চলো যাই, বাণিজ্য মেলায়

>আসবাব থেকে গৃহস্থালি পণ্য, ইলেকট্রনিকস থেকে মোটরসাইকেল, দেশি থেকে বিদেশি। প্রয়োজনের বা শখের জিনিসটি কিনতে ঢাকা আন্তর্জাতিক বাণিজ্য মেলায় যাচ্ছেন ক্রেতারা। এ যেন কেনাকাটার ক্রেতা–বিক্রেতার যোগাযোগের উৎসব। এবারের অধুনাতেও সেই উৎসবেরই ছোঁয়া।
বাণিজ্য মেলায় ওয়ালটনের প্যাভিলিয়ন
বাণিজ্য মেলায় ওয়ালটনের প্যাভিলিয়ন

পাখির বিশাল দুটি ডানা। কমলা, বেগুনি, নীল, হলুদ রঙের সেই ডানার মধ্যে হাসিমুখে দাঁড়িয়েছেন এক তরুণ। সামনে থেকে তাঁর এক বন্ধু মুঠোফোনে ছবি তুলছেন। আরও কয়েকজন তরুণ–তরুণী অপেক্ষা করছেন—ছবি তুলবেন, পাখির ডানার মধ্যে।

ক্রেতা–দর্শনার্থীদের আকৃষ্ট করতে ইলেকট্রনিকসের দেশীয় ব্র্যান্ড ওয়ালটন নিজেদের প্যাভিলিয়নের বাইরে পাখির ডানার সঙ্গে ছবি তোলার ব্যবস্থা করেছে। নিজেদের পণ্যের প্রচারের জন্য অন্য প্রতিষ্ঠানগুলোও চেষ্টার কোনো ত্রুটি করেনি। ক্রেতা টানতে মূল্যছাড়সহ নানা লোভনীয় অফার দিচ্ছে অনেক প্রতিষ্ঠান।

চলছে কেনাকাটা
চলছে কেনাকাটা

আসছেন ছোটবড় সবাই
নগরবাসীর অনেকেই পরিবারের ছোট্ট সদস্য থেকে শুরু করে প্রবীণতম সদস্যদের নিয়ে মেলায় আসছেন। তরুণ–তরুণীরাও ভিড় করছেন। তাঁরা বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের দৃষ্টিনন্দন প্যাভিলিয়ন ও স্টলে ঘুরে ঘুরে পণ্যসামগ্রী দেখছেন। সাধ্যমতো কিনছেন। সব মিলিয়ে ঢাকা আন্তর্জাতিক বাণিজ্য মেলা–২০১৯ রাজধানীবাসীর জন্য কেনাকাটার উৎসবে পরিণত হয়েছে।
ধানমন্ডির গৃহিণী জলি আহমেদ এর মধ্যে পাঁচ দিন গেছেন বাণিজ্য মেলায়। বেশির ভাগ সময় দুপুরের খাবার খাওয়ার পর বোনদের সঙ্গে গেছেন। প্রথম তিন দিন শুধু ঘুরেছেন এ দোকান থেকে সে দোকান। পরের দুই দিন কেনাকাটা করেছেন। কেন এতবার গেছেন জানতে চাইলে বলেন, নানা দেশের জিনিস একবারে পাওয়া যায়। হাঁড়ি–পাতিল–তৈজসপত্রের নকশার মধ্যে বৈচিত্র্য পাওয়া যায়। সেগুলোই বেশি কিনেছি।
আরেকজন ক্রেতা জানালেন, পত্রিকায় বিভিন্ন পণ্যের ওপরে নানা রকমের আকর্ষণীয় ছাড় দেখে এসেছেন। টিভি–ফ্রিজ আর আসবাব কিনবেন।

মেলায় ঢুকেই

গত কয়েক বছর বাণিজ্য মেলার মূল ফটক পদ্মা সেতুর আদলে করা হয়েছিল। এবার মেট্রোরেলের আদলে করা হয়েছে। মূল ফটক দিয়ে ঢুকলেই দুই পাশে আকিজ বিল্ডিং ম্যাটেরিয়াল, ম্যাটাডোর, স্পিড, ডেল্টা ফার্নিচার, নাভানা ফার্নিচার, হাতিল, কিয়াম, স্যামসাং, সনি, যমুনা, লাভেলো, ঈগলু, দুরন্ত বাইসাইকেল, বেঙ্গল প্লাস্টিক, তানিন, নিউজিল্যান্ড ডেইরি, মিল্ক ভিটা, আক্তার ফার্নিচার, রিগ্যাল, বঙ্গজ বিস্কুট, মার্সেল, মিনিস্টার, গ্রি, বসুন্ধরা, গাজী পাম্প, ইস্পাহানি চা, গ্লোডেন হারভেস্ট, বেঙ্গল মিট, মার্কস, রোডমাস্টার মোটরসাইকেল, স্টেপ, রংপুর কারুপণ্য, আমানত শাহ লুঙ্গি, ফিট এলিগ্যান্স, বেক্সি ফ্যাব্রিকস, ব্রাদার্স ফার্নিচার, নাদিয়া ফার্নিচারসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের দৃষ্টিনন্দন প্যাভিলিয়ন।

