'আপনার শরীরের ইশতেহার কী?'

ঠক ঠক; দরজা খুলে গেল। পা বাড়ালেই প্রদর্শনী। প্রশ্ন উঠতে পারে, প্রদর্শনী তো দ্বার রুদ্ধ কেন? সে প্রসঙ্গে পরে আসি। দরজা পেরোলেই রুদ্ধদ্বার প্রদর্শনীর আপাতসীমিত, আদতে বৃহৎ ময়দান। সটান তাকালে সুলতানের এলোচুল ছবি ফুঁড়ে বাইরে এসে পড়েছে। প্রসাধন চাই তার, সুতরাং আরশিও। তার সঙ্গে বহু কথা। তাই একটু এড়িয়েই যেতে হয় ভেতর গ্রামে। গ্রাম মানে তো জগৎ, যার থাকে নিজস্ব অবগুণ্ঠন। এখানেও আছে লাল পর্দা, আছে জাগতিক সংজ্ঞায়নের অঢেল আরোপের চিহ্নবাহী দরজা। বোঝা গেল এ সংজ্ঞাগুচ্ছ, যা বুড়ো হতে হতে হয়ে গেছে প্রতিষ্ঠান ও পাথর, তা পেরিয়েই যেতে হবে নতুন এ গ্রামে।

দ্বিতীয় দরজা থেকে সোজা তাকালেই চোখে পড়বে একটি সংলাপ। সংলাপ নাকি বিবৃতি? সে যা-ই হোক, ‘রোবটই একমাত্র বাইনারি মেনে চলে’ কথাটা বারবার নানা আকারে সেঁটে রাখা যে ছবি, তা যেন এই বিবৃতি বা সংলাপকে মাথায় গেঁথে দিতে চাইছে। তা যেন বলছে, দরজায় লেখা সংজ্ঞাগুচ্ছ থেকে বেরিয়ে এসে দাঁড়াও। সংজ্ঞাগুচ্ছ বলতে, জগৎকে সাদা-কালোয় দেখার অভ্যাসকে ছেড়ে আসার কথা বলা হচ্ছে। বাইনারি বা দ্বিমিক জগতের বাইরে আরও বড় ও বর্ণিল জগতের দিকে ডাকছে। হ্যাঁ, রোবট মানেই দ্বিমিক সমন্বয়। যন্ত্র মানেই দ্বিমিক। প্রাণ তো আলাদা, বৈচিত্র্যময়। আর মানুষ যেহেতু শেষতক প্রাণই, তাই তারও আকারে প্রকারে বৈচিত্র্যই দস্তুর। এই ভাবতে ভাবতেই মনে পড়ল, এই যে প্রদর্শনী, এর শিরোনাম তো ‘জেন্ডার ইজ আ পারফরম্যান্স’। তাহলে দ্বিমিক প্রশ্নটি দাঁড়াচ্ছে কোথায়? নারী ও পুরুষে? শূন্য ও একের সমন্বয়? যদি তা-ই হয়, তাহলে আরও ভালো করে তাকাতে হয় মাইক্রো গ্যালারি অ্যাপিফেনিয়ার প্রদর্শনকক্ষের দিকে।

শিল্পী ও গবেষক দীপ্তি দত্তের কিউরেশনে এ প্রদর্শনীতে স্থান পেয়েছে বাংলাদেশসহ কয়েকটি দেশের শিল্পীদের শিল্পকর্ম, বয়ানের দিক থেকে যেগুলো কাছাকাছি। বাংলাদেশের জর্ডান আসওয়াদ ও ভারতের ট্যাক্সি—দুই শিল্পীরই উপস্থাপনরীতি ও উপজীব্য খুব কাছাকাছি। রয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের কম্পোজার রেনুর কম্পোজিশনের সঙ্গে ইরানের শিল্পী এলিনার পারফরম্যান্স। দরজার পাশেই অগণিত সংজ্ঞায়ন টপকে কণ্ঠচেরা পাখি