ফুল-পাখিঘেরা ববিতার আপন পরিসর

>সত্যজিৎ রায়ের অশনী সংকেত-এর অনঙ্গ বউ। আমজাদ হোসেনের গোলাপী এখন ট্রেনে ছবির গোলাপী। এ দুটো চরিত্রে অভিনয় করে যিনি নিজেকে নিয়ে গেছেন অনন্য উচ্চতায়। সত্তর, আশি ও নব্বই দশকের বড় পর্দার সেই ড্রিমগার্ল ববিতাকে তো অভিনেত্রী হিসেবেই চেনেন সবাই। আজ তাঁকে চেনা যাক একজন প্রকৃতি, পাখি ও ফুলপ্রেমী হিসেবে। বাগান করার শখটা তাঁর অভিনয় জীবন থেকেই।
নিজের বাগানের নিয়মিত যত্ন নেন অভিনেত্রী ববিতা। ছবি: কবির হোসেন
নিজের বাগানের নিয়মিত যত্ন নেন অভিনেত্রী ববিতা। ছবি: কবির হোসেন

এপারে গুলশান, ওপারে বারিধারা। মধ্যখানে হ্রদ। পড়ন্ত শীতে সেই হ্রদে দল বেঁধে উড়ে বেড়ায় শীতের পাখি। নিজের বাড়ির ছাদ থেকে চোখে আনন্দ নিয়ে ফরিদা আক্তার পপি (ববিতা পোশাকি নাম) দেখেন সেই দৃশ্য। আহা, মানুষ পারে না একসঙ্গে থাকতে। আর পাখিরা উল্টো, তারা পারে না দলছুট হতে। হ্রদে এসে ঝাঁকে ঝাঁকে বসে অতিথি পাখিরা। পুরো শীতেই দূর থেকে সেটা উপভোগ করেন ববিতা। শৈশব থেকেই পাখি ও প্রকৃতিপ্রেমী তিনি। তাঁর বাবারও শখ ছিল বাগান করা।

বাড়ির অভ্যর্থনা কক্ষে ঢুকতেই ডান দিকে ছোট্ট বারান্দা। সেখানে চোখে পড়ে দুটি খাঁচা। একটিতে সুন্দরী টিয়া। অন্যটিতে মেঘকালো ময়না। হঠাৎ হাসির শব্দে চমকে ওঠার পালা। কে হাসল! রহস্য ভেদ করেন ববিতা, ‘ওই যে, ময়নাটা হাসছে। ও আমার হাসি নকল করে। ববিতার হাসি। কী দুষ্টু।’ তিনি নিজেও হাসেন। আসলেই ময়নাটা দুষ্টু এবং বাচাল। এরপর অনর্গল সে বলতে শুরু করে, ‘অনিক কই, অনিক।’ ববিতাও সুর মেলান, ‘কই অনিক।’ ময়নার বেদনাভরা কণ্ঠ, ‘অনিক তো নাই।’ ববিতা আশ্বস্ত করেন, ‘ও তো কানাডা গেছে।’ ময়না আবার হেসে ওঠে। ববিতার হাসি। বলে ওঠে, ‘ওকে পানি খেতে দাও।’ শুনে ববিতা বলেন, ‘আপনাকে পানি খেতে দিতে বলেছে।’

যে অনিককে নিয়ে কথা তিনি ববিতার একমাত্র ছেলে। ‘ও এখন কানাডায় থাকে। একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করছে।’

চোখ ঘোরে চারদিক। এ দেয়াল থেকে ও দেয়াল। মার্বেল টাইলসের মেঝে, পর্দা, সোফা, দেয়াল সবকিছুতেই সাদার সমারোহ। বাড়িটি শ্বেতশুভ্র। এ বাড়ির নকশায় যেটি ছিল প্রধান শোবার ঘর, সেটিই এখন নাকি সবুজ বনানী। সেদিকে পা বাড়াই।

গুলশানে ১২ তলার ওপরে যেন এক টুকরো অরণ্য
গুলশানে ১২ তলার ওপরে যেন এক টুকরো অরণ্য

ববিতার ফ্ল্যাটটি ঢাকার গুলশানে, ১২ তলায়। প্রথমেই চোখে পড়ে বাঁশঝাড়ে। ১২ তলায় বাঁশঝাড়! শুধুই তা নয়, বিভিন্ন রকম গাছ আর পাতায় ছাদ–বাগান হয়ে গেছে সবুজের অরণ্য। ডান দিকের পুরো দেয়াল বেয়ে নেমে গেছে এমেথিস্ট বিউটি। বিরল এ গাছের সবুজ পাতারা এসে গা ভিজিয়েছে ফোয়ারার জলে। হঠাৎ সেখানে উড়ে আসে একজোড়া বুলবুলি পাখি। ববিতা দ্রুত তাঁর ক্যামেরা তাক করেন। চুপিচুপি ধারণ করতে থাকেন ছবি। একটা পাখি বসেছে রেলিংয়ে। অন্যটি ফোয়ারায়। তার হাপুস–হুপুস স্নান শেষ হতেই আসে দ্বিতীয় পাখিটি। অবগাহন শেষে দুজন আবার উড়ে যায় খোলা আকাশে। ববিতা বলেন, ‘আমি এখানে বসে প্রতিদিন এগুলো খুব উপভোগ করি।’

