নারীর প্রশ্ন, চিকিৎসকের জবাব

>

আন্তর্জাতিক নারী দিবসের আয়োজন
‘ভালো থাকুন’ বিভাগে বহু নারী নানা স্বাস্থ্য সমস্যার সমাধান জানতে চেয়ে লিখেন। কিছু সমস্যার কথা নারীরা সংকোচের কারণে কাউকে বলতে পারেন না, এমনকি চিকিৎসককেও। আন্তর্জাতিক নারী দিবসে তাঁদের তেমন কিছু বাছাই প্রশ্নের জবাব দিয়েছেন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকেরা।

স্ত্রীরোগ

অধ্যাপক মালিহা রশীদ, সাবেক বিভাগীয় প্রধান, স্ত্রীরোগ ও প্রসূতিবিদ্যা বিভাগ, ঢাকা মেডিকেল কলেজ

 প্রশ্ন: ইমার্জেন্সি পিল কি বারবার খাওয়া ক্ষতিকর? কপার-টি পরলে কি পরবর্তী সময়ে জরায়ু ক্যানসার হয়?

উত্তর: এক মাসিক চক্রে দু-তিনবারের বেশি ইমার্জেন্সি পিল খাওয়া ঠিক নয়। বরং জন্মনিয়ন্ত্রণ বড়ি, কপার-টি অথবা কনডম ব্যবহার করা বেশি ভালো। কপার-টি একটি নিরাপদ পদ্ধতি, জরায়ু ক্যানসারের সঙ্গে এর কোনো সম্পর্ক নেই।

প্রশ্ন: জন্মনিয়ন্ত্রণ বড়ি খেলে কি ওজন বাড়ে? আমি মোটা, তাই বড়ি খেতে চাই না। তা ছাড়া পিল খেলে আমার মাইগ্রেনের ব্যথা বাড়ে। কোন পদ্ধতি ভালো হয়?

উত্তর: চতুর্থ প্রজন্মের পিল বা জন্মনিয়ন্ত্রণ বড়িতে পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া কম, ওজন বাড়ে না বললেই চলে। তবে পিলে মাইগ্রেনের ব্যথা বাড়তে পারে। সে ক্ষেত্রে শুধু প্রজেস্টেরন-সমৃদ্ধ পিল, কনডম, ইনজেকশন, কপার-টি ইত্যাদির যেকোনোটি ব্যবহার করা যায়।

প্রশ্ন: স্বামী বিদেশে থাকেন। বছরে দু-তিনবার আসেন। তখন সহবাসে প্রচণ্ড ব্যথা হয়। এটা কি অনভ্যাসের কারণে?

উত্তর: অনভ্যাস একটা ছোট কারণ বটে, তবে জরায়ু বা যোনিপথে কোনো সংক্রমণ, এন্ডোমেট্রিওসিস ইত্যাদিসহ আরও কোনো লুক্কায়িত কারণ থাকতে পারে। চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া দরকার।

প্রশ্ন: বয়স ৪৬ বছর। মাসিক অনিয়মিত। আমার কি মেনোপজ হয়ে যাচ্ছে বলে ধরে নেব? কোন জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি ব্যবহার করা দরকার এ সময়ে?

উত্তর: মাসিক পুরোপুরি বন্ধ না হওয়া পর্যন্ত জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি ব্যবহার করাই ভালো। তবে ৪৫ বছরের পর সন্তানসম্ভবা হওয়ার হার খুব কম। পুরো এক বছর যদি মাসিক বন্ধ থাকে, তবে মেনোপজ হয়ে গেছে বলে ধরে নিতে হবে।

সার্জারি

ডা. সামিয়া মুবিন, সহযোগী অধ্যাপক, সার্জিক্যাল অনকোলজি বিভাগ, বিএসএমএমইউ

প্রশ্ন: বয়স ২২ বছর। স্তনে ছোট ছোট গুটি আছে, পরীক্ষা করে দেখা গেছে ফাইব্রোসিস্টিক ডিজিজ। এটা থেকে কি ক্যানসার হতে পারে?

