ভিনেগার লাগে কত কাজে

ভিনেগার বা সিরকা এখন শুধুই রান্না বা আচারের উপকরণ নয়। স্বাস্থ্য ও সৌন্দর্যসচেতন মানুষের কাছেও এর কদর কম নয়। তবে ত্বক ও চুলে লাগাতে এবং ওজন কমাতে সরাসরি সাদা ভিনেগার পান করা যাবে না। বেছে নিতে হবে অ্যাপল সিডার ভিনেগার বা এসিভি। সহনীয় মাত্রার অম্লমিশ্রণ এবং শরীরের জন্য প্রয়োজনীয় উপাদান থাকার কারণে দিন দিন বাড়ছে এসিভির ব্যবহার।

সুস্থ থাকতে ভিনেগার
ওজন কমাতে অ্যাপল সিডার ভিনেগারের ব্যবহার আজকের নয়। শরীরের কোলেস্টরল কমাতে, বারবারÿক্ষুধা লাগার প্রবণতা কমাতে কাজে আসে এই এসিভি। গাঢ় মধুর মতো রং আর হালকা টক গন্ধের এসিভিতে আছে সেলুলোজ এবং অ্যাসিটিক অ্যাসিডের এমন একটি সমন্বয়, যা শরীরে কোলেস্টেরলের মাত্রা কমাতে সাহায্য করে।
রাজধানীর ল্যাবএইড হাসপাতালের প্রধান পুষ্টিবিদ সালমা পারভিন জানালেন, প্রতিদিন এক থেকে দুই চামচ এসিভি শুধু ওজন কমায় না, মেটাবলিজম বাড়ায়, অ্যান্টিঅক্সিডেন্টের জোগান দেয়। এতে প্রচুর পরিমাণে আঁশ (ফাইবার) আছে, যা কোষ্ঠকাঠিন্য কমাতে সহায়ক। টাইপ টু ডায়াবেটিস ও উচ্চ রক্তচাপের ঝুঁকি কমিয়ে শরীরে হৃদ্রোগের আশঙ্কা কমায়। তবে ডায়াবেটিসের জন্য যদি আপনার ওষুধ খেতে হয় তবে অবশ্যই চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে। ভিনেগারের কটু গন্ধ ও স্বাদ অনেকেই সহ্য করতে পারেন না। সে ক্ষেত্রে সালমা পারভিন পরামর্শ দিলেন সালাদের ড্রেসিং হিসেবে অ্যাপল সিডার ভিনেগার ব্যবহার করার।
কিছু কিছু ক্ষেত্রে এসিভি খাওয়া সম্পূর্ণ নিষেধ বলে জানালেন সালমা পারভিন। কিডনি রোগী, অন্তঃসত্ত্বা মা এবং শিশুকে দুধ খাওয়ান এমন মায়ের এসিভি খাওয়া নিষেধ। এতে করে শরীরে চিরস্থায়ী ক্ষতির আশঙ্কা থাকে।
শরীরের ভেতরে শুধু নয়, বাইরের যত্নেও এসিভির তুলনা নেই। একমাথা সুন্দর চুল পেতে, ত্বক সাজাতে কত প্রসাধনীও না ব্যবহার করা হয়। কিন্তু দিন শেষে মেকআপ ও ব্যস্ততার পরত সরানোর কথা ভাবেন কয়জন। অথচ গোসলের সময় চুল ও ঘুমানোর আগে ত্বক পরিষ্কার রাখাটা খুব দরকার। কারণ ঘুমের মধ্যেই শরীর নিজ থেকেই নিজের ধকল সারিয়ে তোলার কাজটি করে। তাই রূপচর্চায়, ত্বকের ও চুলের যত্নে ভিনেগারের ব্যবহার বাড়ছে দিন দিন। কিন্তু কীভাবে নিরাপদে ত্বক ও চুলের যত্নে ভিনেগার ব্যবহার করবেন? তারই কিছু উপায় বাতলে দিলেন বিন্দিয়া এক্সক্লুসিভের প্রধান রূপবিশেষজ্ঞ শারমিন কচি।

