খিচুড়িতে আচারে একটু বিচার

বাঙালি রসনায় ধনী-গরিব সব ঘরে খিচুড়ির কদর রয়েছে। নানা পদে ভোজ সারার ঝামেলায় যেতে না চাইলে উত্তম পথ ওই খিচুড়ি। চাল-ডাল আর কিছু মসলা এক করে চুলায় হাঁড়িটা বসিয়ে দিলেই হলো। সঙ্গে ভাজা মাছ বা মাংসের ঝোল কিংবা ডিম থাকলে তো তোফা! আর যদি একটু আচার হয়—উফ্‌, জিবের পানি কে সামলায়!

বাড়িতে রান্নার কিছু নেই! চাল-ডাল এক করে পানি ঢেলে চুলায় বসিয়ে দাও হাঁড়ি। হোটেল-রেস্তোরাঁর খাবারের তালিকায় খিচুড়ি ঢুকে পড়ায় এর সমাদর অনেক বেড়ে গেছে। ফুটপাতের খাবারের টং দোকান থেকে অভিজাত রেস্তোরাঁর মেন্যুতে সগৌরবে স্থান করে নিয়েছে খিচুড়ি।

একটু বৃষ্টি হলে, হিমেল ভাব থাকলে আয়েশ করে খিচুড়ি খেতে পছন্দ করেন অনেকে। তবে খিচুড়ি কোনো মৌসুমি খাবার নয়; বারো মাসই চলে।

খিচুড়িকে আরও উপাদেয় করতে চাটনি বা আচার যোগ করার প্রচলন বাঙালি ঐতিহ্যের অংশ। পুষ্টিবিদেরা জানাচ্ছেন, খিচুড়ির সঙ্গে আপনি আচার খেতে পারবেন, তবে এতে ‘কিন্তু’ ও ‘যদি’ যুক্ত করতে হবে। অর্থাৎ আচার বেছে নিতে সাবধান না হলে হিতে বিপরীত হতে পারে। খিচুড়ির সুষম উপাদানকে এক নিমেষে শেষ করে দিতে পারে ‘ভুল’ আচার। তেলভর্তি মসলাদার আচার না নিয়ে ভিনেগারে তৈরি আচার খাওয়ার ওপর জোর দিয়েছেন পুষ্টিবিদেরা।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পুষ্টি ও খাদ্যবিজ্ঞান ইনস্টিটিউটের সাবেক পরিচালক অধ্যাপক খুরশীদ জাহান প্রথম আলোকে বলেন, খিচুড়ির দুটি প্রধান উপাদান হচ্ছে চাল ও ডাল। ডালে প্রচুর পরিমাণে অ্যামাইনো অ্যাসিড থাকে। ফলে, চাল-ডালের মিশ্রণে সুষম উদ্ভিজ্জ আমিষ তৈরি হয়। এর সঙ্গে মাংস ও ডিম যুক্ত করতে পারলে প্রাণিজ আমিষও পাওয়া যায়। তাই উপকরণের ভিত্তিতে খিচুড়ি হতে পারে একটি আদর্শ সুষম খাবার।

খিচুড়ির সঙ্গে আচার খাওয়ার বিষয়ে খুরশীদ জাহান বলেন, ‘খিচুড়ির স্বাদ বাড়াতে অনেকে আচার নিয়ে থাকেন। আচারের পুষ্টিগুণ নিয়ে আমরা এখনো কোনো গবেষণা করিনি। রসুনের আচারের উপকারিতার কথা বলা হয়ে থাকে, তবে আসলেই তা থেকে মানুষ কতটুকু উপকৃত হতে পারে, এ বিষয়ে জানার জন্য গবেষণার দরকার।’