উত্তর: সাধারণত ফাইব্রোসিস্টিক ডিজিজ থেকে ক্যানসার হয় না। যদি এগুলো বড় চাকার আকার ধারণ করে এবং পরীক্ষায় অস্বাভাবিক কোষ পাওয়া গেলে ক্যানসারের ঝুঁকি সামান্য হলেও থাকতে পারে।

প্রশ্ন: সন্তান প্রসবের পর পাইলসের সমস্যা দেখা দিয়েছে। ব্যথা করে, ছোট মাংসপিণ্ডের মতো বেরিয়ে আসে, কখনো রক্তপাতও হয়। স্থায়ী চিকিৎসা কী?

উত্তর: গর্ভকালে ও সন্তান প্রসবের পর অনেক নারীরই পাইলস দেখা দেয়। চিকিৎসা নির্ভর করে এটি কোন পর্যায়ে আছে, তার ওপর।

প্রশ্ন: মাঝেমধ্যে স্তন ব্যথা করে, টান টান লাগে। অন্তর্বাস পরতে পারি না তখন। এটা কি খারাপ লক্ষণ?

উত্তর: স্তনে ব্যথা ও টাটানো, বিশেষ করে মাসিকের সময় বা আগে, খুবই স্বাভাবিক ব্যাপার। এটা হরমোনের ওঠানামার সঙ্গে জড়িত। অতিরিক্ত রাত না জাগা, ক্যাফেইন-সমৃদ্ধ খাবার (কফি, চা, চকলেট, কোল্ড ড্রিংকস) এড়িয়ে চলা, দুশ্চিন্তা না করা, সঠিক মাপের অন্তর্বাস ব্যবহার করতে পারেন। প্রয়োজনে চিকিৎসকের পরামর্শে কিছু ওষুধ সেবন করতে পারেন।

প্রশ্ন: আমার মা স্তন ক্যানসারে মারা গেছেন। আমার কি ঝুঁকি আছে?

উত্তর: পরিবারে স্তন ক্যানসারের ইতিহাস ঝুঁকি বাড়িয়ে দেয়। নিজে প্রতি মাসে মাসিক ভালো হয়ে যাওয়ার পর দুই হাতের তালু দিয়ে নিজের দুই স্তন টিপে টিপে পরীক্ষা করবেন। কোনো অস্বাভাবিকতা, চাকা বা গোটা অনুভব করলেই চিকিৎসকের শরণাপন্ন হতে দেরি করবেন না। এ ছাড়া প্রতিবছর ম্যামোগ্রাফি করবেন।

ত্বক

ডা. আনজিরুন নাহার আসমা, সহযোগী অধ্যাপক, চর্ম ও যৌন বিভাগ, পপুলার মেডিকেল কলেজ

প্রশ্ন: বয়স ২১ বছর। ঠোঁটের ওপর ও থুতনির নিচে হালকা লোম ছিল, যা দিন দিন বাড়ছে। থ্রেডিং করলে আবার ওঠে। এর সমাধান কী?

উত্তর: মুখে অবাঞ্ছিত লোমের নানা কারণ আছে। পলিসিস্টিক ওভারি সিনড্রোম, কুশিং সিনড্রোম, কিছু ওষুধের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া ইত্যাদি। আগে কারণ দূর করার চিকিৎসা করতে হবে। ওজন কমাতে হবে। হরমোনের ভারসাম্য ঠিক হওয়ার পর হেয়ার রিমুভালের জন্য লেজার সবচেয়ে কার্যকর পদ্ধতি।

প্রশ্ন: বয়স ১৬ বছর। মুখে প্রচুর ব্রণ বা পিম্পল হয়। এর কি কোনো সমাধান নেই?

উত্তর: বয়ঃসন্ধিকালে ব্রন হওয়া স্বাভাবিক। তবে অতিরিক্ত ব্রন হওয়ার পেছনে অন্য কারণও থাকতে পারে। খুব বেশি হলে কিছু মলম বা ওষুধের জন্য বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের পরামর্শ নিন।

প্রশ্ন: সন্তান হওয়ার পর থেকে প্রচুর পরিমাণে চুল পড়ছে। ভিটামিন সাপ্লিমেন্ট খেলে কি চুল পড়া কমবে?

উত্তর: সন্তান হওয়ার পর হরমোনের ভারসাম্যহীনতার কারণে চুল পড়ার পরিমাণ বেড়ে যায়। আয়রন, জিংক, ফলিক অ্যাসিড, ভিটামিন ডি ও ক্যালসিয়াম সাপ্লিমেন্ট খাওয়া যেতে পারে। থাইরয়েড, খুশকি বা অন্য কোনো কারণ আছে কি না দেখে নিলে ভালো।

প্রশ্ন: তলপেটে প্রেগন্যান্সির সাদা দাগ ওঠানোর কোনো উপায় আছে কি?

