কেন ভালোবাসি?

ভালোবাসার দিনে বলুন ভালোবাসি...। ছবি: অধুনা
ভালোবাসার দিনে বলুন ভালোবাসি...। ছবি: অধুনা

কোকিল কেন ডাকে? এই প্রশ্নের একটা বিজ্ঞানসম্মত উত্তর নিশ্চয় আছে। সেই খটমট উত্তর না খুঁজেও বলতে পারি, বসন্ত ঋতুটা প্রকৃতিতে যেন চক্রান্তের জাল বিছিয়ে রাখে। সেই চক্রান্তে কোকিল ডেকে ওঠে। আমরাও জেনে বা না জেনে সেই চক্রান্তের ফাঁদে পা দিই।

না শীত, না গ্রীষ্মের এই সময়টাতে খোলা হাওয়ার মধ্যে একটা মন কেমন করা ভাব। এই প্ররোচক হাওয়ার স্পর্শে শাহ আবদুল করিম গেয়ে ওঠেন, ‘বসন্ত বাতাসে সই গো বসন্ত বাতাসে, তোমার বাড়ির ফুলের গন্ধ আমার বাড়ি আসে...।’

মনোবিজ্ঞানীরা বলেন, মানুষের মনে যে প্রকৃতির প্রভাব পড়ে, সেটা এখন প্রমাণিত। প্রভাব পড়ে বলেই মেঘাচ্ছন্ন দিনে মন বিষণ্ন থাকে, রৌদ্রোজ্জ্বল দিনে মন হয়ে ওঠে চনমনে, প্রফুল্ল।

চেয়ে দেখুন, আজ এই ফাল্গুনে গাছের সবুজ ডালপালার ফাঁকে ফুটে আছে থোকা থোকা লাল পলাশ-শিমুল-কৃষ্ণচূড়া। বৃক্ষশাখায় যেন আগুন লেগেছে। আগুন লেগেছে বনে। সেই আগুনের আঁচ মনে এসে লাগবে না? লাগে। লাগে বলেই তো হাহাকার জেগে ওঠে মনে, ‘বনে যদি ফুটল কুসুম, নেই কেন সেই পাখি?’ এই হাহাকারের বোধ থেকে প্রেম আসে মনে। ভালোবাসার মানুষটাকে কাছে পেতে ইচ্ছে করে। তার সান্নিধ্য পেলে আমরা গেয়ে উঠি, ‘ভালোবাসি, ভালোবাসি—, এই সুরে কাছে দূরে জলে স্থলে বাজাই বাঁশি।’ আবার প্রিয় মানুষটির সান্নিধ্যবঞ্চিত হলে গভীর দীর্ঘশ্বাসে উচ্চারণ করি, ‘অনেক কষ্টের দামে জীবন গিয়েছে জেনে, ভালোবাসা মূলত মিলনে মলিন হয় বিরহে উজ্জ্বল।’

প্রিয়জনকে কাছে পাই বা না পাই, ভালোবাসার অনুভব মানুষের চির জাগরূক এক সত্তা। পৃথিবীর সবচেয়ে দুর্লভ ও আকাঙ্ক্ষিত এক আবেদন।

কাল ১৪ ফেব্রুয়ারি ভালোবাসা দিবস। কী আশ্চর্য প্রকৃতিতে যখন বসন্তের আগমনী বার্তা, সেই সময় ফাল্গুনের শুরুতে পাশ্চাত্যের ‘ভ্যালেন্টাইনস ডে’ আসে এই বাংলায়।

‘ভ্যালেন্টাইনস ডে’ নিয়ে বহুল প্রচলিত একটা গল্প আছে। যুদ্ধবাজ রোমান সম্রাট দ্বিতীয় গ্লডিয়াস একসময় তাঁর রাজ্যে বিবাহ নিষিদ্ধ করেছিলেন। তাঁর ধারণা ছিল, নারী-পুরুষের এই হৃদয়ের বন্ধন পুরুষকে যুদ্ধে যেতে অনাগ্রহী করে তোলে। সম্রাটের এই আদেশ মানতে পারেননি ক্যাথলিক ধর্মযাজক সেন্ট ভ্যালেন্টাইন। তিনি একটি গির্জায় প্রেমে-আবদ্ধ তরুণ-তরুণীদের বিয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা করেন গোপনে। এ কথা জানাজানি হওয়ার পর ভ্যালেন্টাইনকে কারাগারে পাঠান সম্রাট। কিন্তু নিয়তির কী ইশারা! কারাবন্দী ভ্যালেন্টাইনের সঙ্গে প্রেমের সম্পর্ক গড়ে ওঠে এক কারারক্ষীর কন্যারই। ধর্মযাজকদের জন্য প্রচলিত প্রথা উপেক্ষা করে সেই মেয়েটিকে বিয়েও করেন তিনি। এই সংবাদ কানে গেলে ভ্যালেন্টাইনের মৃত্যুদণ্ড ঘোষণা করেন সম্রাট। ফাঁসির মঞ্চে যাওয়ার দিন প্রেমিকার কাছে লেখা তাঁর চিঠির শেষ পঙ্​ক্তিটি ছিল, ‘লাভ ফ্রম ইয়োর ভ্যালেন্টাইন।’ দিনটি ছিল ১৪ ফেব্রুয়ারি।

মৃত্যুর ২০০ বছর পর ৪৯৬ খ্রিষ্টাব্দে ‘সেন্ট’ হিসেবে স্বীকৃতি পান ভ্যালেন্টাইন। তবে আরও দীর্ঘকাল পরে, ১৮ শতকে তাঁর স্মরণে ভালোবাসা দিবস পালন শুরু করে ব্রিটিশরা। এখন সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়েছে ভালোবাসার এই বার্তা। ভালোবাসার জন্য ভ্যালেন্টাইনের আত্মত্যাগের দিনটিকে অমর করে রেখেছে প্রেমিক-প্রেমিকারা।

প্রিয়জনকে ফুল, চকলেট, শুভেচ্ছাপত্র আর কবিতার বই উপহার দিয়ে এখন এই দিনটি উদ্​যাপন করে সারা বিশ্বের মানুষ। এই প্রযুক্তির যুগে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের দেয়াল ভরে ওঠে বন্ধুদের জন্য ভালোবাসার বার্তায়। বিপণনের কৌশল কাজে লাগিয়ে পণ্য বিকিকিনিরও পসরা খুলে বসে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান। বড় বড় হোটেল-রেস্তোরাঁয় থাকে দিবসটি উদ্​যাপনের নানা আয়োজন।

আজ পয়লা ফাল্গুন ‘বাতাসের ফাল্গুনী গান, ভরে তোলে আঙিনা বিতান।’

ভালোবাসা তো দুটি মানব-মানবীর সম্পর্ক বা চুক্তি শুধু নয়। ঘৃণা-হিংসা-বিদ্বেষের বিরুদ্ধে মানবতার এ এক অপূর্ব অনুভূতি। ভূপেন হাজারিকার সেই বিখ্যাত গানটি মনে আছে? ‘আমি ভালোবাসি মানুষকে, তুমি ভালোবাসো আমাকে, আমাদের দুজনার সব ভালোবাসা আজ এসো বিলিয়ে দিই এই দেশটাকে।’ এভাবে ভালোবাসা ছড়িয়ে পড়ে দেশ-দেশান্তরে। মানুষ বাঁচে আশা ও ভালোবাসায়।

লেখক: প্রথম আলোর যুগ্মসম্পাদক ও কথাসাহিত্যক