ঝলমলে চুল পেতে
চুলে প্রাকৃতিক উজ্জ্বলতা নিয়ে আসতে চাইলে ব্যবহার করতে পারেন এসিভি। চুলে শ্যাম্পু করার পর এক মগ পানিতে এক টেবিল চামচ এসিভি মিশিয়ে ধুয়ে নিন চুল। এতে করে চুলে জমে থাকা ধুলার পরত চলে যাবে। খসখসে চুল নরম করতে ভেজা চুলের গোড়ায় আঙুল বা তুলার সাহায্যে ১: ২ অনুপাতে এসিভি এবং পানির মিশ্রণ লাগান এবং ১০ মিনিট চুল আঁচড়ে নিন। এরপর ঠান্ডা পানি দিয়ে ধুয়ে ফেলুন। এটি চুলকে নরম এবং ঝলমলে করে, তাই এরপরে আর কন্ডিশনার ব্যবহার করতে হবে না।
উকুনও মারতে পারে এসিভির। দুই টেবিল চামচ নারকেল তেল কুসুম গরম করে নিন, তাতে মেশান এক টেবিল চামচ এসিভি। চুলের আগা থেকে গোড়া পর্যন্ত ঘষে ঘষে লাগান। মিনিট পনেরো পরে ধুয়ে ফেলুন। সপ্তাহখানেকের মাথায় চুল থেকে উকুন চলে যাবে।
চুল পড়া কমাতেও কাজে আসে অ্যাপল সিডার ভিনেগার। এই জন্য এসিভি পেস্ট তৈরি করে ব্যবহার করুন। এক টেবিল চামচ এসিভির সঙ্গে সমপরিমাণ পানি এবং অ্যালোভেরা জেল ফেটিয়ে ঘন করে নিন। মাথার ত্বকে ঘষে ঘষে লাগান। তারপর একটি তোয়ালে দিয়ে চুল মাথা মুছে রাখুন ৩০ মিনিট। এভাবে সপ্তাহে তিন দিন এই প্যাকটি লাগান। চুলের ঘনত্ব বাড়বে, চুল পড়াও কমবে।
ছত্রাক ও খুশকি কমাতে আধা কাপ অ্যাপল সিডার ভিনেগার, এক কাপ টক দই এবং এক কাপ পানি মিশিয়ে পেস্ট তৈরি করুন। চুলের আগা থেকে গোড়া পর্যন্ত ঘষে ঘষে লাগিয়ে চুল আঁচড়ে নিন। মিনিট পনেরো পরে ধুয়ে ফেলুন।

ত্বকের যত্নে, ত্বকের সুরক্ষায়
শারমিন কচি জানালেন, ত্বককে সুন্দর ও নিরাপদ রাখতে এসিভির তুলনা নেই। সাধারণত আমাদের ত্বকে একধরনের অ্যাসিডের প্রলেপ থাকে, যা ক্ষতিকর জীবাণুকে ত্বকে প্রবেশ করতে বাধা দেয়। নানা ধরনের পদার্থ ব্যবহার করতে করতে সেই অ্যাসিডের পরিমাণ কমতে থাকে এবং আমাদের ত্বকে জীবাণু প্রবেশ করতে আর কোনো বাধা পায় না। এভাবেই একসময় ত্বকে ব্রণ ও র‌্যাশের জন্ম হয়, ছত্রাকজনিত সংক্রমণ (ইনফেকশন) বাড়ে। এসিভি ত্বকে উপকারী অ্যাসিডের পরিমাণ ঠিক রাখে, পিএইচ ব্যালান্স করে এবং ত্বককে জীবাণু প্রতিরোধে সাহায্য করে।
মেকআপ তোলার পরে কিংবা সারা দিনের ব্যস্ততা শেষে ধুলোবালি ও ময়লায় আমাদের লোমকূপগুলোর মুখ বন্ধ হয়ে যায়। এর ফলে ত্বকে অক্সিজেনের ঘাটতি হয়। তাই গোসলের পানিতে হালকা এসিভি মিশিয়ে নিতে পারেন। সারা শরীরের লোমকূপ শ্বাস নেওয়ার সুযোগ পাবে। প্রতিদিন ঘুমানোর আগে টোনার হিসেবে ব্যবহার করতে পারেন অ্যাপল সিডার ভিনেগার। এক চামচ পানি, এক চামচ গোলাপজল এবং এক চামচ এসিভি মিশিয়ে নিন। এরপর তুলোর সাহায্যে ত্বকে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে মাখুন। এক মিনিট রেখে দিন, তারপর ঠান্ডা পানির ঝাপটা দিয়ে মুখ ধুয়ে ফেলুন। এতে করে লোমকূপের ময়লা কেটে যাবে। ত্বকের ওপরে সারা দিনের ধকল রাতারাতি সারাতেও এর জুড়ি নেই।

