সর্বোচ্চ নিরাপত্তায় এলপিজি সিলিন্ডারে স্মার্ট রান্না

ভালোবেসে সম্প্রতি বিয়ে করেছেন ইউসুফ আলী শিমুল ও জান্নাত জুঁই। শিমুল বেসরকারি চাকরিজীবী আর জুঁই গৃহিণী। রাজধানীর নিউ ইস্কাটন এলাকার একটি ভবনের চিলেকোঠায় টোনাটুনির সংসার তাঁদের। এই দম্পতির বাসায় প্রাকৃতিক গ্যাসের লাইন নেই। তাই প্রথমে লিকুইড পেট্রোলিয়াম গ্যাস (এলপিজি) সিলিন্ডার ব্যবহার করা নিয়ে দ্বিধাদ্বন্দ্ব ও আতঙ্ক অনুভব করেন তাঁরা। রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে গ্যাস সিলিন্ডার দুর্ঘটনাই তাঁদের আতঙ্কের প্রধান কারণ। শেষ পর্যন্ত সংশ্লিষ্ট লোকজনের সঙ্গে কথা বলে সিলিন্ডারের ব্যবহারবিধি সম্পর্কে জেনে তাঁরাও এটি ব্যবহার শুরু করেছেন। তাঁরা এখন মনে করছেন, সতর্ক থেকে কিছু নিয়ম মেনে চললেই সিলিন্ডার দুর্ঘটনার ঝুঁকি এড়িয়ে স্মার্টলি রান্নার কাজ চালিয়ে নেওয়া সম্ভব।

ইউসুফ আলী শিমুল প্রথম আলোকে বলেন, ‘গ্যাস সিলিন্ডার দুর্ঘটনার ঘটনা শুনলে আমাদের ভয় লাগে ঠিকই, কিন্তু স্মার্ট জ্বালানির জন্য এলপিজির বিকল্প ব্যবস্থা তো নেই। সিলিন্ডার ব্যবহারে যদি আমরা যথেষ্ট সতর্ক থাকি, তাহলে কোনো সমস্যা নেই। তবে এ ক্ষেত্রে পরিচ্ছন্নতা ও সাবধানতা জরুরি।’

দেশে প্রাকৃতিক গ্যাসের মজুত ক্রমশ কমে যাচ্ছে। এতে বাসাবাড়িতে গ্যাস সেবা পাওয়া দিন দিন জটিল ও কঠিন হয়ে যাচ্ছে। বর্তমানে ঢাকাসহ বিভিন্ন স্থানে যাঁরা প্রাকৃতিক গ্যাস সেবার আওতায় আছেন, তাঁদের অনেকের বাসায়ই সব সময় পর্যাপ্ত গ্যাস পাওয়া যায় না। এ ছাড়া কিছু বাসাবাড়িতে নির্দিষ্ট সময় ছাড়া গ্যাস থাকে না। এর ফলে অনেকে প্রাকৃতিক গ্যাস সংযোগের পাশাপাশি এলপিজি সিলিন্ডার ব্যবহার করে থাকেন। স্মার্ট জ্বালানির জন্য দিন দিনই এসব সিলিন্ডারের ব্যবহার বাড়ছে। পাশাপাশি সিলিন্ডার দুর্ঘটনার খবরও পাওয়া যাচ্ছে। নিচের সতর্কতা ও নিয়ম মেনে সিলিন্ডার দুর্ঘটনার ঝুঁকি এড়িয়ে সর্বোাচ্চ নিরাপত্তায় ঝটপট রান্নার কাজ সারা যায় সহজেই-


এলপিজি সিলিন্ডার স্থাপন

নতুন সিলিন্ডার নির্দিষ্ট স্থানে স্থাপন করার আগে অবশ্যই কিছু বিষয় পরীক্ষা-নিরীক্ষা করিয়ে নিতে হবে। সিলিন্ডারের মুখে কাগজে মোড়ানো সিল আছে কি না, তা দেখতে হবে। সিল থাকা মানে হচ্ছে ভেতরে গ্যাস যথাযথভাবে পরিপূর্ণ আছে। এবার সিল সরিয়ে প্রেশার রেগুলেটরের ওপর সংযোগ ক্লিপ লাগাতে হবে। সুইচ অন করে দেখতে হবে ক্লিপের সঙ্গে রেগুলেটর ঠিকঠাকভাবে লেগেছে কি না। এসব কাজ দক্ষ বা পারদর্শী লোক দিয়ে করিয়ে নিতে হবে।



