আছে দুঃখ, আছে মৃত্যু

জমিলা বেগম (ছদ্মনাম) ও মোবারক সাহেব সপ্তাহ দুয়েক আগে এক দুর্ঘটনায় তাঁদের ২১ বছর বয়সী ছেলেকে হারিয়েছেন। এর পর থেকেই জমিলা বেগম কারও সঙ্গে কথা বলছেন না। একদম চুপ। রাতে ঘুমাচ্ছেন না। খুব সামান্যই খাচ্ছেন, তা–ও অনেক জোরাজুরির পর। পরিবারের সদস্য আর আত্মীয়স্বজন তাঁকে খুব আগলে আগলে রাখছেন, মৃত ছেলের ছবি আর ব্যবহার্য সামগ্রী সব লুকিয়ে ফেলছেন, পাছে সেগুলো দেখে জমিলা বেগম আরও কষ্ট পান। কিন্তু কিছুতেই তিনি স্বাভাবিক হচ্ছেন না। জমিলা বেগমের মতো অনেকেই প্রিয়জনের মৃত্যু বা বড় কোনো ক্ষতি বা দুর্ঘটনার পর তীব্র শোকে বিহ্বল হয়ে পড়েন। এটাই স্বাভাবিক। এই শোকবিহ্বল অবস্থায় আশপাশের পরিজন আর স্বজন সব সময়ই চান একজন মানুষ যেন তীব্র শোক কাটিয়ে স্বাভাবিক হয়ে ওঠে। এ জন্য তাঁকে সান্ত্বনা দেওয়ার চেষ্টা করেন। কিন্তু অনেক সময় সান্ত্বনা দেওয়ার প্রক্রিয়া আর পদ্ধতি সঠিক হয় না, ফলে শোকের তীব্রতা কমে না বরং বাড়তে থাকে এবং শোক দীর্ঘমেয়াদি হয়। তীব্র শোকগ্রস্ত অবস্থায় কেউ কেউ একেবারে নিস্তব্ধ হয়ে যান, কেউ অতিমাত্রায় ভেঙে পড়েন, কেউ অপ্রত্যাশিত আচরণ করতে থাকেন। কখনো সে বিশ্বাস করতে চায় না তার আপনজনের মৃত্যু হয়েছে। ভাবে ‘এটা হতে পারে না’, ‘এটি মিথ্যা!’ তীব্র শোকের একপর্যায়ে হতাশা থেকে নিজের ভেতরে একটা ‘সব হারানোর ক্ষোভ’ বা ‘রাগ’ তৈরি হয়। এই রাগ হতে পারে আশপাশের মানুষ আর ঘটনার ওপর আবার কখনো মৃত আপনজনের ওপরও! তীব্র শোক থেকে বিষণ্নতায় আক্রান্ত হতে পারেন কেউ কেউ। এ সময় ক্রমাগত কান্নাকাটি, খাদ্য গ্রহণে অনীহা, নিজের যত্ন না নেওয়া, ঘুমের সমস্যা ইত্যাদি দেখা দিতে পারে। একাকিত্বে ভুগতে থাকেন অনেকেই।

মৃত্যু অবশ্যম্ভাবী, যাকে কখনোই জয় করা যাবে না। কিন্তু মৃত্যুশোককে জয় করা যায়, এ জন্য পরিজন–বন্ধুদের সহায়তা যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ। মৃত্যুর সংবাদ জানার পরপরই তীব্র শোকের শুরু। তখন থেকেই স্বজন–পরিজনদের দায়িত্ব হচ্ছে একজন শোকাতুর ব্যক্তিকে স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনা। এ জন্য প্রথমেই যা করতে হবে, তা হচ্ছে শোকগ্রস্ত ব্যক্তির প্রতি কোনো করুণা (সিমপ্যাথি) প্রদর্শন করা যাবে না। বরং তার প্রতি সমমর্মী (এমপ্যাথি) হতে হবে। তিনি যে কষ্টের মধ্য দিয়ে যাচ্ছেন, তা যে পরিজনেরা বুঝতে পারছে, সেটি বোঝাতে হবে। মৃত ব্যক্তি আর তার মৃত্যুর বিষয়টি বেশ স্পষ্ট করে জানাতে হবে। কোনো ধোঁয়াশা বা লুকোচুরি করা চলবে না। এতে বিহ্বলতা আরও বাড়বে।