নিয়ে রয়েছে শিল্পী রাসেল রানার কাজ। ভূমিতে দারুণ তির্যক প্রশ্ন নিয়ে হাজির আছে নন্দন ভাবনা ও প্রচারের একমুখী বয়ানের ভিডিওসমেত ফেনিয়া কতসোজুলুর কাজ, যেখানে সরাসরি জানতে চাওয়া হচ্ছে দর্শকের শরীরের ইশতেহার সম্বন্ধে। এই দ্বিতীয় কক্ষটি শিল্পের ভাষায় প্রতিনিয়ত আলাপে ব্যস্ত, ভীষণ মুখর। দর্শকমাত্রই এই আলাপে এই মুখরতায় ডুবে যেতে হবে। এই কক্ষে ছড়ানো কাজের কোনোটিতে নারী-পুরুষের মিলিত মুখচ্ছবি, কোনোটিতে নারীর পুরুষবোধ, আবার কোনোটিতে পুরুষের নারীবোধের প্রকাশ প্রাধান্য পেয়েছে। কোনোটিতে আবার শরীরে নারীর কণ্ঠ চিরে উঁকি দিয়েছে এক পাখি, চারপাশে লতাগুল্ম ও পাতায় পালকে বিম্বিত প্রসঙ্গের দিকে চেয়ে আছে যে। এই কণ্ঠচেরা পাখিই হাজির করেছে প্রশ্ন সমষ্টিকে। কী সেই প্রশ্ন? প্রশ্নটি কি এই যে, ‘এই শরীরই আমি, নাকি শরীরের ভেতরটা আমি?’ কথা হচ্ছে এই ‘আমি’ বলতে যদি ভেতর বাড়িকে বোঝানো হয়, তবে তাকাতে হয় বিম্বের দিকেই। সেখানে কী? নর ও নারীর বিপরীত ও মিলিত প্রকাশ ছাড়া তো আর কিছুই দৃষ্টিগ্রাহ্য হলো না। তার মানে ভেতর মহলের লিঙ্গবোধটা নিয়েই আলাপ। আরও ভালো করে বললে, যৌনতার রেখাটিই এখানে মুখ্য। এই বোধ থেকে উৎসারিত যৌনতার রেখাটি কোন দিকে যাবে, কোন অভিমুখে ছুটবে, তা-ই এখানে দৃশ্যমান। যে পুরুষ-শরীর নারীবোধটি নিয়ে বেড়ে উঠছে, তার অভিমুখটি আরেকজন পুরুষের দিকে, আবার যে নারী শরীর বেড়ে উঠছে পুরুষবোধ নিয়ে, তার অভিমুখ থাকছে নারীর দিকেই (বিষয়টি বুঝতে হলে আততায়ীর হামলায় নিহত অভিজিৎ রায়ের সমকামিতা পড়া যেতে পারে)।

আবার যে শরীর কখনো নারী, কখনো পুরুষবোধ নিয়ে বেড়ে উঠছে, তার আকর্ষণটিও এই দুইয়ের মধ্যেই অবিরত দোল খাচ্ছে। শারীরিক প্রকাশ যেমনই হোক ভেতর মহলের লিঙ্গবোধকে বিবেচনায় নিলে বিপরীতই মিলনের জন্য পরস্পরের দিকে আকৃষ্ট হচ্ছে। অর্থাৎ যৌনবোধটি একমুখীই থেকে যাচ্ছে। আসতে পারে বৃহন্নলা বা হিজড়ার যুগলসত্তার কথা। সে ক্ষেত্রে প্রশ্নটি তো আর দ্বিমিকে আটকে থাকছে না। প্রশ্নটি সীমায়িত হয়ে যৌনতার একরৈখিক দৃষ্টিভঙ্গির প্রতিই তখন ছুটে যাচ্ছে? এই একমুখী দৃষ্টিভঙ্গিটি ভাঙা যেত, যদি গ্রেসি গিল্ডারের মতো উদাহরণকে এখানে আনা যেত। গ্রেসি গিল্ডার হচ্ছে সেই