রোদের আঁচ ঠেকাতে
গরমের দিনে চেহারায় রোদে পোড়া কালচে ছোপ বা সানবার্ন সাধারণ একটি সমস্যা। কালচে ছোপ কমাতে জুড়ি নেই এসিভির। এক কাপ এসিভি, এক কাপ গোলাপজল, এক কাপ পানির মিশ্রণ তৈরি করে ফ্রিজে রেখে দিতে পারেন। ঘরে ফিরে মুখ, গলা, হাত এবং পায়ে মেখে বাতাসে শুকিয়ে নিন এক মিনিট। এরপর নরম কাপড়ের সাহায্যে আলতো করে ঘষে পরিষ্কার করে নিন।
স্বল্প সময়ে ব্রণ সারানোর ভালো উপায় অ্যাপল সিডার ভিনেগার। এটি খুব দ্রুত ত্বকের গভীরে প্রবেশ করতে পারে, ফলে ব্রণের জীবাণু ধ্বংস করতে এটি অতুলনীয়। তাই ব্রণ হলে একটি কটনবাড অ্যাপল সিডার ভিনেগার ও পানির মিশ্রণে ডুবিয়ে নিন, তারপর সরাসরি ব্রণের ওপরে ও আশপাশে চেপে ধরুন। এভাবে সকাল–বিকেল দুবার যত্ন নিন। ব্রণের জীবাণু পুরোপুরি শেষ তো হবেই, দাগও পড়বে না।

ফুসকুড়ি ঠেকাতে
রেজর ব্যবহারের ফলে অনেকের ত্বকেই ছোট ছোট ফুসকুড়ির মতো রেজর বাম্প দেখা যায়। রেজর ব্যবহার করার পরে আলতো করে পানি ও এসিভি মিশিয়ে আফটার শেভের বদলে ব্যবহার করুন। কোনো সংক্রমণ হবে না, রেজারের ফলে তৈরি হওয়া ত্বকের শক্ত ভাবও ধীরে ধীরে কেটে যাবে। অনেকের রেজর বাম্পের কারণে ত্বকে ছোট দাগ পড়ে যায়। আফটার শেভ হিসেবে এসিভি ব্যবহারে একসময় তা–ও আর থাকবে না।

গন্ধ দূর করতে
এসিভির আরেকটি কার্যকরী ব্যবহার হলো দুর্গন্ধনাশক হিসেবে কাজ করা। সামনেই আসছে গরমের দিন। আর্ম পিট এবং পায়ে মোজার গন্ধে অনেকেই পড়তে পারেন বিব্রত অবস্থায়। তাই গোসলের পরে আলতো করে এসিভি ও পানির মিশ্রণ মেখে নিন বগলে এবং পায়ে। ব্যাকটেরিয়া তো মরবেই, ধীরে ধীরে ঘামের গন্ধও চলে যাবে। দিন শেষে ঘরে ফিরে কুসুমগরম পানিতে এক চামচ অ্যাপল সিডার ভিনেগার মিশিয়ে নিন। পায়ের মালিশ হবে, জীবাণুর সংক্রমণ কমবে, কালো ছোপও ধীরে ধীরে চলে যাবে।