাপারে গবেষণা করছেন এবং কতগুলো নির্ভরযোগ্য সূত্র থেকে আমরা জানি মেডিটেশন সত্যিই শক্তিশালী। যেমন হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক সারা লাজার তাঁর গবেষণায় দেখিয়েছেন, নিয়মিত মেডিটেশন করলে মস্তিষ্কের শক্তি বাড়ে। বৈজ্ঞানিক পরিভাষায় বললে মস্তিষ্কের গ্রে ম্যাটার পুনর্গঠনে সাহায্য করে। আপনার চিন্তাশক্তি বাড়বে, দ্রুত শিখতে পারবেন এবং অনায়াসে মনে রাখতে পারবেন। গবেষণা থেকে জানা যাচ্ছে, মনকে প্রশান্ত রাখতে, রোগ প্রতিরোধ কিংবা নিরাময়ের ক্ষেত্রেও মেডিটেশন খুব কার্যকর।
এ প্রসঙ্গে ঢাকার শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজের মনোরোগবিদ্যা বিভাগের সহকারী অধ্যাপক আহসান উদ্দিন আহমেদ বললেন, ‘অ্যাংজাইটি, ডিপ্রেশন, ইনসমনিয়া, মাইগ্রেনের মতো মানসিক চাপজনিত মনোদৈহিক রোগগুলো প্রাথমিক পর্যায়ে থাকলে মেডিটেশনের মাধ্যমে
সারিয়ে তোলা সম্ভব। তবে জটিল পর্যায়ে পৌঁছে গেলে চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী চিকিৎসা গ্রহণ করতে হবে। পাশাপাশি ধ্যানের চর্চা চিকিৎসার কার্যকারিতা বাড়িয়ে দিতে পারে।’

নিজে নিজে ধ্যান করতে চাইলে
যাঁরা ধ্যান করার কথা ভাবছেন, খুব সহজ উপায়ে এখনই শুরু করে দিতে পারেন। নিয়মিত ধ্যান করেন এমন কয়েকজনের সঙ্গে কথা বলে এবং ইন্টারনেট ঘেঁটে জানা গেল কীভাবে নিজে নিজে ধ্যান করা যায়।
ধ্যানের জন্য বেছে নিন কোনো নিরিবিলি জায়গা। মেডিটেশন শুয়ে বা বসে দুভাবেই করা যায়। শুয়ে করলে ঘুমিয়ে পড়ার সম্ভাবনা থাকে। ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিক হিসেবে কোনো ধীর লয়ের যন্ত্রসংগীত ব্যবহার করতে পারেন। শুরুতে কাছাকাছি সময়ে ঘটে যাওয়া কোনো আনন্দদায়ক ঘটনা মনে করুন। এবার চোখ বন্ধ করুন। গভীরভাবে কিছুক্ষণ শ্বাস নিন। ভাবতে থাকুন শরীরের প্রতিটি অঙ্গ শিথিল হয়ে আসছে। এরপর খুব ধীরে ধীরে শ্বাস নিন কয়েকবার। শ্বাস-প্রশ্বাসের দিকে খেয়াল রাখুন। লক্ষ করুন কীভাবে বাতাস নাকের ভেতর দিয়ে ফুসফুসে ঢুকছে, আবার নাক দিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছে। মন বিক্ষিপ্ত হলে আবার শ্বাস-প্রশ্বাসে ফিরিয়ে আনুন।
শ্বাস–প্রশ্বাসের এই ব্যায়াম চালিয়ে যাওয়াটা মেডিটেশনের একটা ধরন। হাতে সময় থাকলে এর সঙ্গে যোগ করতে পারেন নিচের অংশটি।
কল্পনা করুন ধীরে ধীরে আপনি আপনার মনের গহিনে ঢুকে পড়েছেন। এবার মনমতো সাজিয়ে নিন সেই স্থান। আপনার প্রিয় সে পরিবেশে প্রকৃতির সঙ্গে একাত্ম হোন। নিজের প্রয়োজন অনুসারে মনকে নির্দেশনা দিন। ইতিবাচক চিন্তা করুন। নিজের মধ্যে যে পরিবর্তন আনতে চান তার ছবি নিখুঁতভাবে কল্পনায় ফুটিয়ে তুলুন। ভাবতে থাকুন আপনার মধ্যে সত্যি সত্যি এই পরিবর্তন এসেছে এবং এই পরিবর্তনের আনন্দ অনুভব করতে থাকুন।
এ ছাড়া আরও অনেক উপায়েই মেডিটেশন করা যায়।

পাশে আছে অনেক কিছু
গাইডেড মেডিটেশন ট্র্যাকে পুরো প্রক্রিয়া শুনতে শুনতে ধ্যান করতে পারেন। প্রচুর মেডিটেশন-উপযোগী মিউজিক, গাইডেড মেডিটেশন ট্র্যাক মিলবে ইন্টারনেটে। বাজারে পাওয়া যায় মেডিটেশন-বিষয়ক বই। হেডস্পেস, কোয়ান্টাম মেথড, চোপরা সেন্টার্ড লাইফস্টাইল ইত্যাদি ওয়েবসাইটেও ঢুঁ মেরে দেখতে পারেন। নামিয়ে করে নিতে পারেন মাইন্ডবডি কানেক্ট, হেডস্পেস, ওম্ভানা, স্মাইলিং মাইন্ডের মতো মেডিটেশন অ্যাপ। আর একা একা বুঝে উঠতে না পারলে কোর্স তো আছেই।

শুভ হোক যাত্রা
যে কারও জীবনে মেডিটেশন হতে পারে উপকারী বন্ধু। তবে এর সুফল রাতারাতি ধরা দেবে না, প্রয়োজন নিয়মিত চর্চা। সকালে বা রাতে অল্প কিছুক্ষণের ধ্যান আপনার জীবনে আনতে পারে বড়সড় পরিবর্তন।
সারা দিনে অনেকটা সময়ই তো আমরা হেলাফেলায় নষ্ট করি, তার থেকে কিছুটা মেডিটেশনের জন্য বরাদ্দ করেই দেখুন না!