 শোক একটি স্বাভাবিক আবেগীয় প্রতিক্রিয়া, শোক প্রকাশের সুযোগ দিতে হবে আর শোককে কাটিয়ে ওঠার জন্য সময় দিতে হবে। কারও শোকের প্রকাশকে কখনোই বাধাগ্রস্ত করা চলবে না তেমনি শোকের প্রতিক্রিয়া যাতে দীর্ঘ না হয় সেদিকেও লক্ষ রাখতে হবে। সাধারণত ৬-৮ সপ্তাহের মধ্যে মৃত্যুশোকের তীব্র আর তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া কমে যায়—এর পর দুঃখ বোধ থাকতে পারে কিন্তু শোকের প্রতিক্রিয়া (গ্রিফ রিঅ্যাকশন) সাধারণত থাকে না। কখনোই এমন কোনো কথা বলা যাবে না যাতে তার শোক আরও বেড়ে যায়—যেমন ‘আপনার মতো মানুষ কেন এত ভেঙে পড়ছেন, শক্ত হোন’ বা ‘যা হয়েছে এটা নিয়ে ভেবে আর কী হবে’; বরং বলতে হবে ‘আপনার মনে এ সময় কষ্ট হওয়াই স্বাভাবিক, আমরাও খুব কষ্ট পাচ্ছি’ অথবা বলতে পারেন ‘যা হয়েছে এই ক্ষতি কখনোই পূরণ হওয়ার নয়’। অর্থাৎ যত দূর সম্ভব পোশাকি কথা বাদ দিয়ে বাস্তবসম্মত কথা বলতে হবে। তার শোকের প্রকাশকে সম্মান করতে হবে, এটিকে হালকা কথায় উড়িয়ে দেওয়া যাবে না। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে শোকের প্রতিক্রিয়া দেওয়ার সময় এমন কোনো ছবি দেবেন না বা এমন কোনো উক্তি করবেন না, যা স্বজনদের শোককে আরও বাড়িয়ে তোলে।

