পরমানন্দে প্রমোদযাত্রা

>
প্রমোদতরি সিলিয়া লাইন। ছবি: লেখক
প্রমোদতরি সিলিয়া লাইন। ছবি: লেখক
সিলিয়া লাইন ১৩ তলাবিশিষ্ট প্রমোদতরি। জাহাজ তো নয়, যেন ভাসমান–চলমান আধুনিক এক শহর। ফিনল্যান্ডের রাজধানী হেলসিঙ্কি থেকে সুইডেনের স্টকহোমগামী এই প্রমোদতরিতে যাত্রার কথাই রইল এখানে।

জাহাজের ভেতরে ঢুকতেই অভ্যর্থনা জানালেন একদল বাদ্যযন্ত্রী। বাদকদের হাতে সুর ছড়াচ্ছে পিয়ানো, বাঁশি আর স্যাক্সোফোন। আপন খেয়ালে বাজিয়েই চলেছেন তাঁরা। মূল ফটক পেরিয়ে একটু এগোই, ভেতরে যেতেই স্বাগত জানালেন একজন ছদ্মবেশী মানুষ। প্রাচীন মানুষের মতো তিনি সঙ সেজেছেন। হাতটা বাড়িয়ে দিয়ে বললেন, ‘ওয়েলকাম’। তাঁকে ধন্যবাদ জানিয়ে করিডর ধরে সামনের দিকে এগিয়ে যেতেই চোখে পড়ল জাদুকরের ভেলকি। আরও কিছুদূর গিয়ে ভড়কে গেলাম রাজা-রানিকে দেখে, তাঁরা অপূর্ব দেহভঙ্গিমায় নেচে চলেছেন। উচ্চতা ৮-১০ ফুট। পরে জানলাম, আদতে তাঁরা রণপাশিল্পী, তাই উচ্চতার এই হাল!

ঠিক বিকেল পাঁচটায় জেটি ছাড়ল জাহাজ। এর মধ্যে কেবিনটা বুঝে নিলাম। আমার কেবিন ছিল পঞ্চম তলায়। ১৩ তলা প্রমোদতরির অনেকটা নিচের দিকে বলে ভাড়াও কিছুটা কম। বাংলাদেশি টাকায় চার হাজার টাকা।

বিকেল গড়িয়েছে। দিনের সূর্যকে বিদায় বলা দরকার। ব্যাগ রেখে তাই ডেকের দিকে চলে গেলাম। সাগরে ভেসে সূর্যাস্ত ও সূর্যোদয় দেখার মতো মনোমুগ্ধকর দৃশ্য আর দ্বিতীয়টি নেই! তাই আর যা–ই হোক, সন্ধ্যার সূর্যাস্ত মিস করা যাবে না।

জাহাজের ভেতরটা যেন আধুনিক বিপণিবিতান
জাহাজের ভেতরটা যেন আধুনিক বিপণিবিতান

জাহাজ চলছে বাল্টিক সাগরের বুক চিরে। একটু একটু করে বাড়ছে হেলসিঙ্কি থেকে দূরত্ব। দৃষ্টিসীমার বাইরে চলে যাওয়ার আগেই আরেকবার চোখ ফেরালাম ফিনিশ রাজধানীর দিকে। সবুজঘেরা হেলসিঙ্কি। মাথা উঁচু করে দাঁড়ানো বাড়িগুলো দূর থেকে দেখতে ভালো লাগছে। সেই সঙ্গে ঐতিহ্যের গর্বে মাথা উঁচু করে দাঁড়ানো হোয়াইট চার্চ নীরবে বিদায় বলছিল।

দ্রুতগতিতে এগিয়ে চলছে সিলিয়া লাইন। দূরে মিলে গেছে হেলসিঙ্কি। এখন বাল্টিক সাগরের বুকে জেগে ওঠা অসংখ্য ছোট-বড় দ্বীপ দৃষ্টি কাড়ছে। ইচ্ছা হচ্ছিল লাফ দিয়ে সাগরে নেমে পড়ি, সাঁতার কাটতে কাটতে চলে যাই দ্বীপে। কিন্তু ইচ্ছাটা গোপনই করতে হলো!