নারী, যিনি কয়েক বছর আগে নিজেকে নিজেই বিয়ে করেন। এ ক্ষেত্রে ওপরের আলাপটি থেকে গ্রেসি গিল্ডার আলাদা হয়ে যান। কারণ গ্রিক মিথের নার্সিসাসের মতোই তিনি শতভাগ আত্মপ্রেমে মগ্ন। তাঁর বা নার্সিসাসের লৈঙ্গিক বোধটি যা-ই হোক না কেন, তা নিজেকেইে শেষতক আলিঙ্গন করে। অন্যদিকে বর্তমান দুনিয়ায় সমকাম বলতে যা বোঝায়, তা তো আদতে ব্যাখ্যার নাওয়ে চড়ে বিপরীত কামের রূপই মূলগতভাবে ধারণ করে। ফলে এই বয়ানে দাঁড়িয়ে কৌর চিমুকের তোলা প্রশ্নটি দিক বদলে একরৈখিকতাকে লক্ষ্য করেই ছুটে যায়। অবশ্য তাতে ক্ষতিবৃদ্ধি তেমন হয় না। কারণ প্রশ্নটি বহুত্ব অর্জনে প্রয়াসী।


প্রকাশের ক্ষেত্র এলে আসে ভেতর মহলের বোধটি কে কীভাবে প্রকাশ করছে, সে প্রশ্ন। এ ক্ষেত্রেও দেখা যাচ্ছে সমাজের প্রচলিত সংজ্ঞায়ন মেনে নারীবোধের পুরুষটি নারীর প্রসাধন ও পরিচ্ছদই বেছে নিচ্ছে তার প্রকাশ হিসেবে, নতুন কোনো প্রকাশমাধ্যমের সন্ধানে না নেমে। ঠিক বিপরীত কথাটিও সত্য। তবে সমভাবে নয়। পোশাকের রাজনীতি ও সংজ্ঞায়নের দিকে তাকালে দেখা যাবে, পুরুষ কাঠামোয় কোনো নারীর পুরুষ পোশাক বেছে নেওয়াটা এখন আগের তুলনায় গ্রহণযোগ্য। বিপরীতটি একেবারেই নয়। বিপরীত প্রকাশে, অর্থাৎ সংজ্ঞার পৃথিবীতে দাঁড়িয়ে কোনো পুরুষ স্কার্ট বা শাড়ি পরে ঘুরে বেড়ালে তা নিয়ে তামাশা চলে রীতিমতো (আর এ কারণেই অন্তরবাড়ির প্রকাশের এই প্রদর্শনীটি হতে হয় রুদ্ধদ্বার, যেহেতু সমাজ এখনো প্রস্তুত নয়, যেহেতু সমাজে প্রশ্নই মৃত্যুর কারণ)। (যদিও প্রাচীন গ্রিক কিংবা রোমান কিংবা স্কটিশ পোশাকে পুরুষের এমন পোশাকই ছিল দস্তুর। মুঘলদের পোশাককে তো ঘাঘরাই বলা যায়।) এই দিক বিবেচনায় ‘আমি যা, আমাকে সেই মতোই গ্রহণ করতে হবে’ সেই দাবিটিকে উড়িয়ে দেওয়া যায় না। অর্থাৎ আমার ভেতর বাড়ি নারীর, তাই আমার অবয়ব পুরুষের হলেও পোশাকে আমার প্রকাশ নারীরই হবে এবং তা প্রচল সংজ্ঞা মেনেই; আর তা তোমাকে আগে গ্রহণ করতে হবে, পরে ভাবা যাবে ভিন্ন প্রকাশের কথা। এই বিবেচনাটিকে তাই স্বীকার ও সমর্থন করতেই হয়। কিন্তু তাতেও প্রশ্নটিকে ধামাচাপা দেওয়া যায় না। অর্থাৎ বাইনারিকে (আমি যাকে একরৈখিক বলছি) খারিজ করে এই প্রকাশ আদতে কোন বহুত্বকে আনছে আমাদের সামনে?