ববিতার বাগানে রয়েছে মৌসুমি গাঁদা, ডালিয়া, জবা, চন্দ্রমল্লিকা, ক্রিসেনথিমাম, কলাবতী, স্লোবল, ডবল পিটুনিয়া ফুল। আর ফোয়ারার পানিতে শাপলা। রয়েছে দুরঙা ক্যাকটাস, তিবুচিনিয়া, কানকা, হাইডেনজিয়া, শকিং পিঙ্ক, ফ্লক্স, ডেন্টাস, কসমস, বার্বিয়া, সালভিয়া, ইমপ্রেশন। ঝুলে আছে গোলাপি ভোগানভিলিয়া, আছে নাইটকুইন। ববিতা জানালেন, কিছুদিন আগেও নাকি একসঙ্গে ২০টা নাইটকুইন ফুটেছিল। অন্য ফুলগুলো অতি যত্নে ছড়িয়েছে আপন সৌন্দর্য।

‘সাধারণত বিদেশে গেলে কমবেশি সবাই এটা–সেটা কেনাকাটা করেন। আমার ওসবে আগ্রহ কম। আমি দেশের বাইরে গেলে খোঁজ নিয়ে চলে যাই বড় বড় নার্সারিতে। কিনে আনি অপরিচিত ফুলের গাছ। যেগুলো আমাদের দেশে নেই।’ বললেন ববিতা। তাঁর এই বাগানে ফুলগাছ এসেছে সুদূর কানাডা, সুইজারল্যান্ড, থাইল্যান্ড, সিঙ্গাপুর থেকে। যেগুলো আনতে তাঁকে করতে হয়েছে অনেক পরিশ্রম। কারণ, বিদেশ থেকে মাটিসহ গাছ আনা যায় না। তাই কিনে, মাটি ফেলে, পলিথিনে মুড়িয়ে তিনি নিয়ে আসেন এসব দুর্লভ গাছ।

এই বাগানের শোভা আরও বাড়িয়েছে তিনটি খাঁচায় থাকা তিন জোড়া পাখি। লাভবার্ড, অস্ট্রেলিয়ান ঘুঘু আর ফিঙে। সারাক্ষণই এদের কলকাকলিতে মুখরিত ছিল বাগান।

আম গাছেও এসেছে মুকুল
আম গাছেও এসেছে মুকুল

বাসার শোবার ঘর ভেঙে বাগান করার চিন্তা কীভাবে এল। ‘শৈশবের গ্রাম, প্রকৃতি, পুকুর, চাঁদ, চাঁদনি রাত অনেক মিস করি। গুলশানে থেকে কোথাও যাওয়াও সম্ভব নয়। এত সবুজ কোথায় পাব। ভাবলাম, একা থাকি। এত ঘর তো আমার দরকার নেই। তাই স্থপতির সঙ্গে বসে পরিকল্পনা করি। তারপর শোবার ঘরটিকেই বানিয়ে ফেলি সবুজারণ্য। আবার আমার পানির শব্দ খুব ভালো লাগে। তাই একটা ছোট্ট ফোয়ারা নিয়েছি। সেখানে পানি পড়ে। প্রতিদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে নামাজ পড়ি। তারপর রুফটপে গিয়ে হাঁটি। বাগানের দেখভালের জন্য মালি আছে। সাত দিন পর পর বিদেশ থেকে আনা ভিটামিন সে দেয়। ঘাস পরিষ্কার করে। তারপরও প্রতিদিন সকালে নিজ হাতে একটি একটি করে গাছের পরিচর্যা করি। কোনো ফুল নষ্ট হলে, ছেঁটে ফেলে দিই। গত আড়াই বছর ধরে পরিচর্যার এই কাজটা আমার প্রাত্যহিক রুটিন। আর বাগান করার শখটা সেই অভিনয় জীবন থেকেই। এটা আমার কাছে নেশার মতো।’

আমরা চলে যাই রুফটপে। সেখানেও নেই রঙিন ফুলের ব্যতিক্রম। এখানে আরও এক জোড়া অস্ট্রেলিয়ান ঘুঘু। বিকেলে রুফটপে বসে আড্ডা দেওয়ার ব্যবস্থাও আছে। রয়েছে দোলনা। আর একটি মাটির চুলা। ববিতা বলেন, ‘শীতকাল আমার খুব প্রিয়। এই সময়টায়, পরিবারের মানুষজন, বোন, বোনদের ছেলেমেয়ে, বন্ধুবান্ধবদের বাড়িতে দাওয়াত দিই। তাদের জন্য বাজার করতে চলে যাই পূর্বাচলে। দেশি মুরগি কিনে আনি। রান্নার মেনুতে থাকে মটরশুঁটি দিয়ে কই মাছ, পোড়া বেগুনের ভর্তা, গরু, মুরগি আর কলাপাতায় ভাপে রান্না করা ছোট মাছ। মাটির চুলায় নিজ হাতে সব রান্না করি। এমনকি ভাতটাও হয় মাটির চুলায়। তারপর এই খাবার সবার হাঁড়ি বা কড়াই থেকে নিয়ে খেতে হয়। একটা চড়ুইভাতির আনন্দ যেন। বলে রাখি, বোম্বাই মরিচ ভাতের সঙ্গে মাখিয়ে খেতে আমি খুব পছন্দ করি।’

যখন ফিরে আসি, তখন মনে হচ্ছিল খ্যাতিমান অভিনেত্রী ববিতা বাগানবিলাসী, আপন আলয়ে কাটাচ্ছেন অরণ্যের দিনরাত্রি।