বাচ্চা খেতে চায় না, কী করবেন?

খাওয়া নিয়ে বাচ্চাকে জোর করা উচিত নয়। মডেল: রঙ্গন ও বর্ণা। ছবি: অধুনা
খাওয়া নিয়ে বাচ্চাকে জোর করা উচিত নয়। মডেল: রঙ্গন ও বর্ণা। ছবি: অধুনা

বাচ্চা খেতে চায় না। এ নিয়ে অভিভাবক, বিশেষ করে মায়ের চিন্তার শেষ নেই। নানা উপায়ে মায়েরা শিশুদের খাওয়াতে চেষ্টা করেন। শিশুর বয়স অনুযায়ী না খাওয়ার কারণ ও খাদ্য উপকরণের ভিন্নতা দেখা যায়। বাচ্চা কেন খেতে চায় না? খাদ্যতালিকায় কী উপকরণ রাখবেন—সেটাই দেওয়া হলো।

কারণ

২ থেকে ৬ বছর

এ বয়সী বাচ্চাদের না খাওয়ার পেছনে অনেক কারণ রয়েছে। ছোট বাচ্চাদের খাবার খাওয়ানোর ক্ষেত্রে দুটো ভুল ধারণা রয়েছে। একটা হলো অল্প খাবারে পরিপূর্ণ পুষ্টি দেওয়ার চেষ্টা করা। ধরা যাক, খিচুড়িতে চাল-ডালের চেয়ে সবজি যদি বেশি হয় বা চার-পাঁচ রকমের সবজি হয়, তাহলে খাবারটা স্বাদহীন হয়ে যায়। দ্বিতীয় জিনিস হলো, খাবারটি যদি মিশ্রিত খাবার হয়, তাহলে ওই খাবার বাচ্চা বেশি দিন পছন্দ করে না। তৃতীয় হচ্ছে, একই রকমের খাবার। একই খাবার যদি প্রতিবেলায় দেওয়া হয়, তাহলে ওই খাবার পছন্দ করে না। বাচ্চারা একই রকম খাবার কখনোই খেতে চায় না। বাচ্চাদের খাবার তৈরি সময় একটি জিনিস খেয়াল রাখতে হবে, উপকরণগুলো ঠিক রেখে রান্নার পদ্ধতিটা পরিবর্তন করে নেওয়া।

৬ থেকে ১৪ বছর

এ বয়সে বাচ্চা স্কুলে যাওয়া শুরু করে। শিশুরা ঘুম থেকে উঠেই স্কুলে যায়। স্কুলে যাওয়ার আগে ওই সময়ে বাচ্চা কিছু খেতে চায় না। সকালে না খেয়ে বাচ্চারা স্কুলে যাওয়ার পর যখন ক্ষুধা লাগে, তখন তারা ঘরের খাবার (বাড়িতে বানানো খাবার) না খেয়ে জাঙ্ক ফুড খায়। জাঙ্ক ফুড খাওয়ার ফলে তাদের অল্প একটু খেলেই পেট ভরে যায়। তখন মূল খাবারটা (বাড়িতে বানানো খাবার) খেতে চায় না। ফলে মা বলেন, তাঁর বাচ্চা খাবার খাচ্ছে না।

করণীয়

২ থেকে ৬ বছর

২ থেকে ৬ বছরের বাচ্চাদের খাবার দিতে হবে তিন ঘণ্টা পরপর। খাবারটা হতে হবে ওই বয়সে উপযোগী সুষম খাবার। ২ বছরের একটা বাচ্চা সাধারণত ঘরের তৈরি খাবার খাবে। ভাত, মাছ, সবজি, ডাল, দুধসহ যা যা খাওয়া হয়, তা-ই বাচ্চাদের খাওয়ানো উচিত। বাচ্চাদের খাবারে ঝাল কম দিতে হবে। বাইরের খাবার খাওয়া একদম বন্ধ করে দিতে হবে। বাচ্চা যদি বাড়িতে বানানো খাবার খাওয়ার আগে বাইরের খাবার খায়, তাহলে সে ঘরে রান্না করা খাবার খাবে না। ধরুন, বাচ্চা দুপুরের খাবার দুইটার সময় খাবে, কিন্তু দেখা গেল দেড়টার সময় চিপস বা বিস্কুট খেলো। তাহলে কিন্তু তার ক্ষুধাটা মরে যাবে। ঘরে রান্না করা খাবার খাবে না। বাইরে খাওয়ার পর বাচ্চার পেট ভরে গেল ঠিকই, কিন্তু পরিপূর্ণ পুষ্টি পেল না। ফলে ঘরে রান্না করা খাবার খাবে না। এ জন্য অভিভাবককে একটু সময় নিয়ে বাচ্চাকে পুষ্টিগুণ সম্পন্ন খাবার খাওয়াতে হবে।