পুষ্টিবিদ এই শিক্ষক বলেন, আচারে তেল, লবণ ও মসলা দেওয়া হয়। মানুষের বয়স, লিঙ্গ ও শারীরিক কর্মকাণ্ডের ভিত্তিতে দেহে লবণের প্রয়োজনীয়তা নির্ধারিত হয়। তাই আচারের মাধ্যমে অতিরিক্ত লবণ গ্রহণ করা ক্ষতিকর। আচারের অতিরিক্ত তেলও শরীরের জন্য ক্ষতিকর। আচারে টক ফল ব্যবহার করা হয় বলে অনেকে ‘ভিটামিন সি’ পেতে আচারের দ্বারস্থ হতে চান। এটা একেবারেই ভুল। আচার কখনো তাজা ফল থেকে পাওয়া ভিটামিন সির বিকল্প হতে পারে না।

খিচুড়ির পুষ্টিগুণ বর্ণনার পাশাপাশি আচারের ক্ষেত্রে সাবধানতা অবলম্বন করতে বলেছেন নেসলে বাংলাদেশের পুষ্টি পরামর্শক জিন্নাতুন নাহার। প্রথম আলোকে তিনি বলেন, খিচুড়ি একটি সুষম খাবার। এখন শীতকাল হওয়ায় বাজারে তাজা সবজির আধিক্য বেশি। তাই খিচুড়ি খাওয়ার আদর্শ সময় এখন। নানা ধরনের সবজি খিচুড়িতে যুক্ত করলে এর পুষ্টিগুণ আরও বেড়ে যায়। সবজি খিচুড়িতে একই সঙ্গে পাওয়া যায় শর্করা, আমিষ, মিনারেল, ভিটামিন ও পানি। যাঁরা ডায়েট করেন, তাঁদের সকালে এক থেকে দেড় কাপ পরিমাণ খিচুড়ি খাওয়ার পরামর্শ দেওয়া হয়। এতে সারা দিনে ক্যালরি বার্ন করার সুযোগ থাকে। অনেকে দুপুরে খেতে পছন্দ করেন, সে ক্ষেত্রে বেলা একটা-দেড়টার মধ্যেই খিচুড়ি খেয়ে ফেলতে বলা হয়। তবে রাতে খিচুড়ি না খাওয়াই ভালো।

খিচুড়ির সঙ্গে আচার না নেওয়াকে উৎসাহিত করছেন নেসলের এই পুষ্টিবিদ। তিনি বলেন, আচার ছাড়া খিচুড়িকে অনেকে অসম্পূর্ণ মনে করেন। তবে আচারের ধরনের ওপর এর পুষ্টিমান নির্ভর করে। তেলে জবজবে মিষ্টি আচার নিয়ে খিচুড়ির পুষ্টিগুণকেই নষ্ট করে ফেলা হয়। এই আচার টক হলেও ফলাফল একই। সেটাও সমান ক্ষতিকর। টক আচারে ‘চর্বি কাটে’—এমন ভুল ধারণা রয়েছে অনেকের। ডুবোতেলের কারণে আচারকে উচ্চ ক্যালরিযুক্ত খাবার হিসেবে ধরা হয়। যাঁরা ডায়েট করেন, তাঁদের জন্য আচার নেওয়া কোনোভাবেই ঠিক নয়। আচারের তেল ও লবণের কারণে রক্তে সোডিয়ামের পরিমাণ বেড়ে যায়। উচ্চ রক্তচাপে ভুগছেন বা হৃদ্‌রোগের সমস্যা রয়েছে—এমন মানুষদের জন্য এটা অত্যন্ত ক্ষতিকর।

খিচুড়ির সঙ্গে আচার নেওয়ার ক্ষেত্রে তাই সতর্ক হতে বললেন পুষ্টিবিদ জিন্নাতুন নাহার। তিনি বলেন, খিচুড়ির সঙ্গে খাওয়ার ক্ষেত্রে তেলের পরিবর্তে ভিনেগারে করা রসুন, আমলকী ও লেবুর আচার খাওয়া যেতে পারে।