আছে বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশ নামের বিশাল প্যাভিলিয়ন। এ ছাড়া থাইল্যান্ড, ভারত, ইরানসহ কয়েকটি বিদেশি প্যাভিলিয়নও আছে।

২১ জানুয়ারি পুরো বাণিজ্য মেলা চক্কর দিয়ে দেখা গেল, আসবাব থেকে শুরু করে ইলেকট্রনিকস, খাদ্য, প্লাস্টিকপণ্য, মোটরসাইকেল, বাইসাইকেল, ছেলে ও মেয়েদের পোশাক, গয়না, প্রসাধনী, সবজি কাটার যন্ত্র, আইসক্রিম, ম্যাট্রেস, বালিশ, মসলা, গৃহস্থালিসামগ্রী, বাচ্চাদের খেলনা, পানির পাম্প, ব্যায়ামের যন্ত্র, বিছানার চাদর, হস্তশিল্প, এলপি গ্যাস, কার্পেটসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় সব ধরনের পণ্যের প্রসার সাজিয়ে বসেছে ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠান। বাচ্চাদের বিনোদনের জন্য আছে ছোট্ট শিশুপার্ক। ক্রেতা ও দর্শনার্থীদের সুবিধার জন্য এটিএম বুথ, বিশ্রামঘর, ১২ স্থানে শৌচাগার, ফায়ার সার্ভিস স্টেশন, গাড়ি পার্কিংয়ের ব্যবস্থা করেছে আয়োজকেরা।

সকালে মেলা খোলার পর থেকেই দর্শনার্থীরা ভিড় করেন। বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে সেই ভিড় বাড়ে। তাদের মধ্যে তরুণী ও নারীর সংখ্যাই বেশি। তরুণী ও নারীদের বেশির ভাগই গৃহস্থালি পণ্য, প্লাস্টিকসামগ্রী, পোশাক ও প্রসাধনীর বিভিন্ন প্যাভিলিয়ন ও স্টলে ভিড় করেন। আসবাব ও ইলেকট্রনিকস পণ্যের প্যাভিলিয়নেও নিত্যনতুন যন্ত্রপাতির খোঁজখবর নেন অনেকে।

এদিকে বাণিজ্য মেলা উপলক্ষে অনেক প্রতিষ্ঠান নতুন পণ্য প্রদর্শন করছে। যেমন—নতুন টিভি, রেফ্রিজারেটর, এসি, ওয়াশিং মেশিন নিয়ে এসেছে দেশীয় ব্র্যান্ড ওয়ালটন। বাণিজ্য মেলা উপলক্ষে ক্রেতাদের চাহিদা বিবেচনায় সব ধরনের হোম অ্যাপ্লায়েন্সে ৫ থেকে ৮ শতাংশ মূল্যছাড় দিচ্ছে ওয়ালটন। ওয়ালটন বর্তমানে বাজারজাত করছে ১৩ মডেলের ব্লেন্ডার ও জুসার। দাম ১ হাজার ৪৫০ টাকা থেকে ১৫ হাজার টাকা পর্যন্ত। ওয়ালটনের আছে ১ মডেলের হ্যান্ড মিক্সচার। দাম ১ হাজার ৫০০ টাকা। বর্তমানে ওয়ালটনের রয়েছে ২১ মডেলের ইলেকট্রিক রাইস কুকার। ১ থেকে ২.৮ লিটারের এসব রাইস কুকারের দাম ১ হাজার ৫০০ থেকে ৭ হাজার ৫০০ টাকা পর্যন্ত। ওয়ালটনের রয়েছে স্টেইনলেস স্টিলের ৮ সিঙ্গেল বার্নার এবং ১৬ ডাবল বার্নারের গ্যাস স্টোভ। এসব গ্যাস স্টোভে ব্যবহার করা হয়েছে স্টেইনলেস স্টিলের টপ প্যানেল। দাম ১ হাজার ১০০ থেকে ৩ হাজার ৫০০ টাকা। এ ছাড়া আছে ৬ গ্লাস টপ সিঙ্গেল এবং ২৮ ডাবল বার্নারের গ্যাস স্টোভ। এগুলোর টপ প্যানেলে ব্যবহার করা হয়েছে টেম্পারড গ্লাস। দাম ২ হাজার ৫০ থেকে ৪ হাজার ৩০০ টাকা পর্যন্ত। সব মডেলের ওয়ালটন গ্যাস স্টোভের এনজি এবং এলপিজি ভার্সন রয়েছে। ওয়ালটনের আছে ১৬ মডেলের গ্যাসোলিন জেনারেটর। দাম ১৫ হাজার থেকে ৬০ হাজার টাকা। রয়েছে ২ মডেলের ডিজেল জেনারেটর। দাম যথাক্রমে ৯০ হাজার এবং ৯৯ হাজার টাকা।