আপনার সঙ্গে যদি মৃতের স্বজনের সম্পর্ক খুবই দাপ্তরিক হয়, তবে তাকে একটি লিখিত শোকবার্তা পাঠাতে পারেন। শোকের সময় একজন মানুষ তার ব্যক্তিগত বা পেশাগত অনেক প্রয়োজন মেটাতে ব্যর্থ হন, তখন আশপাশের মানুষের উচিত সেই প্রয়োজনগুলো মিটিয়ে ফেলার চেষ্টা করা। যেমন কারও দাপ্তরিক ছুটি বা জরুরি নথির জন্য অফিসে যেতেই হবে বা একটি বড় পরীক্ষা আছে যা বাদ দেওয়া যাবে না, তখন তাকে সঙ্গ দিন বা তার বদলে কাজটি পরিজনেরা নিজেরাই করে ফেলুন। তাকে একলা রেখে যাবেন না, সব সময় কেউ না কেউ কাছে থাকবেন, একটা ভুল ধারণা আছে যে শোকের সময় শোকাতুর ব্যক্তিকে একা থাকতে দিতে হয়, মূলত শোকের সময় একসঙ্গে থাকলে শোক দ্রুত প্রশমিত হয়। অনেকে শোকগ্রস্ত অবস্থায় গোসল করেন না, ঠিকমতো খাদ্য গ্রহণ করেন না, ঘুমান না—তাদের নিজেদের যত্ন নেওয়ার বিষয়ে উৎসাহিত করাটাও স্বজনদের অন্যতম দায়িত্ব। আর একটি বিষয় পরিজনেরা প্রায়ই করে থাকেন যে মৃত ব্যক্তির ছবি লুকিয়ে ফেলেন, তার স্মৃতিগুলো সরিয়ে রাখেন, মৃত ব্যক্তি সম্পর্কে শোকগ্রস্ত স্বজনের সামনে কথা বলেন না—এটি কিন্তু শোক কমানোর বদলে শোকের প্রতিক্রিয়াকে আরও দীর্ঘায়িত করে। এগুলো না করে মৃত ব্যক্তির জীবনের ভালো স্মৃতিগুলো বেশি বেশি আলোচনায় আনতে হবে, তার ছবি দেখতে হবে, স্মৃতিচারণা করতে হবে, স্মারকগুলো সামনে সাজিয়ে রাখতে হবে এবং নিজ নিজ ধর্ম অনুযায়ী প্রার্থনা করতে পারেন। এতে করে মৃত্যুর বিষয়টি স্বাভাবিক হবে এবং শোক কমতে শুরু করবে। কারও মৃত্যুর পর তার শোকগ্রস্ত স্বজনদের কখনোই কোনো কিছুর জন্য দায়ী করে কথা বলা যাবে না—যেমন ‘যদি এটা না করতে তাহলে তিনি হয়তো আরও কিছুদিন বেঁচে থাকতেন’ বা ‘তিনি বেঁচে থাকতে তুমি তাকে অনেক কষ্ট দিয়েছ’ কিংবা ‘তার চিকিৎসায় আপনি অনেক অবহেলা করেছেন’ এ ধরনের দায় কোনো স্বজনের ওপরের চাপালে তার শোক অনেক বেড়ে যাবে। এর চেয়ে যে কথাগুলো বলা উচিত, তা হচ্ছে ‘তুমি ওনার জন্য যা করেছে, তা অকল্পনীয়’ বা ‘তার বেঁচে থাকাকে সুন্দর রাখার জন্য তোমার অবদান তার জীবনে সবচেয়ে বেশি ছিল’ ইত্যাদি প্রশংসামূলক বাক্য বলতে হবে। উপদেশ বা পরামর্শ কম দিন বরং একজন শোকগ্রস্ত ব্যক্তির কথা মন দিয়ে শুনুন—তার কথার উত্তর দিন। তাকে আবেগ প্রকাশের সুযোগ দিন তবে কখনোই কান্নাকাটি করার জন্য চাপাচাপি করবেন না। সম্পর্কে টানাপোড়েন থাকতেই পারে—মৃত্যুর পর সেই টানাপোড়েন নিয়ে আলাপ-বিলাপ না করে সম্পর্কের ইতিবাচক অংশগুলো নিয়ে বেশি বেশি কথা বলতে হবে।

আপনি নিজে আপনার শোকের সময় কীভাবে শোককে কাটিয়ে উঠেছিলেন সে গল্প করবেন না—প্রত্যেকের শোকের ধরন আলাদা, তাই একজনের উদাহরণ আরেকজনের জন্য প্রযোজ্য হবে না। মৃতের বাড়িতে তার ছবি দিয়ে একটি শোকবই রাখতে পারেন—মনে রাখবেন যে এই শোকবই কেবল বিখ্যাত বড় মানুষদের জন্যই নয়—একজন সাধারণ মানুষের জন্যও রাখা উচিত। শোক বইতে দুই লাইন লিখলে যিনি লিখছেন তার নিজের এবং মৃতের স্বজনদের শোককে প্রশমিত করতে সাহায্য করে। শোক কাটাতে ঘুমের ওষুধ বা কোনো ধরনের মাদকের আশ্রয় নেওয়াকে কঠোরভাবে নিরুৎসাহিত করতে হবে—মনে রাখতে হবে যে ‘মৃত্যুশোক’ একটি স্বাভাবিক প্রক্রিয়া—কোনো অসুস্থতা নয় কিন্তু শোকের প্রতিক্রিয়া দীর্ঘতর হওয়া একটি মানসিক সংকট, যাকে বলা হয় ‘অ্যাবনরমাল গ্রিফ রিঅ্যাকশন’ বা শোকের অস্বাভাবিক প্রতিক্রিয়া। এই মানসিক সংকট হতে থাকলে প্রয়োজনে সাইকিয়াট্রিস্টের শরণাপন্ন হতে হবে।

আহমেদ হেলাল : সহযোগী অধ্যাপক, জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট, ঢাকা।