একটি খাবার থেকে আরেকটি খাবার গ্রহণের মধ্যে আড়াই থেকে তিন ঘণ্টা বিরতি দিতে হবে। এই বিরতির মধ্যে তাকে পানি খাওয়ানো যেতে পারে, বাইরের খাবার খাওয়ানো যাবে না। তার মানে বাচ্চাকে খিদে লাগিয়ে খাবার দিতে হবে। আরেকটি বিষয় হলো, বাচ্চা যে শুধু ভাতেই খাবে, তা কিন্তু নয়। পরিবারে যে খাবারগুলো রান্না হয়, সে অনুযায়ী বাচ্চাদের খাবার দিতে হবে। যেমন কোনো বাচ্চা ভাত খেতে পারে, আবার কেউ রুটি, কেউবা পরোটা খেতে পারে। চাইলে বাচ্চাকে নুডলস বা কেকও খাওয়ানো যেতে পারে। মায়েরা বাচ্চাদের নিয়ে একটি বিষয় সব সময় বলেন, বাচ্চারা ভাত খেলো না মানে সে কিছুই খেলো না। কিন্তু বিষয়টা কিন্তু তা নয়, বিষয়টা হচ্ছে খাবারে শর্করা, চর্বি, ভিটামিন, মিনারেলের সমন্বয় সুষম আছে কি না, সেটা—যা খাবারের যেকোনো উপকরণেই থাকতে পারে। কোনো বাচ্চা যদি খিচুড়ি খেতে না চায়। সে যদি পুডিং খায় বা বাড়িতে বানানো কেক খায়, তাহলে কোনো সমস্যা নেই। বাচ্চা যেটা পছন্দ করে এবং সেটা যদি তার জন্য উপযুক্ত হয়, তাহলে সেটা আপনি আপনার সন্তানকে খাওয়াতে পারেন।

৬ থেকে ১৪ বছর

এই বয়সী বাচ্চাদের প্রথম না খাওয়ার কারণ হলো স্কুল। প্রত্যেক বাচ্চাকে খাবার খাইয়ে তারপর স্কুলে পাঠাতে হবে। যে খাবার সন্তান অল্প সময়ের মধ্যে নিতে পারে, সেই খাবারটিই স্কুলে যাওয়ার আগে খাওয়াতে হবে। যেমন স্কুলে যাওয়ার আগে সন্তানকে মিল্ক শেক বা দুধের সঙ্গে চিনি মিশিয়ে খাওয়াতে পারেন বা দুধ দিয়ে বানানো অন্য কোনো খাবার। এ খাবার উপকরণটি অল্প সময়ে বানানো যায় এবং অল্প পরিমাণ খেলেও সে পরিপূর্ণ পুষ্টি পাবে। টিফিনের খাবারটি বাড়ি থেকে বানিয়ে দিতে হবে। সেটা হতে পারে তার জন্য বানানো সকালের নাশতা এবং স্কুলের টিফিনটি সন্তানের পছন্দমতো খাবারই দিতে হবে। না হলে সে খাবে না এবং সময়মতো খাওয়াতে হবে। অনেক বাচ্চা স্কুলে না খেয়ে থাকে বা টিফিনে জাঙ্ক ফুড খায়। বিষয়টা অভিভাবকদের খেয়াল রাখতে হবে।

১০ বছরের বেশি বয়সী বাচ্চাদের খাবারের একটা পছন্দ তৈরি হয়ে যায়। তারা তখন বন্ধুবান্ধবের খাবারগুলো দেখে। তাই এ ক্ষেত্রে বাচ্চার পছন্দের কাছাকাছি মানের খাবারগুলো দিতে হবে। মায়ের পছন্দ অনুযায়ী খাবার চাপিয়ে দেওয়া উচিত নয়। টিফিনের খাবার দেওয়ার ক্ষেত্রে বাচ্চার পছন্দকে গুরুত্ব দেওয়া উচিত। সবচেয়ে ভালো হয় বাড়িতে বানানো খাবারের পুষ্টিগুণ সম্পর্কে বাচ্চাকে বুঝিয়ে খাবার খাওয়ানো। ৬ থেকে ১৪ বছরের বাচ্চার সবচেয়ে বেশি পুষ্টিগত ঘাটতি তৈরি হয়। কারণ, এ সময় বাচ্চাদের নিজস্ব একটা পছন্দ তৈরি হয়। কিন্তু বাচ্চা তো তার জন্য কী পরিমাণ পুষ্টি দরকার, সেটা জানে না। ফলে সে যে খাবারটি খায়, তাতে পরিপূর্ণ পুষ্টি থাকে না এবং ঘাটতি তৈরি হয়।

এ বয়সী বাচ্চাদের জন্য একটা বা দুটো ডিম, এক টুকরা মাছ বা মাংস, এক গ্লাস দুধ অবশ্যই রাখতে হবে। এ উপকরণগুলো কীভাবে খাদ্যতালিকায় যুক্ত করা হবে, সেটা তার পারিবারিক খাবারের ধরনের ওপর নির্ভর করবে। কেউ সরাসরি দুধ খাবে, আবার কেউ পুডিং খাবে। আবার কেউবা মিল্ক শেক খাবে। অর্থাৎ যে মিল্ক শেক খায়, তাকে যদি সরাসরি দুধ খেতে দেওয়া হয়, তাহলে সে কিন্তু সেটা খাবে না। তাই পরিবার ও বাচ্চার পছন্দ অনুযায়ী খাবার খাওয়ানোই উচিত।

পুষ্টিবিদ আখতারুন্নাহার আলোর সঙ্গে কথা বলে লিখেছেন তারিকুর রহমান খান