উত্তর: প্রেগন্যান্সির দাগ পুরোপুরি ওঠানোর তেমন কার্যকর উপায় নেই। কিছু ক্রিম ব্যবহার করা যায়, যা ৩০ শতাংশের মতো কাজ করে। বর্তমানে কিছু আধুনিক পদ্ধতি, যেমন লেজার, মাইক্রোনিডলিং বা ডারমারোলার মাধ্যমে ওঠানোর চেষ্টা করা হয়, কিন্তু শতভাগ সফলতা নেই।

হরমোন ও ডায়াবেটিস

ডা. তানজিনা হোসেন

সহকারী অধ্যাপক, এন্ডোক্রাইনোলজি বিভাগ, গ্রিন লাইফ মেডিকেল কলেজ

প্রশ্ন: বয়স ২৬। ১৭ বছর বয়স থেকে হাইপোথাইরয়েড ও থাইরক্সিন নিয়মিত খাই। সম্প্রতি বিয়ে হয়েছে। শুনেছি থাইরয়েডের সমস্যা থাকলে সন্তান বিকলাঙ্গ হয়। আমি কি সন্তান নিতে পারব?

উত্তর: নিয়মিত ওষুধ খেয়ে রক্তে থাইরয়েড হরমোন নিরাপদ মাত্রায় রাখতে পারলে এবং গর্ভকালে নিয়মিত মনিটরিংয়ে থাকলে নিশ্চিন্তে সন্তান নিতে পারবেন।

প্রশ্ন: গর্ভকালীন অবস্থায় ডায়াবেটিস দেখা দিয়েছিল এবং ইনসুলিন গ্রহণ করতে হয়েছিল। সন্তান হওয়ার পর স্বাভাবিক হয়ে গেছে। আবার কি ডায়াবেটিস হতে পারে?

উত্তর: বেশির ভাগ গর্ভকালীন ডায়াবেটিস সন্তান প্রসবের পর স্বাভাবিক হয়ে যায়। তবে সন্তান জন্মের ৪ থেকে ১২ সপ্তাহের মধ্যে আরেকবার ওরাল গ্লুকোজ টলারেন্স টেস্ট করে নিশ্চিত হয়ে নেওয়া দরকার যে রক্তে শর্করা পুরোপুরি স্বাভাবিক নাকি প্রি-ডায়াবেটিস বা ডায়াবেটিস পর্যায়ে আছে। যদি স্বাভাবিক মাত্রায় থাকে, তবে প্রতি এক থেকে তিন বছর পরপর ওই টেস্ট করা প্রয়োজন।

প্রশ্ন: বয়স ৪৭। জরায়ু ফেলে দেওয়া হয়েছে দেড় বছর আগে। প্রচণ্ড গরম লাগে, ঘাম হয়, হট ফ্লাশে কষ্ট পাই। আমি কি হরমোন থেরাপি নিতে পারব?

উত্তর: হট ফ্লাশ বেশি হলে কিছুদিন হরমোন থেরাপি নিতে পারেন। রক্তে চর্বির মাত্রা বেশি, হৃদ্‌রোগ, পরিবারে স্তন ক্যানসারের ইতিহাস বা রক্ত জমাট বাঁধার ঝুঁকি থাকলে হরমোন থেরাপি বিপজ্জনক। তবে সিনথেটিক ইস্ট্রোজেন অপেক্ষাকৃত নিরাপদ। বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের পরামর্শ নিয়ে তারপর হরমোন নিন।

প্রশ্ন: ডায়াবেটিস হলে জন্মনিয়ন্ত্রণ বড়ি সেবন করা যাবে?

উত্তর: জন্মনিয়ন্ত্রণ বড়ি সেবনে বাধা নেই। কিছু বড়ি ওজন ও রক্তে চর্বি বাড়ায়, যা ডায়াবেটিস রোগীর হৃদ্‌রোগের ঝুঁকি বাড়াতে পারে। তাই যেসব বড়িতে ইস্ট্রোজেনের মাত্রা কম, সেগুলো খাওয়া ভালো।