ততক্ষণে অস্তগামী সূর্যের রক্তিম আভা ছড়িয়ে পড়েছে আকাশে। তার ছায়া পড়েছে সমুদ্রজলে; যেন তা দিগন্তবিস্তৃত একটা রক্তিম চাদর। ধীরে ধীরে সন্ধ্যা নামল। আরও কিছুটা পর গাঢ় অন্ধকারে হারিয়ে গেল আকাশ, সাগর আর দৃষ্টিসীমার বাইরে চলে গেল সাগরপারের প্রকৃতি। তখন হেসে উঠল আকাশের গায়ে মিটিমিটি খুদে তারার দল। দূরে, বহুদূরে সমুদ্রের বুকে নিজের অস্তিত্ব জানান দিচ্ছে মাছধরার নৌকাগুলো।

রাত কাটল গানে গানে

প্রমোদতরির নাম সিলিয়া লাইন। উচ্চতায় ১৩ তলা। যাত্রী ধারণক্ষমতা তিন হাজার। একতলা থেকে অন্য তলায় ওঠার জন্য রয়েছে অনেক লিফট। জাহাজ তো নয়, বড়সড় বিপণিবিতানসহ গোটা এক শহর যেন বাল্টিক সাগরের বুক চিরে এগিয়ে চলেছে। যেখানে কোনো কিছুরই কমতি নেই। আছে টোল ফ্রি দোকান। চাইলে সাগরে ভাসতে ভাসতে প্রয়োজনীয় কেনাকাটাও সেরে নেওয়া যায়।

বিশাল আয়তনের অত্যাধুনিক রেস্তোরাঁও আছে। চাইলে মনমতো পেট পুজো করতে পারেন। খাবারের মেনুও জিবে জল এনে দেওয়ার মতো—নানা রকম সামুদ্রিক মাছ, চিংড়ি, লবস্টার, ঝিনুক ও সালাদ আরও কত–কী! আছে বার, ডিসকো, সুইমিংপুল, অত্যাধুনিক স্পা সেন্টার। এখানেই শেষ নয়। চিত্তবিনোদনের নানা ব্যবস্থাও রয়েছে সিলিয়া লাইনে। থিয়েটারও দেখা যায়। সারা রাত মোহাবিষ্ট করে রাখবে বিখ্যাত শিল্পীদের নাচ-গানের পরিবেশনা। শিশুদের জন্যও রয়েছে আলাদা ব্যবস্থা। আর একান্তই যদি হুল্লোড় পছন্দ না হয়, তাদের জন্য নাক ডেকে ঘুমানোর ব্যবস্থা তো আছেই!

জাহাজের ভেতরে অভ্যর্থনায় রাজা–রানির বেশে দুই রণপাশিল্পী। সঙ্গে লেখক
জাহাজের ভেতরে অভ্যর্থনায় রাজা–রানির বেশে দুই রণপাশিল্পী। সঙ্গে লেখক

সেই রাতজুড়ে ব্যান্ড শো হলো। শোর নাম স্ক্যান্ডিনেভিয়ান শো। পরিবেশনায় ছিল স্ক্যান্ডিনেভিয়ার একটি ব্যান্ড দল। সেই সঙ্গে নাচ হলো। নাচের আয়োজন দেখার মতো। সেখানে অংশ নিয়েছিল সব বয়সী মানুষ। এক ফাঁকে সুইমিংপুলে গা ভেজালাম। রাতে পেট ভরে খাওয়ার পর ঘুমটাও সেরে নিয়েছিলাম।

স্বাগত জানাল স্টকহোম

টানা ১৬ ঘণ্টার যাত্রা শেষ হলো পরদিন সকালে। চনমনে দেহ ও ফুরফুরে মেজাজ নিয়ে স্টকহোমের রাজপথে পা রাখলাম। স্টকহোমকে বলা হয় ‘সিটি অব ওয়াটার’। নামটি সংগত, বাল্টিক সাগরের অসংখ্য সামুদ্রিক খাঁড়ি বা ফিয়র্ড শিরা-উপশিরার মতো ছড়িয়ে পড়ছে শহরটিতে। ভ্রমণপিপাসু মানুষের রোদ পোহানোর জন্য বেছে নিই ফিয়র্ডের তীরগুলোকে। যানজটমুক্ত শান্ত এক শহর। রাস্তায় ধুলাবালু নেই, যানবাহনের কালো ধোঁয়া নেই, নেই ড্রাইভারদের ইচ্ছেমতো হর্ন বাজানোর প্রতিযোগিতা। থাক সেই স্টকহোম–বৃত্তান্ত, বলা যাবে নাহয় অন্য কোনো দিন!