সিলিন্ডার দুর্ঘটনা এড়াতে সতর্কতা ও করণীয়

১. রান্নার জায়গা যেন আলো-বাতাসযুক্ত এবং পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন থাকে। রান্নাঘরের জানালা সব সময় খোলা রাখতে হবে। বৃষ্টি, বাতাস বা ঝড় কিংবা অন্য কোনো কারণে রান্নাঘরের দরজা বন্ধ থাকলে তা খুলে দিয়ে কিছুক্ষণ পর চুলার সুইচ চালু করতে হবে।

২. মানসম্মত রাবার টিউব অথবা হোস পাইপ ব্যবহার করতে হবে।

৩. রাবার টিউব অথবা হোস পাইপে সাবানের ফেনা লাগিয়ে লিকেজ চেক করতে হবে।

৪. প্রতি দুই বছর পরপর নতুন রাবার টিউব লাগাতে হবে।

৫. এলপিজি সিলিন্ডার যদি অব্যবহৃত থাকে অথবা গ্যাসহীন অবস্থায় থাকে, তাহলে রেগুলেটরের নব বন্ধ করে রাখতে হবে।

৬. চুলার পাশে আগুনের উৎস থেকে কমপক্ষে ২-৩ মিটার দূরত্বে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন জায়গায় সিলিন্ডার রাখুন।

৭. মাটি বা ফ্লোরের ওপর সিলিন্ডার রাখতে হবে। কোনোমতেই মাটির নিচে সিলিন্ডার রাখা যাবে না।

৮. রান্না শেষে রেগুলেটরের সুইচ ঠিকঠাকভাবে বন্ধ করতে হবে।

৯. সিলিন্ডার ভর্তি থাকার সময় সেফটি ক্যাপ ব্যবহার করা উচিত।

১০. রান্না শেষে চুলা ও রেগুলেটর উভয়ের সুইচ বন্ধ করে রাখতে হবে। অধিকতর নিরাপত্তার জন্য এবার রেগুলেটরের সুইচ বন্ধ রেখে চুলার সুইচ চালু করে টিউবের ভেতরে থাকা গ্যাস পুড়িয়ে ফেলতে হবে।

১১. টিউবে লিকেজ হয়েছে কি না, তা নিয়মিত চেক করতে হবে। কোনো ত্রুটি ধরা পড়লে তৎক্ষণাৎ পরিবর্তন করতে হবে।

১২. সিলিন্ডার শিশুদের নাগালের বাইরে রাখতে হবে।

১৩. অনুমোদিত ডিলার বা সরবরাহকারীর কাছ থেকে এলপিজি সিলিন্ডার কিনতে হবে।

১৪. সংশ্লিষ্ট কাজে অভিজ্ঞ ও দক্ষ ব্যক্তি দিয়ে সিলিন্ডার স্থাপন করে নিতে হবে।

১৫. সিলিন্ডারের জন্য সব সময় গুণগতমানের টিউব, রেগুলেটরসহ অন্যান্য যন্ত্রাংশ ব্যবহার করতে হবে।

১৬. স্টোরেজ বা গুদামজাত করতে সিলিন্ডার খোলা স্থানে রাখতে হবে। দুর্ঘটনার সময় যাতে দ্রুত সরিয়ে নেওয়া যায়।

১৭. সর্বোপরি স্টোভ অথবা সিলিন্ডারে কোনো ধরনের সমস্যা দেখা দিলে অভিজ্ঞ টেকনিশিয়ানের পরামর্শ নিতে হবে।



যা করবেন না

১. সব সময় সিলিন্ডার সোজা বা খাড়া করে রাখতে হবে। কোনো অবস্থায় সিলিন্ডার বাঁকা বা শুইয়ে রাখা যাবে না।

২. টিউব, রেগুলেটর কিংবা অন্য কোনো অংশ লিকেজ হয়েছে কি না, তা চেক করতে কখনো দেশলাইয়ের কাঠি বা লাইটার অথবা আগুন জ্বালানো যাবে না।

৩. সরাসরি সূর্যের তাপ পড়ে এমন স্থানে সিলিন্ডার রাখা যাবে না।

৪. সিলিন্ডার ও চুলার সংযোগ পাইপের সঙ্গে কোনো কিছু প্যাঁচানো যাবে না।

৫. একটি সিলিন্ডার থেকে একাধিক সংযোগ দেওয়া যাবে না।

৬. নিম্নমানের যন্ত্রাংশ ব্যবহার করা থেকে বিরত থাকতে হবে।

৭. গরম টিউব ব্যবহার করা যাবে না। টিউব গরম হলে সেটা দ্রুত পরিবর্তন করে ফেলতে হবে।

৮. সিলিন্ডারের আশপাশে কখনো মোবাইল ফোন, ক্যামেরা ও অন্যান্য ইলেকট্রনিক ডিভাইস ব্যবহার করবেন না।