রাতের বাণিজ্য মেলার সাজসজ্জা
রাতের বাণিজ্য মেলার সাজসজ্জা

বর্তমানে দেশব্যাপী ডিজিটাল ক্যাম্পেইন সিজন-৪ চালাচ্ছে ওয়ালটন। ক্যাম্পেইনের আওতায় বাণিজ্য মেলাসহ দেশের যেকোনো ওয়ালটন প্লাজা এবং পরিবেশক শোরুম থেকে ওয়ালটন জেনারেটর কিনে মোবাইল ফোনে এসএসএমের মাধ্যমে রেজিস্ট্রেশন করলেই ক্রেতারা পাচ্ছেন ২০০ থেকে ১ লাখ টাকা পর্যন্ত নিশ্চিত ক্যাশ ভাউচার অথবা মোটরসাইকেল, এয়ার কন্ডিশনার, ল্যাপটপ, ফ্রিজ, এলইডি টিভি, ওভেনসহ অসংখ্য পণ্য ফ্রি। জানতে চাইলে ওয়ালটনের প্যাভিলিয়ন ব্যবস্থাপক শফিকুল আলম প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা শতাধিক ক্যাটাগরিতে সহস্রাধিক মডেলের পণ্য প্রদর্শন করছি। এখন পর্যন্ত ক্রেতা–দর্শনার্থীদের কাছ থেকে ভালো সাড়া পেয়েছি। বিক্রি গতবারের চেয়ে ২০ শতাংশ বেশি হয়েছে।’
মেলায় নতুন আসবাবের পাশাপাশি নতুন প্রযুক্তি ‘হাতিল উইজ’ নিয়ে এসেছে হাতিল। এই প্রযুক্তির মাধ্যমে যে কেউ নিজের বাসার কক্ষে আকার ও অন্যান্য বর্ণনা দিলে পছন্দসই আসবাব বসিয়ে থ্রিডি ইন্টেরিয়র লুক দেখতে পাবেন। তা ছাড়া ৫–১৫ শতাংশ পর্যন্ত মূল্যছাড় দিচ্ছে হাতিল, যা সারা দেশের বিক্রয়কেন্দ্র থেকেই মিলবে। অন্যদিকে পারটেক্স ফার্নিচার ২০ শতাংশ পর্যন্ত মূল্যছাড় দিচ্ছে। এই অফার সারা দেশে পারটেক্সের ১২০টি বিক্রয়কেন্দ্র থেকেও মিলবে।
বাণিজ্য মেলায় সবচেয়ে বেশি ৩৯টি প্যাভিলিয়ন ও মিনি প্যাভিলিয়ন আছে প্রাণ–আরএফএল গ্রুপের। এসব প্যাভিলিয়নে প্লাস্টিকপণ্য, খাদ্যসামগ্রী, আসবাব, সাইকেল ইত্যাদি পণ্য প্রদর্শন করা হচ্ছে।

বাণিজ্য মেলায় ক্রেতাদের ভিড় প্রতিদিনই দেখা যায়
বাণিজ্য মেলায় ক্রেতাদের ভিড় প্রতিদিনই দেখা যায়

বাণিজ্য মেলার দুই যুগ
১৯৯৫ সাল থেকে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সহযোগিতায় রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরো (ইপিবি) বাণিজ্য মেলার আয়োজন করছে। সাধারণত বছরের প্রথম দিন ঢাকার শেরেবাংলা নগরে বাণিজ্য মেলা শুরু হলেও এবার জাতীয় সংসদ নির্বাচনের কারণে আট দিন পিছিয়ে যায়। ৯ জানুয়ারি মাসব্যাপী বাণিজ্য মেলার ২৪তম আসরের উদ্বোধন করেন রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ। এবারের মেলায় ১১০টি প্যাভিলিয়ন, ৮৩টি মিনি প্যাভিলিয়ন এবং স্টলসংখ্যা ৪১২।

মেলার সময়সূচি
প্রতিদিন সকাল ১০টা থেকে রাত ১০টা পর্যন্ত বাণিজ্য মেলা দর্শনার্থীদের জন্য খোলা থাকবে। মেলায় প্রবেশমূল্য ৩০ টাকা। অবশ্য অপ্রাপ্তবয়স্কদের জন্য ২০ টাকা। এবার অনলাইনে টিকিট কাটার ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। এতে ৩০ টাকার টিকিট কিনতে লাগবে হবে ৩২ টাকা।
যাঁরা এখনো ঘুরতে যাননি, একবার হলেও ঢু মেরে আসতে পারেন কেনাকাটার এই উৎসবে।