ওপরের প্রশ্নটি দরজায় নানা আকারের শব্দমালা লিখে দীপ্তি দত্ত বেশ ভালোভাবেই উত্থাপন করেছেন। একটু তাকানো যাক শব্দগুলোর দিকে—রাধা, রূপান্তর, নমশূদ্র, হিজড়া, পেশি, গোঁসাই, রঙের সংসার, বেড়া, প্রাকৃতিক, মৃত্যু, শরীর, নূপুর, পাগল, দুঃখ, বিব্রত, ঘুঙুর ইত্যাদি। অর্থাৎ দীপ্তি দত্ত তাবৎ সংজ্ঞায়নকেই প্রশ্নের আওতায় আনতে চাইছেন, যা একজন ব্যক্তিক মানুষকে বা তার কোনো অবস্থাকে প্রকাশে সমাজ যূথবদ্ধভাবে প্রায়শই ব্যবহার করে। সামাজিক শ্রেণি, সাহিত্যিক অনুপ্রাস, শরীর, নানা অভিধাসহ সবকিছুকেই প্রশ্নের মুখে দাঁড় করাতে চাইছেন। চাইছেন এসব সংজ্ঞায়নের সঙ্গে নবগ্রামের উত্থাপিত আলোচনাটির একটি সংলাপ তৈরি করতে। চাইছেন ব্যক্তিনির্ধারিত বৃত্ত ভাঙলেই সমাজ তথা প্রতিষ্ঠান বা পাথর তার ওপর যেভাবে চেপে বসতে চায়, তার একটি ব্যবচ্ছেদ করতে।

দরজা পেরিয়ে আসা যাক এবার সুলতানের কাছে। সুলতান এখানে একা নন। আছে তাঁর ‘প্রথম বৃক্ষরোপণ’ চিত্রকর্মের প্রতিরূপ ও তার সামনে একটি আস্ত গাছ। মাঝে লাল পর্দা, যার ওপারে এলোচুলে ছবি আঁকছেন সুলতান স্বয়ং। চিত্রকর্মের পুরুষ বয়ানটিই পর্দা পেরিয়ে ব্যক্তি সুলতানের মনের বাড়ির সঙ্গে আলাপে ব্যস্ত। কী কথা হচ্ছে তাদের মধ্যে? সুলতানের সৃষ্টি ও সুলতানের ব্যক্তিক প্রকাশ কি পরস্পরকে একটি ফিনফিনে পর্দা মাঝে রেখে সংজ্ঞায়নে ব্যস্ত? সুলতানের মনের বাড়িতে প্রবেশের চেষ্টা বলা যায় একে। এই চেষ্টাই আরও স্পষ্ট হয়ে প্রকাশিত হয় পর্দায় কয়েকজনের আলাপে। ঢালী আল মামুন, নিসার হোসেন, দিলারা বেগম জলি, লালারুখ সেলিম, শাহীন রহমান ও নাসির আলী মামুন বলে যাচ্ছেন তাঁদের সুলতান দর্শনের কথা। মাঝে মাঝে প্রদর্শিত হচ্ছে সুলতানের কাজ রেফারেন্স হিসেবে। সুলতানের রাধা সেজে ঘুরে বেড়ানো, তাঁর পশুপাখির সঙ্গে সখ্য, তাঁর ছবিতে নারী-পুরুষের উপস্থাপন, তাঁর সবল শক্তিশালী পেশিবহুল অবয়বধর্মী চিত্রকর্ম, তাঁর প্রকৃতি সংযোগ, কীর্তন কিংবা বৈষ্ণব মতের সঙ্গে তাঁর যোগ—এই সবকিছুই উঠে এল আলোচনায়, এল না সুলতানের যৌনবোধের বিষয়টিই। তারপরও বিষয়টি অনুল্লেখ্য থাকল না। থাকল না দীপ্তি দত্তের উপস্থাপনরীতির কারণেই, যা প্রতিনিয়ত ঠক ঠক করে চলে ভেতরবাড়ির দরজায় ‘কিছু প্রশ্ন আছে বলে’। আন্তর্জাতিক নারী দিবসে মাইক্রো গ্যালারি অ্যাপিফেনিয়ায় শুরু হওয়া প্রদর্শনীটি চলবে ১৮ মার্চ পর্যন্ত।