সিলিন্ডার দুর্ঘটনার জন্য মূলত ব্যবহারকারীদের অবহেলাকে দায়ী করেন সিলিন্ডার ও চুলা বিক্রেতা এবং কারওয়ান বাজারের ইসলাম এন্টারপ্রাইজের স্বত্বাধিকারী আবদুর রব। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, যাঁরা এসব ব্যবহার করেন তাঁদের অবহেলা ও উদাসীনতার কারণে বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটে। সিলিন্ডার ব্যবহারের কিছু নিয়মকানুন আছে, এসব মেনে চলা উচিত। সিলিন্ডার বাইরের আলো-বাতাস পেলে ও খোলামেলা স্থানে থাকলে এলপিজি সবচেয়ে নিরাপদ জ্বালানি।

গ্যাসের চুলা তৈরি, সিলিন্ডার মেরামত ও সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান। মধুবাগ, ঢাকা, ১৪ জানুয়ারি। ছবি: প্রথম আলো
গ্যাসের চুলা তৈরি, সিলিন্ডার মেরামত ও সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান। মধুবাগ, ঢাকা, ১৪ জানুয়ারি। ছবি: প্রথম আলো



লিকেজ-সংক্রান্ত পরিস্থিতি মোকাবিলায় করণীয়—

১. দ্রুত চুলা ও সিলিন্ডারের রেগুলেটরের সুইচ বন্ধ করে দিতে হবে এবং তৎক্ষণাৎ সেফটি ক্যাপ লাগিয়ে দিতে হবে।
২. অনাকাঙ্ক্ষিত আগুনের সূত্রপাত হলে তা নিভিয়ে ফেলতে হবে।
৩. মোবাইল ফোন, ক্যামেরা ও অন্যান্য ইলেকট্রনিক ডিভাইস ব্যবহার না করে আশপাশ থেকে সরিয়ে ফেলতে হবে।
৪. যে কোনো আগুন জ্বালানো থেকে বিরত থাকতে হবে।
৫. পরিস্থিতি বিবেচনায় দ্রুত বাসার বিদ্যুতের মেইন সুইচ বন্ধ করে দিতে হবে এবং কাছের গ্যাস সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান অথবা ফায়ার সার্ভিসকে খবর দিতে হবে।

ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের চিকিৎসা কর্মকর্তা হুমায়ুন কবীর এক নিবন্ধে লিখেছেন, এলপিজি সিলিন্ডারের গ্যাস লিক হতে পারে বিভিন্ন কারণে। হোসপাইপ, রেগুলেটর, গ্যাস বাল্ব ইত্যাদি থেকে হতে পারে লিক। আর গ্যাস লিক হলেই বিপত্তি। এ গ্যাস নিশ্বাসের সঙ্গে ফুসফুসে প্রবেশ করে। পরে তা অক্সিজেন ও কার্বন ডাই-অক্সাইড বিনিময়ে বাধা দেয়। এতে দম বন্ধ হওয়ার আশঙ্কা থাকে। এটা হলে শরীরে অক্সিজেনের ঘাটতি দেখা দেয়। অক্সিজেনের ঘাটতিতে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয় মস্তিষ্ক। মাথা ঝিমঝিম করে, মাথা খালি খালি লাগে ও অজ্ঞান হওয়ার সমস্যা দেখা দেয়।

জি-গ্যাস, ওরিয়ন, ওমেরা, বসুন্ধরা, নাভানাসহ বাজারে বিভিন্ন কোম্পানির নানা আকারের এলপিজি সিলিন্ডারসহ গ্যাস পাওয়া যায়। এসবের দাম দুই হাজার থেকে শুরু করে পরিমাণভেদে ভিন্ন। যেকোনো কোম্পানির সিলিন্ডারই হোক না কেন, ব্যবহারকারী সচেতন থাকলে বিস্ফোরণের ভয় নেই বলে মনে করেন ঢাকার মধুবাগ এলাকার গ্যাসের চুলা তৈরি ও সিলিন্ডার মেরামত এবং সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান তাকওয়া ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের মালিক জহুর আলম।